করোনাকাল- স্বকৃত নোমান
বাসররাতে জুতিফাকে দেখে মতিনের মনে পড়ে গিয়েছিল এই গাঁওয়াইল গ্রামে একদিন শাপলা-শালুক ছিল। তার গায়ের রঙটা একেবারে শাপলার মতো। এখনো যখন সে গোসল করে আসে, মতিনের মনে হয়, পুকুর থেকে যেন একটা শাপলা হেঁটে হেঁটে ঘরে এসে ঢুকেছে। শাপলাটাকে তখন জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে, কাঁচা খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে।
সেদিন সংসারের কাজকর্ম সেরে জুতিফার গোসল করতে করতে পাঁচটা বেজে গিয়েছিল। শীতের কনকনে ঠান্ডার ভোররাতে গোসল করতে তার অসুবিধা হয় না, কিন্তু বসন্তের এই না-গরম না-ঠান্ডার মৌসুমে অবেলায় গোসল করলে মাঝেমধ্যে তার ঠান্ডা লেগে যায়। সেদিনও তাই হয়েছিল। পুকুরে ডুব দিয়ে উঠতেই মাথাটা কেমন ভারী হয়ে উঠেছিল। মনে হচ্ছিল ভেতরে যেন ঠান্ডা পানি ঢুকে বসে আছে। রাতে শুরু হলো সর্দি আর মাথাব্যাথা। শেষরাতে মতিনকে বলেছিল, আজ থাক। মতিন শোনেনি। ভোর রাতে জুতিফাকে আবার নামতে হলো পুকুরে। ভেবেছিল এবার বুঝি আর জ¦রটা ঠেকানো যাবে না। কিন্তু না, উল্টো সর্দি তো গেলই, মাথাব্যাথাও।
জুতিফা হাঁফ ছাড়ে। যাক বাবা, ফাঁড়াটা কেটে গেল। কদিন ধরে মানুষজন বলে বেড়াচ্ছে দেশে নাকি করোনা নাম নিয়ে শনি ঘুরে বেড়াচ্ছে। সামান্য সর্দি জ¦র হাঁচি কাশিতে নাকি মানুষ মারা যাচ্ছে। ধনী-গরিব কেউ বাদ যাচ্ছে না। কী কাল যে এলো! করোনা আতঙ্কে শহরের মানুষজন ঘরবন্দি হয়ে আছে। জ্বর-হাঁপানির রোগী দেখলেই হাসপাতালগুলো ভর্তি নিচ্ছে না। এই অসময়ে জ্বরে পড়লে তার ছিদ্দতের সীমা থাকত না। এই পোড়া গাঁয়ে হাসপাতাল তো দূর, একটা ডাক্তারও নেই। হাসপাতাল আছে আছে সেই উপজেলা সদরে। সাত কিলোমিটারের পথ।
কিন্তু তিন দিন পর সকালে ঘুম থেকে উঠে জুতিফা টের পায় তার গায়ে জ্বর জ্বর ভাব, সেই সঙ্গে হাঁচি-কাশি আর গলাব্যথা। পেটটাও কেমন ভারী হয়ে আছে। জুতিফা ঘাবড়ে গেল। হুট করে আবার জ¦র উঠল কেন? বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করছিল না তার। কিন্তু শুয়ে থাকলে উঠানঘাটা ঝাড়ু দেবে কে? সে না দিলে সারা দিনেও কেউ দেবে না। উল্টো শাশুড়ির বকাবকি শুনতে হবে।
পুকুরঘাটে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে ঝাড়ুটা নিয়ে সে উঠানে নামে। তার শাশুড়ি নসুয়া তখন বড়ঘরের পৈঠায় বসে শ্বশুরকে ঝাড়ি দিচ্ছে, বাজারে না গেলে ভাত হজম হয় না। করোনা রোগ ঘুরে বেড়াচ্ছে। শোনেন নাই সরকার সবাইরে ঘরে থাকতে কইছে? ঘরে গিয়া শুইয়া থাকেন। বাজারে গিয়া কাম নাই।
জুতিফার ঘন ঘন হাঁচি-কাশি দেখে নসুয়ার ধন্দ জাগে। করোনা নয় তো! তাই তো মনে হচ্ছে! নইলে এভাবে হাঁচি-কাশি দিচ্ছে কেন? মতিন বাজারে গিয়েছিল। বাজারে তার তরিতরকারির ব্যাবসা। মায়ের ফোন পেয়ে ছুটে এলো। জুতিফা তখন পুকুরপাড়ের আমতলায় বসে বসে কাঁদছে। ঘর থেকে বের করে দিয়েছে তার শাশুড়ি। করোনা ছোঁয়াছে রোগ, ঘরে থাকলে সবাইকে ধরবে। মতিনকে দেখেই হাত ধরে টেনে ঘরে নিয়ে যায় নসুয়া। বলে, খবরদার, ঐ বেটির ধারেকাছে যাস না বাপ। নিশ্চয়ই খারাপ মেয়েলোক। নইলে করোনায় ধরল কেন?
ধারেকাছে যায় না মতিন। একটা মোড়া এনে দরজার সামনে বসল। ঘরে যেতে সাহস পাচ্ছে না। ঘরে যে করোনা পোকা ঘাপটি মেরে বসে নেই তার গ্যারান্টি কী? তার ঘরটা দক্ষিণ ভিটায়। দুই কামরার ঘর। উত্তর ভিটায় বড় ঘরটা বাবা-মায়ের। বড় ভাইয়ের বউ ছেলেমেয়েদের নিয়ে এ ঘরেই থাকে। বড় ভাই গাজীপুরের এক কারখানায় চাকরি করে। সপ্তায় একবার আসে।
মতিন ভেবে পায় না জুতিফাকে করোনা রোগ কেমন করে ধরল। সারাক্ষণ তো সে বাড়িতেই থাকে। আগে মাঝেমধ্যে পাশের বাড়ি যেত, বাড়ির সীমানা নিয়ে ঝগড়াঝাটির পর তাও বন্ধ করে দিয়েছে। তবে কি মায়ের কথাই সত্যি? জুতিফা কি এমন কারো সঙ্গে মেলামেশা করেছে যে করোনার রোগী? তাই-বা কেমন করে হয়? মেলামেশা করার সুযোগটা কোথায়? করলে কি সে টের পেত না? বাড়ির কেউ টের পেত না? এ বাড়ির আশপাশে তো সহজে কেউ আসে না। তাছাড়া জুতিফা তেমন মেয়েও নয়। কখনো গ্রামের কেউ এলে কথা বলা তো দূর, তার সামনেই পড়ে না।
জ¦র নিয়ে জুতিফা আমতলায় বসে আছে দেখে মতিনের খারাপ লাগছে। কিন্তু উপায় নেই। তাকে ঘরে আনা মানে বাড়ির সবাইকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া। মতিনের বাপ হাঁপানি রোগী। একবার করোনায় পেয়ে বসলে আর টেকানো যাবে না। তাছাড়া মতিনও সিগারেট খায়। শুনেছে যাদের এই বদ অভ্যাসটা আছে করোনায় ধরলে তারা নাকি সেরে ওঠে না। সত্যি-মিথ্যা জানে না। মানুষ তো কত কথা বলে, সব তো সত্যি নাও হতে পারে। তবু তার ভয়। যদি সত্যি হয়!
মতিন একটা সিগারেট ধরায়। খেয়াল করে, রাস্তায় পশ্চিমপাড়ার আকমল বাজারের দিকে যাচ্ছে আর ফিরে ফিরে জুতিফাকে দেখছে। মতিনের বুকটা মুচড়ে ওঠে। জুতিফার রোগটার কথা জানাজানি হলে তো মহা সর্বনাশ। মুহূর্তে সারা গ্রামে রটে যাবে। চকিদার এসে বাড়িতে লাল ঝাণ্ডা টাঙিয়ে দেবে। পুলিশ এসে সবাইকে একঘরে করে দেবে, যাকে বলে লকডাউন। হতে পারে। অসম্ভব নয়। সাটুরিয়ার ওদিকে নাকি দুটি বাড়ি লকডাইন করা হয়েছে। ফরিদপুর-শরিয়তপুরের দিকে কয়েকটা উপজেলাও নাকি তাই করেছে। হাটবাজার মসজিদ মন্দির স্কুল কলেজ গাড়ি ঘোড়া সব বন্ধ। বাড়ি থেকে কেউ বেরুতে পারছে না। বাড়ি লকডাউন করে দিলে তো তাদেরও একই দশা হবে। কেউ বেরুতে পারবে না, কেউ ঢুকতেও পারবে না। একেবারে সমাজ-নমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। বাড়িতে মরে পড়ে থাকলেও কেউ খোঁজ নিতে আসবে না। তার ব্যবসাপাতি সব লাটে উঠবে। পুলিশ তার দোকান বন্ধ করে দেবে। বন্ধ না করলেও কাস্টমার যাবে না। বলা যায় না, পুলিশ এসে বাড়ির সবাইকে হাসপাতালেও নিয়ে যেতে পারে। কোথায় কোথায় নাকি করোনা সন্দেহে লোকজনকে ধরে ধরে হাসপাতালে নিয়ে বেঁধে রাখছে। টিভির খবরে বলেছে, সেটা নাকি কোয়ারেন্টিন। চৌদ্দ দিন থাকতে হয়।
কী করা যায়? মতিন ভেবে পায় না। তার মা বলে, তোর বউকে বরং বাপের বাড়ি পাঠায়া দে। যার মেয়ে সে সামলাক। আমাদের কী ঠেকা? মতিনের বাপ বলে, ঠিক, যার মেয়ে সে সামলাক। মতিনের ভাবী কি আর শ্বশুর-শাশুড়ির কথায় সাঁয় না দিয়ে পারে? এ বাড়িতে তাকে সাঁয় দিয়েই চলতে হয়। কোনো ব্যাপারে তার নিজস্ব মতামত থাকে না। শাশুড়ি যা বলে সেটাই তার মত। বিয়ের পর কখনো শাশুড়ির মতের বাইরে যেতে পারেনি। মায়ের কথাটা মতিনেরও মনে ধরল। কিন্তু বাপের বাড়ি তাকে কে নিয়ে যাবে? নসুয়া বলে, সে কি নোয়া বউ? তাকে দিয়া আসতে হবে ক্যান? একাই চলে যাক। কতখানি পথ?
পথ বেশি নয় বটে। একই গ্রাম। গ্রামের উত্তর মাথায় জুতিফার বাপের বাড়ি। বড়জোর কুড়ি মিনিটের পথ। প্রান্তরের পথে দশ মিনিট। উঠানে দাঁড়িয়ে নসুয়া হাঁক মারে, একজনে দশজনের বিপদ ডেকে আইনো না বাপু। সময় থাকতে বাপের বাড়ি ভাগো।
জুতিফা এবার সশব্দে কেঁদে ওঠে। মানুষ এমন নিষ্ঠুর হয়! এমন জ¦র নিয়ে শাশুড়ি কিনা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছে! এই ঘর-সংসার কি তার নয়? সে স্বামীকে ডাকে, দোহাই লাগে, আমার একটা কথা শোনেন। আমাকে একটিবার ডাক্তারের কাছে নিয়া যান।
মতিন নড়ে না।
আসবেন না?
মা কী কইছে শোনো নাই?
আপনারও একই কথা?
কিচ্ছু করার নাই। তোমার একার জন্য তো আমি সবাইরে বিপদে ফেলতে পারি না।
চোখেমুখে যুগপৎ বিস্ময় আর বিপন্নতা নিয়ে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে জুতিফা। এই তার স্বামী! মাত্র দুদিন আগেও বলেছিল, তোমার মতো বউ পেয়ে আমার জীবন ধন্য। সত্যি জুতিফা, সত্যি তুমি লক্ষ্মী। তুমি আসার পর থেকে আমার ব্যাবসাপাতির উন্নতি হচ্ছে, সংসারের উন্নতি হচ্ছে।
হ, কইছে আপনারে!
সত্যি। কটা দিন যাক, তোমাকে এক জোড়া সোনার দুল বানায়া দিমু।
ওসব আমার দরকার নাই। আপনি ব্যাবসায় মন দেন। বেশি করে টাকা খাটান।
টাকা তো জীবনে কত আসবে-যাবে, তুমি তো আমার একটাই বউ। আমার জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসি তোমাকে। সারাজীবন বুকে ধরে রাখব।
জুতিফার মুখে বাঁকা হাসি ফোটে। বিদ্রুপের হাসি। এই তবে জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসার নমুনা! এই তবে সারাজীবন বুকে ধরে রাখা! সে চোখ ফেরায়। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদে। মোড়াটা নিয়ে মায়ের ঘরে ঢুকে পড়ে মতিন। তার ঘরের দরজায় একটা তালা ঝুলিয়ে দেয় নসুয়া। জুতিফাকে গালাগাল করতে করতে ঘরে ঢুকে ফটাফট দরজা-জানালা বন্ধ করে দেয়।
জুতিফা উঠে দাঁড়ায়। উঠানে এসে বলে, আমার কিছু কাপড়-চোপড় দেন, আমি চলে যাচ্ছি।
ভেতর থেকে নসুয়া বলে ওঠে, খবরদার, কেউ তার কাপড়-চোপড়ে হাত দিবি না। রোগটা ধরে বসবে। এগুলা সব আগুনে পোড়াতে হবে।
জুতিফা আর দাঁড়ায় না। দশটা বেজে গেছে। চৈত্রের রোদ তেঁতে উঠেছে। প্রান্তরের পথ ধরে সে বাপের বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে। ইচ্ছে করেই রাস্তা ধরেনি। গায়ে রাতের বাসি কাপড়, পা দুটি খালি, চুলগুলোও এলোমেলো। লোকে দেখলে নানা কথা বলবে। তার স্বামীর বদনাম হবে, শ্বশুর-শাশুড়ির বদনাম হবে।
কিন্তু বাপের বাড়িতেও কি জুতিফা ঠাঁই পেল? ঘটনা জেনেই তার ভাবীরা নিজ নিজ ঘরে গিয়ে দরজা-জানালা বন্ধ করে দেয়। বড় ভাবী ভেতর থেকে বলে, স্বামীর বাড়ি খাইছে, এখন বাপের বাড়ি খাইব। বড় ভাই উঠানে দাঁড়িয়ে বলে, এই রোগ নিয়া তুই ঐ বাড়ি ছাড়লি ক্যান? তোর জন্য তো এখন আমরাও বিপদে পড়ব। এতগুলা ছেলেমেয়ে নিয়া আমি এখন কই যাব? মেঝ ভাবী বলে, তাকে ফিরে যেতে বলেন ভাই। সে না গেলে আমারাই এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। চুপ শুধু ছোট ভাবী। তার কোনো কথা নেই।
জুতিফা বাবার মুখপানে তাকায়, আমি কোথায় যাব বাবা? তারা তো আমারে বের কইরা দিছে।
আজমত মিয়া চুপ। সে কী করবে? তার তো বয়স হয়েছে। কখন ডাক পড়ে ঠিক নেই। সে তো বেঁচে আছে ছেলে আর ছেলেবউদের করুণায়। তাদের কথার উপর তো সে কথা বলতে পারে না। বউয়ের মৃত্যুর পর কখনো বলেনি। করোনার এই দুর্যোগে বলতে গেলে তো মেয়ের সঙ্গে তাকেও বের করে দেবে।
ঠিক আছে বাবা, আমি গেলাম।
কই যাবি মা?
চোখ যেদিকে যায়।
কিন্তু কোথায় যাবে জুতিফা? বাপের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ি ছাড়া তো এই জগতে যাওয়ার মতো আর জায়গা নেই। জীবনে একবার শুধু উপজেলা সদরে গিয়েছিল। কখনো জেলা সদরে যায়নি। হাতে টাকাও নেই যে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ নেবে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে রাস্তায় উঠল। রাস্তাটা চলে গেছে কালামপুরের দিকে। খানিকটা গেলেই গ্রামের প্রাচীন বটগাছ। বটতলা ছাড়া যাওয়ার মতো আর জায়গা দেখে না সে। জ্বরটা বেড়েছে। গা পুড়ে যাচ্ছে। সারা গায়ে প্রচণ্ড ব্যাথা। শরীরটাকে কোনোরকমে টানতে টানতে সে বটতলায় গেল। একটা শেকড়ে হেলান দিয়ে বসল। মাথাটার ভার বইতে পারছিল না বলে শুয়ে পড়ল।
কখন যে দুপুর গড়িয়ে গেল জুতিফা টের পেল না। হয়ত রাতটাও কেটে যেত, যদি না জলিল মেম্বার তাকে ডেকে তুলত। বোর্ড অফিস থেকে ফিরছিল মেম্বার। চেয়ারম্যান ডেকেছিল। জুতিফাকে মড়ার মতো পড়ে থাকতে দেখে সে ভয় পেয়েছিল। বটতলা তো খল জায়গা। বহু বছর আগে গ্রামের একটা মেয়েকে জিনেরা মেরে এখানে ফেলে রেখেছিল। জুতিফাকে দেখে সেই ঘটনা মনে পড়ে গিয়েছিল তার। ডাক দিতেই জুতিফা চোখ মেলে তাকায়। মেম্বার হাঁফ ছাড়ে।
তুমি আজমত মিয়ার মেয়ে না?
জি। ক্ষীণ কণ্ঠে জবাব দেয় জুতিফা।
এখানে কী করছ?
জুতিফা উঠে বসে। কাঁদে। মেম্বারের ধমকে কান্না থামিয়ে খুলে বলে ঘটনার আদ্যান্ত। মেম্বার খানিকটা ঘাবড়ে যায়। জিন-ভূতের ভয়ে নয়, করোনার ভয়ে। কয়েক পা পিছু হটে দাঁড়ায়। তাকে না আবার ছোঁয়াছে রোগটায় ধরে বসে! সে দ্রুত বাড়ি ফেরার কথা ভাবে। কিন্তু সে গ্রামের মেম্বার, নির্বাচিত জনপ্রতি, তার গ্রামের একটা অসহায় মেয়েকে এভাবে বটতলায় রেখে সে যায় কীভাবে? মনে পড়ে গেল তার মেয়েটার কথা। জেসমিন। মানিকগঞ্জে বিয়ে দিয়েছে। নাতিও হয়েছে একটা। ভালো আছে। সকালে ফোন করে বলেছে, সাবধানে থেকো বাবা। আপাতত কদিন হাটবাজারে যাওয়ার দরকার নাই। ইন্ডিয়ার কথা শোনোনি? দিল্লির এক মসজিদ থেকে তাবলিগের কয়েক শ মুসল্লিকে করোনায় ধরেছে। ঢাকার একটা মসজিদ থেকেও নাকি রোগটা ছড়িয়ে দুজন মারা গেছে। মসজিদটা বন্ধ করে রেখেছে কমিটি।
জুতিফার মুখের দিকে তাকায় মেম্বার। জ্বরে কাঁপছে জুতিফা। পিতৃস্নেহ জাগে মেম্বারের বুকে। মনে হয়, আজমত মিয়ার মেয়ে জুতিফা নয়, বটতলায় বসে আছে তার মেয়ে জেসমিন।
শোনো মা!
জুতিফা মাথা তোলে।
চলো তোমারে ডাক্তারের কাছে নিয়া যাই।
জুতিফা এবার কেঁদে ওঠে।
ফোন করে একটা অটো এনে জলিল মেম্বার তাকে উপজেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে গেল। কালামপুর নিয়ে যেতে পারত। তার মনে হচ্ছিল কালামপুরে ভালো ডাক্তার পাওয়া যাবে না। গেলেও করোনা ভাইরাস টেস্টের কীট পাওয়া যাবে না। তখন সাড়ে তিনটা। হাসপাতালে বিস্তর রোগী। ডাক্তার মাত্র দুজন। বাকিরা নাকি ছুটিতে। লাইনে অপেক্ষা ছাড়া উপায় নেই। খিদায় মেম্বারের পেটটা জ¦লছে। কিন্তু এখন কি হোটেল খোলা আছে? মনে হয় না। জুতিফাকে একটা টুলে বসিয়ে সে বাজারে গেল। দোকানপাট বন্ধ। কাঁচাবাজারে একটা হোটেল খোলা ছিল। একটা ডিম আর সবজি দিয়ে এক প্লেট ভাত খেল। জুতিফার জন্য কলা-পাউরুটি নিয়ে ফিরল। কিন্তু জুতিফা খাবে না। খেতে ইচ্ছে করছে না।
প্রায় পৌনে পাঁচটায় জুতিফার ডাক পড়ে। ডাক্তারের গায়ে পিপিই। একান্তই জরুরি না হলে রোগীদের কাছে ঘেঁষছেন না। জুতিফার চোখমুখ দেখেই বুঝি রোগটা ধরে ফেললেন। জ¦রটা মেপে দেখলেন। প্রেশারটাও। তারপর চেয়ারে গিয়ে বসে বললেন, জ¦র কোনো রোগ নয়, রোগের উপসর্গ মাত্র। তার পেটে গণ্ডগোল , গ্যাস্ট্রিকের প্রবলেম। ওষুধ লিখে দিচ্ছি, আশা করি সলভ্ হয়ে যাবে। করোনার টেস্ট দরকার নাই।
ডাক্তারের কথা বিশ্বাস করল মেম্বার। অটোতে ওঠানোর সময় জুতিফাক ধরেনি, নামানোর সময়ও না। এখন তার হাতটা ধরতে আর ভয় করল না। ধরে ডিসপেন্সারিতে নিয়ে গেল। ওষুধপত্র নিয়ে একটা অটো ভাড়া করে সোজা বাড়ি চলে গেল। ভেবেছিল আজমতের বাড়ি গিয়ে সবাইকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে জুতিফাকে রেখে আসবে। গেল না। তার এত বড় ঘর। পাঁচটা কামরা। বউকে নিয়ে সে এক কামরায় থাকে, উত্তরের কামরাটায় ছেলে। বাকি তিন কামরা খালি পড়ে থাকে। কটা দিন জুতিফা তার কাছে থাকুক। সুস্থ হলে নিশ্চয়ই তার আত্মীয়-স্বজনদের ভুল ভাঙবে। নিশ্চয়ই তারা তাকে নিতে আসবে।
রাতে জুতিফার জ্বরটা ছেড়ে দিল। পরদিন পেটটাও হালকা হয়ে এলো। হাঁচি-কাশি আর গলাব্যাথাও উধাও। তৃতীয় দিন পুরোপুরি সুস্থ। জলিল মেম্বারকে সে কদমবুচি করে বলে, আপনি না থাকলে আমার কী যে হতো বাবা!
বাবা! মেম্বারের বুঝি আবার জেসমিনের কথা মনে পড়ে যায়। জুতিফার মাথায় হাত রেখে বলে, মানুষের বিপদে মানুষকেই তো দাঁড়াতে হয়, মা।
সেদিন সকাল থেকে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। দুপুরে খেয়েদেয়ে সোফায় বসে মেম্বারের বউসহ টিভি দেখছিল জুতিফা। খবরে বলছে, সরকারি ছুটি বাড়ানো হয়েছে। মানুষজনকে অকারণে রাস্তাঘাটে বের না হতে সতর্ক করছে। সারা পৃথিবীতে করোনা ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা পঞ্চাশ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আক্রান্তের সংখ্যা দশ লাখের বেশি। বাংলাদেশে মোট আক্রান্ত সত্তরজন। মারা গেছে আটজন। পৃথিবীর দেশে দেশে লকডাউন চলছে। মক্কা-মদিনায় কারফিউ দিয়েছে।
তখন ভেতরে ঢুকল জলিল মেম্বার। জুতিফা উঠে একপাশে সরে দাঁড়াল। মেম্বার বলে, মতিন এসেছে তোকে নিতে। আমি অনেক বকেছি। যা মা, তার ভুল ভেঙেছে।
জুতিফা মাথা নোয়ায়।
আরো কটা দিন থাকবি?
জুতিফা বলে, না।
তাকে আসতে বলবো? এখন যাবি?
জুতিফা এবার মাথা তোলে। মেম্বারের মুখের দিকে তাকায়। কাঁদছে। দু-গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। মাথাটা ডানে-বাঁয়ে নাড়াতে নাড়াতে বলে, কখনোই না।