কথা প্রসঙ্গে || মনির জামান ||
কথা, মাত্র দু’টো বর্ণ সংযোগে তৈরী একটি শব্দ। যার মাধ্যমে আমরা মনের ভাব প্রকাশ করি। কথা বলার ধরণ, বাচনিক ভঙ্গি এবং গাঠনিক কথনের মাধ্যমে মানুষের ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটে থাকে। অপরকে সম্বোধন করতে কথার শৈল্পিক উপস্থাপনাই প্রমাণ করে কে কোন স্তরের। একজন মানুষ প্রয়োজন অপ্রয়োজনে অনেক কথাই বলে থাকে। কথায়-ই মনুষ্য জাতির জানবার ও জানাবার একমাত্র উপায়। সুর, কর্কশতা, হিংস্রতা ও কমনীয়তার প্রকাশ আমরা কথাতেই প্রকাশ করে থাকি। সুর-অসুরে গড়া মানুষও এ ক্ষেত্রে জৈবিক বৈশিষ্ট্যে অভিন্ন।
একজন মানুষের কথা শত সহস্র মানুষকে বিমোহিত করে আবার কেউ কথার দ্বারাই রাজ্যের কোটি মানুষের মনে পদাঘাত হানছে। কথায় বন্ধুত্ব হয় আবার বন্ধুত্ব নষ্ট হওয়ার ঘটনাও কম নয়। কোনো এক ভাবুককে কথা প্রসঙ্গে বলতে শুনেছি, “আমার অতিরিক্ত বলার জন্য আমার জিহ্বাকে আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না, আমার অতিরিক্ত কথা বলার জন্য আমার জিহ্বাই দায়ী।” অহেতুক জিহ্বাকে দোষ দিয়ে কী লাভ! যদি আমরা নিরপেক্ষভাবে নিজেকে প্রশ্ন করি, আমরা কি সব সময় কথা বলাকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারি? প্রশ্নের সদুত্তোর না পেলে অজ্ঞতাকে তো আর দোষ দেয়া যায় না, কারণ অজ্ঞতা সে তো ব্যক্তির নিজেরই সৃষ্টি।
অতিরিক্ত কথা বলা সে ভালো হোক আর মন্দ হোক ক্ষতি বৈ লাভ নেই। এক্ষেত্রে হযরত আবু বকর সিদ্দিকী (রাঃ) বলেন, “কথা সংক্ষিপ্ত করতে চেষ্টা কর। অধিক কথা মেধাশক্তি নষ্ট করে।” কথার প্রাচুর্যতা বা অশ্লীলতা কখনই সুখকর নয়। মহাত্মা গান্ধী বলেন, “যখন তোমরা কথা বলবে তখন খুব হিসেব করে বলবে কারণ যা তোমরা বলো তা কিন্তু ফিরে তোমার মুখে প্রবেশ করবে না।” এগুলো কিন্তু মোটেও কথার কথা নয়। তারপরও কি আমরা আমাদের কথা থেকে আমরা আমাদের অপ্রয়োজনীয় শব্দ বা বাক্য পরিহার করতে পারি? আমরা যত বলতে পারি ততই মনে করি আমরাই ঠিক কিন্তু নিজের ভুলটাও অনেক সময় ধরতে পারি না। অকপটে আমাদের কথা বলতে থাকি সাধারণের কাছে তা অসুন্দর মনে হলেও।
ভাব প্রকাশে কথার বিকল্প নেই আবার আত্মম্ভরিতা বা আত্মকথায় পূর্ণ ব্যক্তি লোক সমাজে অনাদরণীয়, অবজ্ঞেয়। সেই কথা বা বাক্য উচ্চারণ করা যুক্তিযুক্ত নয় যা কোনো কাজের কথা নয়। পবিত্র হাদিস শরিফে আছে, “যে ব্যক্তি কথা, কাজে ও চিন্তায় এক নয় সে প্রকৃতপক্ষে সত্যনিষ্ঠ নয়।” ইংরেজিতে একটি কথা আছে, “Man may come man may go. We will not to stay, but stay with our act.” একজীবনে মানুষ ক’দিনইবা বাঁচে, পঞ্চাশ কি এক’শ! তারপরও বয়সের বাঁচা আর কর্মের বাঁচার মধ্যে স্থায়িত্বকালের পার্থক্যের কারণেই হয়তো এই কথাগুলো এসেছে। ভালো’র নিমিত্তে একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস একজন খেঁটে খাওয়া মানুষকে বড় করে তোলে। পৃথ্বিভূম যাকে যুগান্ত বয়ে বেড়ায়।
সভা, সেমিনার, জন্ম-মৃত্যু বার্ষিকীতে যারা আদর্শ হয়ে ধরা দেয় প্রজন্মের কাছে। এ অমরত্ব শুধুমাত্র তাঁর কথা বা বয়সের নয় তার কর্মের অথচ একই ব্যক্তির সম-সাময়িক কেউ ধনাঢ্য, বিলাসী অগড় বগড় কথা ও কাজের মধ্যে যে হারিয়ে গেছে কালের গহ্বরে। কথা আর নামের ভিড়ে তাঁর ধনও মিলিয়ে গেছে শূন্যে, দেবার কথা কিন্তু তাঁরই বেশি ছিল, তিনি দিতে পারেননি। আসলে গ্রহণে যে মত্ত সেবার হাত তাঁর রিক্ত, বাঁচার আশা বৃথা। স্ব-দেশের স্বাধীনতা, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও গাঠনিক কর্মের যারা নিবেদিত প্রাণ চিরকাল তাঁদের উদ্দেশ্যে জাতি বলবে, “আমরা তোমাদের ভুলব না,” ভুলব না তোমাদের কথা ও কর্ম। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় আসনে আসীন কর্তা-ব্যক্তিগণ তুচ্ছ স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে প্রতিশ্রুতি আর প্রলোভনের প্রহসনে ‘Real act’ কে বাদ দিয়ে অনেক কথাই বলে থাকেন।
ফলতঃ কাজের বেলায় তাঁদের কথার সাথে সংগতি না থাকার কারণে অযাচিত উশৃঙ্খল ঘটনার উদ্রেক ঘটার নজিরও কম নয়। তারপরও তাঁরা অবলীলায় কথা বলে যায়। ভাবটা এমন যেন_ “কথার নাম মধু বাণী যদি কথা কইতে জানি।।” রাজনৈতিক বিষয়ে বলতে গেলে, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পদপ্রার্থী নির্বাচন পূর্ববর্তী যে সকল প্রতিশ্রুতি জনগণকে দিয়ে আসেন নির্বাচন পরবর্তী সময়ে ঐ সকল প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন আদৌ ঘটে কী! এমনও পরিতাপের ঘটনাও ঘটে যখন আবেদনের পর আবেদন, জুতোর শুকতলীর ক্ষয়, সময়ের অপচয়, অর্থের অপচয়, এক পর্যায়ে যখন সকল ক্ষয়ক্ষতির ভারে নিস্তেজ মানসিকতায় আর যখন কোনো চাওয়া পাওয়া থাকে না তখন হয়তো মাননীয় মহোদয় আয়েশী ঢংয়ে বলে বসেন, “আরে কী হয়েছে, এখনও তো অনেক সময় আছে, আমার কথায় বিশ্বাস রাখো, দেবো।” কবির আপশোস এখানেই, “আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।” এরকম কথায় বড় হওয়ার প্রবণতা আমাদের হামেশাই বিভ্রান্ত করে।
নিরবতাকে আমরা অজ্ঞানতা বলে ধরে নিই, অথচ আত্মা যাদের সচল এবং ভাবে পরিপূর্ণ তাঁদের মুখে কথা থাকে না। প্রায়শঃ লক্ষ্য করা যায়, বন্ধু-বান্ধব বা পরিচিতজন একসাথে বসে কথা বলছে, এমন সময় তাঁদেরই পরিচিত আর একজনকে দূরে ডেকে নিয়ে কী যেন বলে চলে গেল, এমতাবস্থায় উৎসুক আর সবার মনে একটা অজানা কৌতুহল সৃষ্টি করে দিল! আবার অনেকের মধ্যে কথা বলতে বলতে এক সময় বক্তা বিশেষ ভঙ্গিতে বলেই ফেলল, “ওসব কথা আমি আপনাদের পরে বলব, কিংবা অমুক ভাই আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে, আপনি আমার সাথে একটু পরে দেখা করবেন।” এই যে গুপ্ত অভিব্যক্তি যা স্বভাবতই বিপরীত মননে সন্দেহের উদ্রেক করে। এমনিতেই মানুষ মাত্রেই গুপ্ত জিনিসের প্রতি কৌতুহলী তারপরেও যদি এরূপ ঢাকঢাক গুড়গুড় করে কথা বলা হয় তাহলে তো শত্রু তৈরি হতে সময় লাগবে না।
বাঙ্লা প্রবচনে আছে, “গাছের শত্রু লতা মানুষের শত্রু কথা।” কান কথা যেমন সন্দেহের উদ্রেক ঘটায় তেমনি শোনা কথা বলতে গিয়ে সামাজিক বিশৃঙ্খলা বা বিবাদের সৃষ্টি হয় অনেক সময় রক্তপাত কিংবা প্রাণহানীর মতো ঘটনাও ঘটে যেতে পারে। জ্ঞানীরা বলেন, “শোনা কথা মিথ্যার নামান্তর।” তারপরেও কথা বলার স্বাধীনতা বা বাক স্বাধীনতা দেশে দেশে প্রতিটি মানুষেরই এক নীতিগত অধিকার এ অধিকারে বস্তুত কেউ হস্তক্ষেপ করে না তবে বোধকরি সত্যকথা বলার স্বাধীনতা আমাদের পৃথিবীকে আরো বেশি প্রাগ্রসর ও শালীন সুন্দরের দিকে নিয়ে যায়। যাতে করে ইপ্সিত কাজটিও স্বতঃসিদ্ধ হয়। সৎ বাক্য বা সত্য কথা বলায় ব্যক্তির যেমন আত্মীক উন্নতি ঘটে অন্যদিকে বক্তা ও শ্রোতার মধ্যে পারস্পারিক হৃদ্যতা প্রগাঢ় পরিণতি পায়।
”তাঁরাই মুমিন, যারা দ্বায়িত্ব পালন করে, কথার খেলাপ করে না, অঙ্গীকার পালন করে।” সহীহ হাদিসের এমন কথাগুলোকে আমরা সচারাচর ভুলে গিয়ে আমরা সকাল বেলার চায়ের কাপের সাথে কথার তুফান তুলে দিন কাবার করে দিই। প্রকৃতপক্ষে মহৎ কাজের কথা চিন্তায়-ই আনতে পারি না। কেবলই পরের ছিদ্রান্বেষণ আর পর চর্চায় পরার্থপরতাকে পরাহত করি। আঁধারে প্রদীপ জ্বালানোর নেই কেউ, প্রজ্বলিত আলোর অপচয়ে ক্ষয়িষ্ণু ব্যক্তিক বিবেক।
তথাপি আলোকবর্তীকা হাতে কেউ যদি অন্ধকারের কালোত্ব ঘোচাতে চেষ্টা করে তবে কি করে তাঁর আলো ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেয়া যায় ক্রোধোন্মত্তের কথাবার্তায় তার সুর স্পষ্টতঃ। এ ক্ষেত্রে প্লেটোর উক্তিটি স্মরণীয়, “কথাবার্তায় ক্রোধের পরিমাণ আহার্যে লবনের মতো হওয়া উচিৎ। পরিমিত হলে রুচি মাফিক আর অপরিমিত হলে ক্ষতিকারক।” অতিকথনের অতিশয্যে এমনতর ক্ষতির সন্মুখীন হয়েও আমরা বলি, আর বলি বলেই দু’হাত সাপ দশ হাতে পরিণত হয়। বাপরে!.. কী ভয়ানক! ভয়ানক “সাপ’ নয় ভয়ানক “কথা”! সাধক সত্যানন্দ দাশ সত্য কথাই বলেছেন, ”অনেক কথার অনেক দোষ ভেবে চিন্তে কথা কোস।”
তাই আমাদের উচিৎ, ভেবে চিন্তে কথা বলা এবং কথা বলায় সংযত হয়ে প্রতিটি কর্মে উদ্যোগ নেয়া যাতে করে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম অতিরিক্ত কথা দূষণের হাত হতে রক্ষা পায়। অবশ্য সবাই কম কথা বলতে পারে না। কথায় বলে, “শূন্য হাঁড়ি বাজে বেশি।’ মূদ্রাদোষের মতো এও এক বিরাট বদ অভ্যাস।