মামুনুর রশিদ মাহাতাব : অপরিকল্পিতভাবে স্লুইসগেট নির্মাণে নদ নদী সরু নালায় পরিনত হয়েছে। গ্রীষ্মে থাকে তৃষ্ণায় কাতর বর্ষাতেও তৃষ্ণা মেটেনা। স্লুইসগেট নির্মাণের পরবর্তীতে বর্ষা মৌসুমে বন্যার স্রোতহীন সীমিত পলিমিশ্রিত পানি নদ নদীতে প্রবেশ করায় ক্রমান্বয়ে নদ-নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে।
শুস্ক মৌসুমে পানিশূন্য নদ-নদীর বক্ষ পিপাসায় আর্তনাদ করে। বর্ষা মৌসুমেও বন্যার পানিতে তৃষ্ণা মেটাতে প্রয়োজনীয় পানির ছোঁয়া পায়না। সরকারি উদ্যোগে মুসাখাঁ ও নারোদ নদ সংস্কার করা হলেও তেমন সাফল্য আসেনি।
জানাযায়, বড়াল পদ্মার শাখা নদী। রাজশাহীর চারঘাট পদ্মা বড়ালের উৎপত্তিস্থল । চারঘাট পদ্মা থেকে বড়াল বেরিয়ে আঁকা-বাকা পথে বাঘা, নাটোরের বাগাতিপাড়া, বড়াইগ্রাম উপজেলার মধ্য দিয়ে পাবনা জেলা পেরিয়ে সিরাজগঞ্জে যমুনায় মিলিত হয়েছে।
অপরদিকে মুসাখাঁ বাগাতিপাড়ার জামনগর পুলিশ ফাঁড়ি সংলগ্ন ত্রিমোহনীয়া নামক স্থানে বড়াল থেকে বেরিয়ে আঁকা-বাঁকা পথে হাপানিয়া, উমরগাড়ি, জাগিরপাড়া, করমদোশি জয়রামপুর,পীরগাছা, ঝলমলিয়া, মধূখালির মধ্যদিয়ে মাঠঘাট পেরিয়ে নলডাঙ্গায় আত্রাই নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
নারদ নদ রাজশাহীর চারঘাটের মুক্তারপুর বালুঘাট এলাকার পদ্মা থেকে বেরিয়ে আঁকা-বাকা পথে বিভিন্ন গ্রাম পেরিয়ে পুঠিয়ার পীরগাছা শ্মশান ঘাট সংলগ্ন মূসাখাঁ নদীর মধ্য দিয়ে পেরিয়ে নাটোর সদর উপজেলার পাইকপাড়া, কাফুরিয়া বারঘরিয়া, দস্তানাবাদ, জালালাবাদ ডিঙ্গিয়ে নাটোর শহরের পাশ দিয়ে মাঠঘাট পেরিয়ে বড়াইগ্রামে চলনবিলে মিলিত হয়েছে।
কয়েক যুগ আগেও বড়াল, মুসাখাঁ ও নারোদ নদের টইটুম্বর যৌবন ছিল। বর্ষা মৌসুমে নদীগুলো বন্যার পানিতে কানায় কানায় পূর্ণহতো। স্রোত ছিল প্রখর। সে সময় বন্যার পলিমিশ্রিত পানি দূ’কূল ঝাঁপিয়ে বিভিন্ন মাঠে প্রবেশ করত। পলিমিশ্রিত পানিতে কৃষি আবাদযোগ্য জমির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি পেতো।
কৃষকরা দ্বিগুন ফসল ফলাত। সারা বছর স্বাচ্ছন্দে সংসার চলতো। নদীতে ছোট-বড় প্রচুর মাছ ছিল। জেলেরা মনের আনন্দে ছোট বড় মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালাতো।
কিশোর -কিশোরীরা মনের আনন্দে নদীতে সাঁতার কাটতো। মালামাল বোঝাই ছোট-বড় অসংখ্য পালতোলা নৌকা দূর-দূরান্তে যাতায়াত করতো।
বর্তমান নদীগুলোর করুন দশা। এগুলো ক্রমান্বয়ে সরু নালায় পরিনত হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে পানিশূন্য নদীগুলোর বক্ষ তৃষ্ণায় কাতরাতে থাকে। নদীর তলদেশ গোচারণ ভুমিতে পরিনত হয়। কোন কোন জায়গা ক্রিকেট ও ফুটবল খেলার মাঠে পরিনত হয়। নদীর তলদেশ সবুজ ফসলের মাঠ।
বর্ষা মৌসুমেও প্রয়োজনীয় পানির দেখা মেলে না। বর্ষা মৌসুমে বড়ালের বন্যার পানি বড়াল চর ডিঙ্গাতেও ব্যর্থ হয়। অপরদিকে যৌবন হারা বড়াল নদী বর্ষা মৌসুমেও তার শাখা নদী মূসাখাঁ’র বুক পানিপূর্ণ করতে পারে না। বন্যার সামান্য পানি প্রবেশ করলেও শেষ প্রান্ত পর্যন্ত পৌছায় না।
২০১১ সালে মুসাখাঁ’র উৎপত্তিস্থল থেকে পীরগাছার শ্মশানঘাট পর্যন্ত সাড়ে ছয় কিলোমিটার নদীর তলদেশ সংস্কার করা হয়। এতে সরকারের ৯৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু তেমন সুফল আসেনি। নারদ নদেরও একই দশা।
চারঘাট মুক্তারপুর এলাকার পদ্মা থেকে উৎপত্তি নারদ নদ বহুদিন আগেই বন্যার পানির আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছে। বর্ষা মৌসুমেও নারদ নদের সিংহভাগ অংশ বন্যার পানির ছোঁয়া পায়না।
কথিত আছে, এককালে নারদ নদের টইটুম্বর যৌবন ছিল। সেসময় পুঠিয়া ও নাটোরের রাজ-রাজারা এ নদী পথেই নৌকাযোগে আনন্দে যাতায়াত করত। নারদ নদে জেলেরা মনের আনন্দে ছোট-বড় মাছ ধরতো।
স্বাচ্ছন্দ্যে সংসার চলতো। বর্তমান প্রজন্মের কাছে নারদ নদের ইতিহাস রূপকথার গল্পে পরিনত হয়েছে। নারোদ নদ ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে সোয়া ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে পুনঃখনন করেও তেমন সুফল আসেনি।
পুঠিয়ার পীরগাছা এলাকার জেলে সম্প্রদায়ের গোবিন্দ চন্দ্র জানান, জাল যার জলা তার। কিন্তু নদীতে জলই নেই, জাল ফেলবে কোথায়? বাগাতিপাড়া সরকারি কলেজের প্রভাষক মুন্জুরুল ইসলাম লিটন বলেন, কালের আর্বতে ও নদ-নদীর উপর স্লুইসগেট নির্মাণের কারণে নদ-নদীতে খোলাভাবে পানি প্রবেশ করতে পারে না।
বর্ষামৌসুমে বন্যার স্রোতহীন পলিমিশ্রিত সীমিত পানি নদ-নদীতে প্রবেশ করে। নদ-নদীগুলোর তলদেশ পলিমাটিতে ভরাট হয়ে যাওয়ায় নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে। বর্তমান সরকার সংস্কারের মাধ্যমে নদ-নদীগুলোর ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট রয়েছেন ।