অনুপ সরকার : ছোট বেলার অনেক ভূত আমার মাথার মধ্যে এখনও দিব্যি চেপে আছে। মাঝেমাঝে মনে হয়, মাথার মেমোরি রি-ফরমেট করে সব ডিলিট করে দিলে কেমন হয়? কিনতু আবার কেমন যেন মায়াও হয় এ গুলোর উপরে। কে জানে এ গুলো আছে বলেই হয়তো, এতো ঝুট-ঝামেলার মাঝেও বেঁচে থাকতে আমার বেশ লাগে। আমার এ হাজারোও ভূতের মধ্যে সবচেয়ে পাঁজি আর পুরানো ভূতের নাম আরোরা , না এটা ওর পদবী (family name) না, এটাই ওর ডাক নাম। তবে আরও একটা পরিচিতি আছে, ওকে Northern Lights ও বলে চিনে অনেকে।
এবার সংক্ষেপে বলি, এ ভূত আমারে আছর কেমনে করলো। আমি তখন ক্লাস এইট বা নাইনে পড়ি, সিলেট শহরে থাকি। ওই সময়টাতে নিয়মিত সিলেট পৌর পাঠাগারে যাওয়া আসা ছিল। ওখানে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রকাশিত কিছু ম্যাগাজিন আসতো। অনেক সুন্দর সুন্দর ছবির কাভার থাকতো বইগুলোর।আর ভেতরেও থাকতো নানা রংয়ের সুন্দর সুন্দর সব ছবি। এগুলোর কোন এক কপি তে প্রথম চোখে পরে Northern Lights। তারপর আমার মাথায় এ ভূতের স্থায়ী ঠিকানা ।
আধুনিক বিজ্ঞান একে আবার এক বিশেষ রকমের আলোক রশ্মি হিসাবে দেখে। এটা সৃষ্টি হয় যখন সৌরমণ্ডলের দ্রুত গতিশীল ইলেকট্রন কণা, আর আমাদের বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেন এবং নাইট্রোজেন গ্যাসের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। ইলেকট্রন কণা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ হওয়ার সাথে সাথে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেন এবং নাইট্রোজেন অণুগুলিতে শক্তি সরবরাহ করে আর উত্তেজিত করে তোলে। পরে এ অণুগুলি আবার যখন তাদের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে তখন তারা আলোকরূপে ফোটন বা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আরো অনেক রশ্মির প্রকাশ করে। এটাতেই সৃষ্টি হয় ম্যাজিকাল Northern Lights.” (আরো জানতে চাইল গুগল করতে পারেন) ।
এখানে আমার ভূতের অভিজ্ঞতা লিখে নিজেরে মহান বানানোর বা জাহির করার কোন উদ্দেশ্য নাই; আসল কথা আমি এ ভূতের আছর থেকে এখন মুক্ত। তাই এ লেখাটা তাদের জন্য যাদের মাথায় আরোরা ভূতের আছর আছে আর এ ভূতের থেকে চিরতরে মুক্তি চান। এটা এক রকমের প্রেসক্রিপশন মনে করতে পারেন। মোদদা কথা এ ভূতকে সামনাসামনি বিদায় দিতে হবে, নাইলে ওটা আপনাকে খোচাতেই থাকবে। আর তার জন্য কোথায় যেতে হবে বা কি করতে বা জানতে হবে তা নিচে লিখে দিলাম।
১- কোথায় পাবেন ভূতের দেখা ?
তা অনেক দেশেই পাবেন, তবে আমি সুইডেনের আবিস্কো (Abisko- North of the Arctic Circle) শহরকে লক্ষ্য করেই ট্যুর প্ল্যান করেছিলাম। এটা স্টকহোম থেকে ১৫০৬ কি:মি: দূরে অবস্থিত। আর তার পেছনে বেশ কয়েকটা কারনও ছিল, যেমন : তুলনামূলকভাবে অন্যান্য লোকেশনের চেয়ে গত কয় বছরে সবচেয়ে বেশী আরোরা দেখা গেছে এ শহরে, ভৌগলিক কারনে এ শহরের রাতের আকাশ সাধারণত পরিষ্কার থাকে (এটা আরোরা দেখতে পাবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক, আকাশে মেঘ থাকলে আরোরা হলেও আপনি দেখতে পাবেন না) আর সাথে তো অর্থনৈতিক কারনটাও ছিল (এখানে খরচাপাতি তুলনামূলক ভাবে কম)।
২- কেমন করে যাবেন ?
ধরে নিলাম আপনি স্টকহোমে আছেন, তা এখান থেকে আপনি দুইভাবে আবিস্কো যেতে পারেন।
ক) ফ্লাইটে করে কিরুনা (Kiruna) শহর পর্যন্ত, তারপর ট্যাক্সি বা বাসে করে আবিস্কো ( এ রুটে কিছুটা সময় বাঁচবে কিন্তু খরচ আর কষ্টটা বেশ হবে)। টুরিস্টদের কাছে কিরুনার আর এক বিরাট আকর্ষণ বিশ্ববিখ্যাত আইস হোটেল (লিংক: https://www.icehotel.com/icehotel-original) । আবিস্কো থেকে একদিনের জন্য কিরুনাটাও ঘুরে যেতে পারেন।
খ) দ্বিতীয় উপায় ট্রেনে করে, সময় মোটামুটি ১৬ বা ১৭ ঘন্টার মতো লাগবে, কিন্তু চমৎকার অভিজ্ঞতা হবে।
ট্রেন ছাড়ে স্টকহোম সেন্টাল থেকে সন্ধ্যা ৬:৩০ মিনিটে,
আবিস্কো পৌঁছাবে পরেরদিন সকাল ১১ টার দিকে। ট্রেনের ভাড়া টা নির্ভর করবে – যদি আপনার সাথে ইউরো-রেল পাস থাকে তবে শুধুমাত্র রাতে ঘুমানোর বাংক
রিজার্ভেসন এর টাকাটা লাগবে (প্রায় ৯০ ইউরো বা ২৫০ সুইডিস কোরোনা) আর যদি পাস না থাকে তবে প্রায় ৩৫০ ইউরোতে রিটারন টিকেট পেয়ে যাবেন। (আগেভাগে টিকেট কাটেন তাইলে দামটাও আরো কম পড়বে)
সুইডেন ট্রেনের ওয়েব লিংক : https://www.sj.se/en/about/about-sj/our-trains.html
৩- কখন যাবেন?
সেপ্টম্বর থেকে মার্চের মাসের রাতের অন্ধকারেই এ ভূতের দর্শন পাবেন।
৪- থাকবেন কোথায়?
আবিস্কোকে আসলে শহর না বলে গ্রামই বলা যেতে পারে। এর লোক সংখ্যা ৭০ এর নিচে। একটা গ্রোসারী স্টোর, কয়কটা ছোট আবাসিক হোটেল আর জলবায়ু গবেষণা কেন্দ্র নিয়েই এ গ্রাম। যেহেতু এখানে থাকার বেশী হোটেল নাই, তাই হোটেলটা আগে ভাগে বুক করে নিবেন। আমি ছিলাম Abisko Guesthouse এ ( ট্রেন স্টেশনের খুব কাছে)। বেশ ছিমছাম পরিষ্কার আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার আপনাকে কষ্ট করে পাহাড়ে চড়তে হবে না আরোরা দেখতে। হোটেলের বারানদা বা রুম থেকেও দিব্যি আরোরা দেখতে পাবেন। বুকিং ডট কমের মতো যে কোন এ্যাপ থেকে রুম বুকিং টা ঝামেলা ছাড়া করে ফেলতে পারেন, তবে এ কাজে একটা Credit Card লাগবে।
৫- কোথায় খাওয়া দাওয়া করবেন:
ইন্টারেসটিং ব্যাপার, এ শহরে কোন রেস্টুরেন্ট বা ফাস্ট ফুডের দোকান পাবেন না তাই আপনার ভরসা এ শহরের একমাত্র গ্রোসারী ষ্টোর। এখন, আপনি যদি অলস মেজাজের হোন তবে Frozen Food এনে Microwave করে খাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ওখানে নেই (অনেক হালাল অপসন পাবেন)। আর যদি একটু কাজকাম করতে আপত্তি না থাকে তবে ওই গ্রোসারীতেই রান্নার সব কিছু সস্তায় পাবেন আর হোটেলেই পাবেন কমন রান্না ঘর ( কয়দিন স্বপাক খেয়ে দেখেন কেমন লাগে )।
৬- কি করবেন :
ওখানে আরোরা ছাড়াও অনেক কিছুরই ব্যবস্থা আছে, একটা ছোটখাটো ধারনা জন্য নিচের লিস্ট :
1- Snowmobile driving
2- Dogsled tour
3- Aurora Photo tour
4- Hiking
5- Snowshoe walk
7- Narvik sightseeing (Tour to Norway)
8- Ice Fishing
9- Moose Spotting
10- Ice Climbing
11- Lake Torneträsk
ইত্যাদি ইত্যাদি…
৭- কিছু বিষয় মাথায় রাখবেন:
আবিস্কোর শীতকালীন তাপমাত্রা -৬ ডিগ্রী থেকে -১৮
ডিগ্রী (আমি -২১ ডিগ্রীতেও ছিলাম)। তুষার ঝড় যেকোন সময় হতে পারে। তাই শীতের কাপড়চোপড় চিন্তাভাবনা করে সাথে নিবেন (নাইলে হোটেল বুকিং এর সময়, হোটেলকে বলে দিবেন, ওরাই ব্যবস্থা করে দিবে)। আর যাদের এজমার (শ্বাসের) সমস্যা আছে তাদের সতর্কতার সাথে থাকতে হবে।
আর কি, দেখে আসুন প্রকৃতির চরম সুন্দর একরূপ আর সাথে মাথার ভূত থেকে চিরতরে মুক্তি।