কবি নির্মলেন্দু গুণ ও বর্তমান প্রেক্ষিত- স্বকৃত নোমান

0
670
Noman

কবি নির্মলেন্দু গুণ ও বর্তমান প্রেক্ষিত-স্বকৃত নোমান

একজন কবি-সাহিত্যিককে পাঠকরা সাধারণত রাজনীতি-নিরপেক্ষ হিসেবেই আশা করে। কবি-সাহিত্যিকরা সমাজের অগ্রসর মানুষ। সাধারণ পাঠক তো বটেই, রাজনীতিকরা পর্যন্ত তাঁর চিন্তা-চেতনায় প্রভাবিত হয়ে থাকেন। কিন্তু কোনো কবি-সাহিত্যিক যদি রাজনীতিতে যুক্ত হন, রাজপ্রশস্তি করেন―সেটা কি তার দোষ? তার খর্বতা? রাজপ্রশস্তি দোষণীয় হলে তো পৃথিবীর অন্যতম প্রধান মহাকাব্য ‘শাহনামা’ এ দোষে দুষ্ট। আলাওল, যাকে বলা হয় মহাকবি, আরাকানরাজের স্তুতির জন্য তো তাঁরও নিন্দা করা উচিত। সাহিত্যে রাজপ্রশস্তির এমন উদহারণ তো বিস্তর দেওয়া যাবে।

রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন এমন কবি-সাহিত্যিকের সংখ্যাও তো কম নয়। কবি পাবলো নেরুদা তো একাধিক কূটনৈতিক পদে ছিলেন। চিলিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির সেনেটর হিসেবেও কার্যভার সামলেছেন। ঔপন্যাসিক ম্যাক্সিম গোর্কি উদীয়মান মার্কসবাদী সামাজিক-গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। বলশেভিক পার্টির সঙ্গে যুক্ত থেকে কাজ করেছেন। ঔপন্যাসিক ভিক্টর হুগো সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যুক্ত হন পরিণত বয়সে। রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সমর্থন থাকায় সম্রাটের রোষানলে পড়তে হয়েছিল তাঁকে। মারিও বার্গাস ইয়োসা সমাজ বদলের তাড়না থেকে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। ১৯৯০ সালে তিনি পেরুর রাষ্ট্রপতি পদের জন্য সাধারণ নিবার্চনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। নব্বইয়ের দশকে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে হ্যারি ব্রাউন লিবার্টারিয়ান পার্টির হয়ে দু-বার প্রেসিডেনশিয়াল নমিনি হয়েছিলেন।

কবি নির্মলেন্দু গুণ সম্প্রতি নিজেকে ‘আওয়ামী লীগের কবি’ বলেছেন। বলেছেন যারা তাঁকে ‘আওয়ামী লীগের কবি’ বলে কোণঠাঁসা করতে চায় তাদের উদ্দেশে। তিনি এটা প্রকাশ্যে বলেছেন, এটা তাঁর সাহস, এটাই তাঁর ব্যক্তিত্ব। এদেশের বিস্তর নামজাদা লেখক রাজনীতিকদের কাছ থেকে বড় বড় সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন, কিন্তু নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছেন রাজনীতি-নিরপেক্ষ হিসেবে। অর্থাৎ তাঁদের ‍সুন্দর একটা মুখোশ ছিল। নির্মলেন্দু গুণের সেই মুখোশটা নেই। মুখোশ নেই বলেই জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের পর তিনি দৃপ্তসাহসে শব্দবাণ উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন : ‘সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি/রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেইসব গোলাপের একটি গোলাপ গতকাল/আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।’

একটা রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের জন্য এদেশের লেখকদের (সবাই নয়) নির্লজ্জ তদবিরবাজির তো সীমা-পরিসীমা থাকে না। পুরস্কারের জন্য বোতল বোতল মদ উজাড় করে দিতে কার্পণ্য করে না। গরু-খাসি জবাই দিয়ে খাওয়াতেও না। নির্মলেন্দু গুণ ওসব তদবিরবাজির ধার ধারেন না। তাই স্পষ্টভাবে, অকপটে তিনি রাষ্ট্রের কাছে পুরস্কার চাইতে পারেন। এই পুরস্কার দাবি করার পর, নিজেকে আওয়ামী লীগের কবি দাবি করার পর অনেকে অবাক হয়েছেন, হচ্ছেন। এই অবাক হওয়াদের অধিকাংশই সাহিত্য-জগতে নবাগত। এদের ক্ষেত্রে ‘অর্বাচীন’ শব্দটা ব্যবহার করা যায়। এদের অধিকাংশই নির্মলেন্দু গুণের জীবনটাকে জানেন না। অধিকাংশই তাঁর ‘আমার কণ্ঠস্বর’ পড়েননি। পড়লে তাঁরা কবি নির্মলেন্দু গুণের চারিত্রিক বৈশিষ্ট বুঝতেন, তাঁর অকপটতা বুঝতেন। বোঝেন না বলেই তারা অন্যসব কবি-সাহিত্যিকদের চারিত্রিক বৈশিষ্টের সঙ্গে নির্মলেন্দু গুণের চারিত্রিক বৈশিষ্ট গুলিয়ে ফেলছেন। তারা শিশু। শিশুরাই বেশি বেশি অবাক হয়। তাদের অবাক হওয়ার অধিকার আছে।

কিন্তু এই ‘শিশুদের’ কারো কারো অবাক হওয়ার মাত্রা এতটাই যে, তাঁরা নির্মলেন্দু গুণকে অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিতেও ছাড়ছেন না। তাদের গালির স্টাইল দেখে মনে হচ্ছে পারলে তারা নির্মলেন্দু গুণকে শারীরিকভাবেও হেনস্তা করে। আবার তাদের অধিকাংশই প্রচণ্ড রকমের আওয়ামী লীগ বিদ্বেষী। এতটাই যে, নির্মলেন্দু গুণ নিজেকে বিএনপি, জামায়াত বা হেফাজতের কবি বলে ঘোষণা দিলে তারা খুব পুলকিত হতো।

সাহিত্যের পথে থাকলে এই ‘শিশুরা’ একদিন নিশ্চয়ই অকপট নির্মলেন্দু গুণকে চিনতে পারবে, বুঝতে পারবে। সেদিন নিশ্চয়ই তারা এসব গালির জন্য লজ্জিত হবে। নিজেদের খর্বতা, অর্বাচিনতা, মূর্খতার জন্য অনুতপ্ত হবে।

মহাকালে রেখাপাত
০২.০৫.২০২০

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধডিআইজির পক্ষ হতে সিংড়ায় অসহায় পরিবারের মাঝে রমজানের খাদ্য সামগ্রী বিতরণ
পরবর্তী নিবন্ধবাগাতিপাড়ায় সরকারি গোডাউনের ওয়াল ঘেঁষে ঘর নির্মাণ বন্ধ করলো পুলিশ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে