“একুশের বইমেলা নিয়ে জলঘোলা- ২”- জাকির তালুকদার
যারা মনে করেন সাহিত্যে প্রতিযোগিতা হয়, তারা দয়া করে এখানে মন্তব্য করতে আসবেন না। কারণ সাহিত্যের যে প্রতিয়োগিতা হয় না, এটুকু বোধ যাদের নেই, তারা সাহিত্য বিষয়ে মতামত দেবার অধিকার রাখেন বলে আমি মনে করি না। প্রকৃত সাহিত্য একটি অপরটির পরিপূরক। সম্ভবত এই পণ্ডিতগণ বই বিক্রির প্রতিযোগিতাকেই সাহিত্যের প্রতিযোগিতা মনে করেন।
১৯৪৭ সালের পরে বর্তমান বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডে লেখালেখি করছিলেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, কবি আহসান হাবীব, আবুল মনসুর আহমদ, শওকত ওসমান, জসীম উদ-দীন, ফররুখ আহমদ, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, শওকত আলী, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দীন আল আজাদ, আবু ইসহাক প্রমুখ। সাহিত্যের গুণগত উৎকর্ষ তাদের কম ছিল, এমনটি কেউ, অন্তত যাদের মধ্যে সাহিত্যের বোধটুকু রয়েছে, বলবেন না।
কিন্তু সেই সময় এই দেশের কয়জন পাঠক তাদের রচনা পাঠ করেছেন? মধ্যবিত্ত রুচির কয়জন পাঠকই বা তাদের নাম জানতেন?
খুব কম।
কারণ সেই সময় ঢাকা ছিল প্রকাশনা অবকাঠামোর দিক দিয়ে একেবারে শূন্য। আগের একশো বছর ধরে কলকাতা ছিল বাংলার সবকিছুর মতো প্রকাশনারও কেন্দ্রবিন্দু। দেশবিভাগের পর ঢাকাতে কোনো ভালো ছাপাখানা, ভালো পত্রিকা, প্রেসের কাজ জানা ভালো কর্মী, ভালো কোনো বইয়ের দোকান– কিছুই ছিল না। তখনো এই দেশের পাঠকরা কলকাতার পত্রিকার জন্য অপেক্ষা করতেন। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত এই অবস্থাই বিরাজ করছিল। সেইসব পত্রিকায় যাদের লেখা ছাপা হতো, তারাই এই দেশের মানুষের কাছে পরিচিত হতেন লেখক হিসাবে। তাদেরই বই কিনতেন এই দেশের পাঠকরা। আবার তাদের মধ্যে যারা এন্টারটেইনার, যেমন ফাল্গুনী, নিমাই, বিমল মিত্র– তারাই ছিলেন বেস্ট সেলার। লেখক এবং এন্টারটেইনার যে এক জিনিস নয়, তা হয়তো আমরা এখনো বুঝতে শিখিনি। যারা ছিলেন লেখক, যেমন, অমিয়ভূষণ মজুমদার, সন্তোষকুমার ঘোষ, দেবেশ রায়, এমনকি বুদ্ধদেব বসু-প্রেমেন্দ্র মিত্রদের বইও তেমন বিক্রি হতো না কখনো। বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথের যুগ থেকে তখন পর্যন্ত ব্যতিক্রম হিসাবে দুইজন সত্যিকারের বড় লেখক ও কবি পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। একজন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অপরজন কাজী নজরুল ইসলাম। কাজেই বলা যায়, বাঙালি সাহিত্যিক বলতে মূলত এন্টারটেইনারদেরই চিনে এসেছে।
এখানে পুঁজি বিনিয়োগের কথাটি বলতে হবে। প্রকাশনা-ব্যবসায়ীরা সঙ্গতভাবেই তাদের পেছনে বেশি পুঁজি বিনিয়োগ করবেন, যাদের দ্বারা তাদের ব্যবসা সচল থাকে। এন্টারটেইনারদের শিখতে হয় পাবলিক কী খায়, কেমন লেখা খায়, এবং কেমন করে সেই রকম লেখা সাপ্লাই করতে হয়। এইখানে পুস্তক-ব্যবসায়ী এবং এন্টারটেইনারদের যোগসূত্র স্থাপিত হয়ে যায়। তখন তাদের পেছনে পুস্তক ব্যবসায়ীরা বেশি পুঁজি বিনিয়োগ করেন। প্রচারে, বিজ্ঞাপনে, জমকালো অনুষ্ঠানে, বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রায় এন্টারটেইনারদের উপস্থিত করা হয় পাঠকের চোখ ধাঁধিয়ে দিতে। কাজেই বই বিক্রির প্রতিযোগিতাতে সাহিত্যিকরা এন্টারটেইনারদের তুলনায় পিছিয়ে থাকবেন, এটি একটি নিয়তি-নির্ধারিত সত্য-র মতো অবস্থা।
বহু বছর পর্যন্ত কলকাতাকেন্দ্রিক এন্টারটেইনারদের তুলনায় বাংলাদেশের এন্টারটেইনাররা পিছিয়ে ছিলেন পুঁজির অসম প্রতিযোগিতার কারণে। অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হতে শুরু করে আশির দশকের মাঝামাঝি। বাংলাদেশি পুস্তক-ব্যবসায়ীরাও এদেশি এন্টারটেইনারদের পেছনে পুঁজি বিনিয়োগ করতে শুরু করেন। ছাপা-বাঁধাইসহ প্রকাশনার উন্নত প্রযুক্তি এদেশেও এসে পড়ে। সেগুলোর প্রয়োগ শুরু হয়। সেইসাথে এন্টারটেইনারদের জন্য প্রচার, বিজ্ঞাপন, অনুষ্ঠান, টিভির-র দরজা খুলে দেওয়া, দেশজুড়ে বিপণন, বইমেলার সময় পোস্টারে ঢাকা ছেয়ে দেওয়া, তরুণ-তরুণীদের দিয়ে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করা– এইসব আমরা দেখতে পাই।
তার মানে প্রতিযোগিতা শুরু হয় ঢাকা ও কলকাতার এন্টারটেইনারদের মধ্যে। দুই অঞ্চলের সাহিত্যিকরা এই প্রক্রিয়ার বাইরেই ছিলেন সবসময়। এখনো তাই-ই আছেন। দেবেশ রায়ের সাথে কোনো প্রতিযোগিতা হয় না হাসান আজিজুল হকের, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাথে কোনো প্রতিযোগিতা হয় না সন্দীপনের, রিজিয়া রহমানের সাথে কোনো প্রতিযোগিতা হয় না জয়া মিত্রের, শামসুর রাহমান-আল মাহমুদের সাথে প্রতিযোগিতা হয় না শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বা নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর। বরং এখনো পর্যন্ত বাঙালি জীবনের অর্ধেকেরও বেশি যে অংশ সাহিত্যে উঠে আসেনি, তাদের তুলে আনার ক্ষেত্রে একে অপরের পরিপূরক ভূমিকা পালন করেন সত্যিকারের লেখক-কবিরা।
ঢাকার একুশের বইমেলা কোনো প্রটেকশনিজম নয়। বরং ঐতিহ্য। বাংলাদেশের লেখক-কবিদের নিজ দেশের পাঠকদের সাথে পরিচয় ঘনিষ্ট করিয়ে দেবার জন্য চিত্তরঞ্জন সাহা যে উদ্যোগটি গ্রহণ করেছিলেন, সেটিকেই এই দেশের মানুষ এবং সরকার পরিণত করেছে মাসব্যাপী বইমেলায়। ঢাকাসহ দেশের সব শহরের দোকানে দোকানে ভারতীয় লেখক-কবিদের বই বিক্রি হয় সারাবছর। তাতে কেউ বাধা দেয়নি আজ পর্যন্ত। আপত্তিও করেনি। কাজেই কলকাতার বইয়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বইকে প্রটেকশন দেওয়া হচ্ছে, সেই কথার মধ্যে একবিন্দু সত্যতা নেই।
ঢাকার একুশের বইমেলায় যদি কলকাতার লেখক-কবিদের বই বিক্রির ব্যবস্থা হয়, তাতে একবিন্দু ভয় পাওয়ার মতো কিছু আমি দেখি না। ব্যক্তিগতভাবে দেখি না। কিন্তু তার জন্য “কলকাতার বইমেলায় বাংলাদেশের বই বিক্রির ব্যবস্থা আছে বলে ঢাকার বইমেলাতেও কলকাতার বই বিক্রির সুযোগ দিতে হবে”, এই যুক্তি আমি মানতে রাজি নই। আগের লেখাতে বলেছি, দুই বইমেলার চরিত্র আলাদা। যদি কলকাতার বই বা প্রকাশকদের ঢাকার একুশের বইমেলায় না আনলে আপনাদের সর্বনাশ হয়ে যায়, তাহলে একুশের বইমেলার চরিত্রটিকে বদলে আন্তর্জাতিক অবয়ব দিন।
বাংলাভাষার কোনো প্রকৃত লেখক-কবি ভাত-কাপড় বা বিলাসিতার সংস্থান করার জন্য সাহিত্য জগতে আসেন না। তাই বই বিক্রি নয়, সত্যিকারের মনোযোগী পাঠক পাওয়াটাই তাদের লক্ষ্য। বছরে বইমেলার একমাস নয়, বরং তারা মহাকালের জন্য অপেক্ষমান। কোনো লেখক কখনোই এন্টারটেইনারদের নিয়ে ভাবেন না। তাদের বই বিক্রির অবিশ্বাস্য সংখ্যা দেখে ঈর্ষান্বিতও হন না। বরং উল্টোটাই আমরা দেখতে পাই। বইমেলাতে যে এন্টারটেইনারের এক লক্ষ কপি বই বিক্রি হয়; দুই বছরে পাঁচশো কপি বই বিক্রি হওয়া লেখকের নাম শুনলেই ঈর্ষায়-ক্ষোভে তার মুখ কালো হয়ে যায়। মুখ থেকে বেরিয়ে আসে খিস্তি।
ঢাকা-কলকাতার এন্টারটেইনাররা খিস্তি করুক আর কুস্তি করুক, আমাদের কিছু যায়-আসে না।
ঢাকার একুশে বইমেলায় কলকাতার বই বা প্রকাশনা সংস্থাকে আনতে না দেওয়ায় যাদের বুক দুঃখে ফেটে যাচ্ছে, তাদের জন্য এর চেয়ে বেশি কিছু আমার বলার নেই।