আতংকিত না, সতর্ক হোন- পলি শাহিনা (নিউইয়র্ক থেকে)

0
441
Poly-Shahina

আতংকিত না, সতর্ক হোন- পলি শাহিনা

কত কত অন্ধকারের পাহাড় ডিঙিয়ে ভোর হয়, সূর্যের আলো ফুটে উঠে, তা শুধু একজন ভুক্তভোগী নির্ঘুম মানুষ জানে, অন্য কেউ নয়। ঘুম মানুষের জীবনের অত্যাবশকীয় জিনিস। ঘুম মানুষের সমস্ত ক্লান্তি দূর করে, মানসিক অস্থিরতা কমায়, স্নায়ু শীতল রাখে, মস্তিষ্ককে চাপমুক্ত রাখে। লোরকার ভাষায় স্লিপ লেস সিটি নিউইয়র্ক আজ গভীর ঘুমের রাজ্যে ঢলে পড়লেও, নিউইয়র্ক শহরে বসবাসরত বেশীরভাগ মানুষগুলোর চোখে ঘুম নেই। শুধু আমি নই, আমার মত আরো অনেকেই আছেন, যাঁরা মাঝ রাতে ভয়ে ঘুম থেকে আঁতকে উঠেন নিজের, পরিবারের, আত্নীয় -স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পরিচিত জনদের কথা ভেবে। শুধু নিউইয়র্ক শহর নয়, গোটা পৃথিবী নামক গ্রহটি বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাস আতংকে দিন পার করছে। করোনা ভাইরাসের আধিপত্যের কারণে গোটা পৃথিবী ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মানুষের জন্য এটি সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি মানুষ আগে হয় নি। মানুষ দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলেছে। করুণ অবস্থার মধ্য দিয়ে মানুষ প্রজাতি দিনাতিপাত করছে। এমন অবস্থার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না মোটেও। প্রস্তুতি না থাকলেও করোনা ভাইরাস থেকে পালানোর কোন উপায় নেই মানুষের, সতর্কতার সঙ্গে আমাদেরকে করোনা ভাইরাস কবলিত মানুষ এবং পৃথিবীর দুর্দিন থেকে কাটিয়ে উঠতে হবে। মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে। অন্ধকার যত গাঢ় হয়, আলো তত সন্নিকটে আসে। আশা করি সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন মানুষ করোনা ভাইরাসকে পরাজিত করে, মানুষ আবার মানুষকে বুকে টেনে নিবে পরম আদরে।

জীবনে কখনো কিংবা দীর্ঘ প্রবাস জীবনে এমন গৃহবন্দি হয়ে আমাকে সময় অতিবাহিত করতে হয় নি। ঘড়ির সেকেন্ডের কাটার সাথে দৌড়াতে থাকা আমার কাছে এখন, দিন- রাত্রির চেহারা একরকম লাগে। কখন সূর্য উঠে, সূর্য ডোবে, সন্ধ্যা নামে টের পাই না। জীবনের প্রয়োজনে কঠিন নিয়মানুবর্তী আমার সময় কাটছে এখন ভীষণ ঢিলেঢালা, অগোছালো ভাবে। আমার কোথাও যাবার নেই, কোন তাড়া নেই। আমি বন্দি জীবন যাপন করছি। ছুটি (vacation) আর বন্দি অবস্থা ( lockdown) সম্পূর্ণ দুটো আলাদা অনুভূতি। ছুটি অপার আনন্দের কিন্তু বন্দিত্ব অবশ্যই নিষ্ঠুরতম কষ্টের। ছোটবেলা থেকেই আমি খোলা আকাশের নিচে, সবুজের অকৃত্তিম আদরে বড় হয়েছি। আমি চাপ নিতে পারি না। হাসফাঁস লাগে। শ্বাসকষ্ট হয়৷ করোনা ভাইরাস আতংকে মাঝরাতে আচমকা ঘুম ভেঙে যায়। মনে হয় আমার গলা ব্যথা করছে, বমি বমি লাগছে, পেট গোলাচ্ছে, শরীর পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। আমি ভয়ে ঘামতে থাকি। অন্ধকার হাতড়ে বাচ্চাদের রুমে যাই। ওরা গভীর ঘুমে নিমজ্জিত। আমি পানি খাই। কিছু সময় পর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসি। সব আমার মনের ভয়। করোনা ভাইরাস আতংকে মনে এমন ভয় কাজ করছে।

কয়েকদিন হয়ে গেলো বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছি। আপাদমস্তক জুড়ে অস্থিরতা পেয়ে বসেছে। কোন কিছুতে মন বসাতে পারছি না। জানালার কাঁচে কিশোরীর মতো হেলেদুলে পড়া তুষার কন্যার হাতছানিতে, জানালার গা ঘেঁষে দাঁড়াই। পৃথিবীর তাবৎ ঘরবন্দী মানুষগুলোর গন্তব্য এখন জানালা। বৈশ্বিক মহামারি নভেল করোনা ভাইরাসের দ্রুত সংক্রমণের কারণে, কার্যত গোটা বিশ্ব যখন থেমে আছে, তখন ঘরবন্দি ক্লান্ত মানুষগুলো জানালার কাছে ছুটে যায়, প্রাণভরে আকাশ দেখে, বেঁচে থাকার গান গায়। মানুষের কষ্ট দেখে প্রকৃতিরও যেন মন খারাপ হয়ে আছে। মুখ ছাড়া আয়না যেমন অকেজো, তেমনি মানুষ ছাড়া প্রকৃতির রূপ যেন অর্থহীন।

মেঘাচ্ছন্ন দিন। ঘরের সামনে জমে থাকা পানিতে পাখির দল নির্ভয়ে খেলছে। আকাশে গর্জন, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে থেকে থেকে। জানালার বাইরে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টিজল ছুঁয়ে দিই। বৃষ্টিজল যেন আমার স্পর্শ পেয়ে হেসে উঠে, আনন্দ পায়। আমরা একসঙ্গে প্রাণখুলে হাসতে থাকি। আমাদের হাসিমুখে স্নান সেরে, মৃদু বসন্ত বাতাসের শরীর বেয়ে সোনালি সন্ধ্যা নামে। অপার এক অলীক ভালোলাগায় আমার মনপ্রাণ আবেশিত হয়ে আসে। করোনা ভাইরাস আতংক থেকে কিছু সময় আমি সতর্কতার সঙ্গে, নিজের মত করে দূরে সরে থাকি। এতে ভালো বোধ করি। সেদিন মাঝরাতে আমার আর ঘুম ভেঙে যায় না। আমি স্বস্তি বোধ করি।

জার্মান চ্যান্সেলর আন্ডেলা মার্কেল করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মান এমন ভয়াবহতার মধ্যে আর পড়েনি। করোনা ভাইরাস তান্ডবে পৃথিবীটা হঠাৎ কিরকম ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। পৃথিবীটাকে অচেনা লাগছে। অদৃশ্য এক অনুজীবের আক্রমণে পুরো বিশ্ব শংকায় দিন কাটাচ্ছে। এই ভয়ংকর ভাইরাসকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা মানুষের কবে হবে তা এই মুহূর্তে কেউ জানিনা, তবে এই ভাইরাসের আক্রমণ থেকে আমরা রক্ষা পেতে পারি সংবিধিবদ্ধ সতর্কতা অবলম্বনের মাধ্যমে। করোনা ভাইরাস খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বময়। এই ভাইরাসের বিস্তার রোধের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো আমাদেরকে ভালোভাবে জানতে হবে, এবং বিস্তার রোধে আতংকিত না হয়ে সতর্কতার সঙ্গে সেগুলো পালন করতে হবে। করোনা ভাইরাস নির্মূলে সতর্কতাই পারবে, এই ভয়ংকর ভাইরাসের গতি দ্রুত রোধ করতে।

মানুষ চাইলেই যে কোন অভ্যাসের সঙ্গে ধীরে ধীরে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। করোনা ভাইরাসের ভয়ে প্রথম দিকে যেভাবে ভীত হয়ে পড়েছিলাম, ভীতি থেকে কিছুটা অসুস্থ বোধও করছিলাম। এখন নিজের মধ্যে ভয় কমিয়ে, করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সতর্ক হয়ে উঠেছি। পৃথিবীর এখন দুঃসময় চলছে। পৃথিবী গভীর বিষন্ন অসুখে ভুগছে। বিপদের দিনে ভয় পেলে চলবেনা। আসলে, এখন সতর্কতা ব্যতীত আমাদের অন্য কোন উপায়ও নেই। করোনা ভাইরাস ঠেকাতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, বিশেষজ্ঞদের দেয়া নিয়মাবলি সতর্কতার সঙ্গে মানুষ যদি মেনে চলে, তাহলে অচিরেই পৃথিবী ফিরে পাবে তার পূর্বের সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন। এমন বিপদের দিনে ভয় না পেয়ে মনোবল শক্ত রাখতে হবে। ভয় পেলে বিপদ কমবে না, সতর্ক হলে আস্তে আস্তে বিপদ কমে যাবে। মানব সভ্যতার ইতিহাস লড়াইয়ের ইতিহাস। সৃষ্টির সূচনালগ্ন হতে মানুষ প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে লড়াই করে জয়ী হয়ে এসেছে। এখন মানুষের লড়াই চলছে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে। যুদ্ধে ভয় না পেয়ে সতর্কতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কোনভাবেই বাড়তে দেয়া যাবে না। এটির বিস্তার সীমিত করতে হলে ভয় পাওয়া চলবেনা, সতর্কতার সঙ্গে প্রতিরোধ করতে হবে। করোনা ভাইরাস থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখার উপায়গুলো সঠিক ভাবে মেনে চলার মাধ্যমে, মানুষ নিজেকে রক্ষা করতে পারবে বলে আশা রাখি।

করোনা ভাইরাস সম্পর্কে সচেতন হওয়া, সতর্ক থাকার পাশাপাশি সবাইকে হাসি-আনন্দে থাকার চেষ্টাও করতে হবে। সারাক্ষণ ভয়, আতংকের মধ্যে থাকলে মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পাবে। এতে মানুষ আরো বেশী দূর্বল হয়ে পড়বে। আতংকিত হয়ে করোনা ভাইরাস থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব নয়, যথাযথ সতর্কতা অবলম্বনের মাধ্যমে বাঁচা সম্ভব। পৃথিবীর দুর্দিন কেটে যাক, দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুক মানুষ।
সতর্ক থাকুন। হাসি সকল অসুখের মহৌষুধ। প্রাণ খুলে হাসুন। নিরাপদে আনন্দে বাঁচুন। করোনা ভাইরাস নামক অসুরের থাবা থেকে শীঘ্রই মুক্তি পাক মানুষ এবং পৃথিবী।

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধনাটোরে খোলা বাজারে ১০ টাকা কেজি দরে চাউল বিক্রি শুরু
পরবর্তী নিবন্ধসিংড়ায় সাংবাদিকদের জন্য প্রতিমন্ত্রী পলকের মাস্ক ও গ্লাভস প্রদান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে