চিঠি/৫৩
০৩/১১/২০১৯ খ্রিঃ
|| #মনির_জামান ||
কাদিরাবাদ, নাটোর।
দোলন,
বেশ ক’দিন যায় তোমাকে লেখা হয় না। হেমন্তের এই জোছনায় তোমাকে খুব মনে পড়ছে। মনে পড়ছে গাঁয়ের প্রিয় নিসর্গ আর প্রিয় মানুষের মুখগুলোকে। দূরে থাকি মন পড়ে থাকে তোমাদের দিকে। ক’দিন আগে তোমার লেখা কবি ও কবিতা সংক্রান্ত একটা পোস্ট পড়লাম ফেসবুকে। হয়তো তোমার কোনো বিষয়ে মন খারাপ।
কিন্তু এখানে মন খারাপের কিছুই নেই, সাহিত্যে সমালোচনা খুব স্বাভাবিক তাই বলে থেমে গেলে তো হেরে গেলে।
বেশ ক’বছর আগে আমি আর কবি জাকির হোসেন ভাই একবার ঢাকা গিয়েছিলাম_ তখন দারিদ্রতার সাথে ভীষণ এক যুদ্ধ চলছিল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন আমার ছাত্রত্ব ধরে রাখাই দায়! কিন্তু কবিতার টানে তখনও ঘুরে বেড়াতাম দিগ্বিদিক। তো সেদিন আমরা দু’জন কবিতাপ্রাণ দুপুরের দিকে গেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গিয়াসউদ্দিন আবাসিকে সেখানে থাকতেন ডঃ মোহাম্মদ এন্তাজ উদ্দিন, ওনার পৈত্রিক নিবাস মূলত নাটোরের গুরুদাসপুরে। উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি রেজিস্ট্রার ছিলেন, ছিলেন লালন নজরুল গবেষক, কথা হলো বিভিন্ন বিষয়ে, এক পর্যায়ে কবিতার কথা উঠতেই তিনি বললেন, “আজকাল কবিতার ডিমান্ড খুব কম।” কথাটা মনে লাগলো আজকের দিনে গদ্যের ভিড়ে কবিতা ম্লান।
তোমার মনে আছে কিনা গল্পটা হয়তো তোমাকেও শুনিয়েছি। ওনার “মরমিবাদের মহান দ্রষ্টা কাজি নজরুল ইসলাম” বইটি নিঃশ্চয়ই এখনও তোমার সংগ্রহেই আছে। অনেকদিন পর পুরনো বইপুস্তক ঘাটতে গিয়ে ওনার কিছু বই হাতে উঠে এলো, সাথে বইয়ের ভাজে আমার একটা কবিতাও। ভাবছি, সেসব বইয়ের পুরোটা জুড়ে পক্ষান্তরে মহাত্মা লালন নজরুলের বাণীরই ভাবের সম্প্রসারণ ঘটেছে আর আমার কবিতায় আমার শব্দ, আমার ভাব, অক্ষরগুলো যেন আমার কথাই বলছে।
কবিতার মজা এখানেই, কবিতার কোনো সঙ্গা নেই, তোমার ডান-বাম, অগ্র-পশ্চাত, তোমার দুঃখ, তোমার ভালোবাসা, তুমি যা ভাবছো তার সবই কবিতা।
কবিতার প্রশ্নে বিতর্কে জড়াবে না। যার যা খুশি বলুক, লিখুক। এখন তো ভায়ের সমালোচনা ভাই করে। বিদ্রূপগুলো তুলে রাখো, সময় বলে দেবে থাকা না থাকার বিষয়।
অল্প কথার কত প্রবাদ কবিতার মতো ছন্দে ছন্দে যুগ যুগ ধ’রে বাস্তবতাকে ধারণ করছে। মুখে মুখে রচিত এসব কবিতার কবির নাম কে জানে? তোমার উচিতকর্মটি তোমাকেই নির্ধারণ করতে হবে। এ বিষয়ে তোমাকে অন্যের চে’ একটু আলাদা করেই ভাবতে হবে। মাতাল না হলে কোনো কিছুই মেলে না। এ বিষয়ে একটা উদাহরণ দিতেই হয়_
‘কবিতা’ পত্রিকার বিংশ বর্ষের একটি সংখ্যায় কবি বিষ্ণু দে শার্ল বোদলেয়ারের “মাতাল হও” কবিতার অসামান্য একটি তরজমা করেছিলেন_
তার প্রথমাংশ এরকম_
“সব সময় মাতাল হতে হবে।
ওতেই সব : ঐ একমাত্র বিবেচ্য।
যদি বোধ করতে না চাও মহাকালের ভয়ানক ভার
যাতে তোমার ঘাড় ভেঙে যায়
আর তুমি বেঁকে পড়ো মাটির দিকে
তবে তোমাকে মাতাল হ’তে হবে অবিরাম।
কিন্তু কিসে?
মদে, কবিতায়, সৎকার্যে, তোমার যা রুচি।
কিন্তু মাতাল হও।”
কবিতার জন্য অনেক কিছুই ভুলে যেতে হয়, অহেতুক আড্ডা, ঝোঁক আরো কত কী!
যে উত্তাপ তুমি সইতে পারছো তা দেখে নানা জনে নানা কথা বলবেই সেদিকে নজর দিলে তোমার চলবে কী!
কবিতা বিষয়ে ঈশ্বর গুপ্তের ক’টা চরণ মনে পড়ল_
“কবিতা কি গাছে ফলে
নাকি বেঁচে বণিক দলে
যার ভাগ্যে ফলে
সেই পায় দৈব বলে।”
আবার শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখলেন, “পা থাকলে কয়েক ক্রোশ হেঁটে আসা যায় কিন্তু হাত থাকলেই দু’কলম লেখা যায় না।”
যেহেতু এ ক্ষমতা তুমি কারো কাছ থেকে পাওনি সেহেতু কারো সমালোচনায়ও বিচলিত হয়ো না।
কবিতায় তুমি গাছ আঁকো, পাখি, পাহাড়, ঝরণা, নদী, জোছনা, খুব কাছে পেয়েও হারানো তাঁর মুখ সব, সব আঁকো আর এ অঙ্কণ যন্ত্রণা হৃদপিণ্ডের শেষ স্পন্দন পর্যন্ত চলতে থাকুক।
আমার কথা তোমায় কেউ জিজ্ঞাসা করে কি? আহা আব্বাস ভাইয়ের হাতের চা কত দিন হয় পান করি না। জাকির ভাইয়ের শরীর কেমন? দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর চাকরী তো হল, বয়স বাড়ছে, বিপ্লবকে এখন বিয়ে করতে বলো। প্রিয়জনদের খবর দিও। পারলে বেড়াতে এসো, খেঁজুরের নতুন রস উঠছে_
সবশেষ, কবি বুদ্ধদেব বসুর একটি কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করছি,
“বাকি থাকে কবিতা- অস্তিত্বময় অণুর বন্ধন,
হ্লাদিনী, ব্যধির বীজ, উন্মাদক, নিষ্ঠুর, অসুখী
স্বরস্বতী, ভেনাস, ক্ষণিক লক্ষ্মী, বাসুকি-
মেটাতে আমার তৃষ্ণা আমারেই সে করে মন্থন!
ভালো- কিন্তু বলো দেখি, হতে হবে আর কতকাল
একাধারে দ্রাক্ষাপুঞ্জ, বকযন্ত্র, শুঁড়ি ও মাতাল।”
সদা ভালো থাকার শুভ কামনা রইল।
ইতি
মনির জামান
★