পুলিশ কখনো মিথ্যা বলে না। – অতীশ পাল
সরকারী ভাবে জানা যায় আমাদের এক বন্ধু শচীন ঘোষাল ২০১০ সালের ২৯শে জুন কলকাতা থেকে মাওবাদী সন্দেহে গ্রেফতার হয়েছে। যদিও শচীন বলে ওকে পুলিশ ধরেছিল চারদিন আগে ২৫ তারিখ। কিন্তু পুলিশ তো মিথ্যা বলেনা তাই আমরা জানি ২৯। যে সময় শচীনকে পুলিশ ধরেছিল তখন তার কাছে নাকি ছিল ডিটোনেটর, আগ্নেয় অস্ত্র, গোটা ষাটেক বই, যেগুলো সঙ্গে রখতে গেলে বস্তায় ভোরে মাথায় চাপিয়ে ঘুরতে হয়। পুলিশ যেহেতু মিথ্যা বলেনা তাই আমরা সবাই বিশ্বাস করেছি শচীন ধরা পড়ার জন্য বইয়ের বস্তা মাথায় করে পকেটে পিস্তল আর ডিটোনেটর নিয়ে কলকাতার রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এর অবশ্য একজন জোরালো সাক্ষীও ছিল তিনি একজন ভিখারি যার ঠিকানা বাগনান রেল স্টেশন।
এত কিছু প্রমাণ থাকা সত্বেও ২০১০ থেকে ২০২০ এই দশ বছরে পুলিশ মহামান্য আদালতের কাছে এখনো প্রমাণ করতে পারেনি শচীন দোষী। কোর্ট এখনো কোন রায় দিতে পারেনি। হাজতে পুলিশ নাকি অকথ্য অত্যাচার করেছে এমনকি ওর পেনিশটাকে থেঁতলে দিয়েছে। এটা অবশ্য আমরা বিশ্বাস করিনি কারণ এটা মাওবাদী সন্দেহে গ্রেফতার হওয়া শচীনের কথা। আমরা জানি পুলিশ কখনো এরকম করে না।পুলিশ মিথ্যা বলেনা।
পুলিশ মিথ্যা বলেনা আর আদালত কোন নির্দোষীকে শাস্তি দেয়না, তাই শচীনের পরিবার বা আমরা অপেক্ষায় থেকেছি কবে শচীন ছাড়া পাবে বা তার সাজা হবে। ইতিমধ্যে শচীনের মেয়েটা ক্লাস ফাইভ থেকে কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী, শচীনের বউকে সেলাই করে পরিবারের ভরনপোষণ আর মেয়ের পড়াশোনার খরচ যোগাতে হয়েছে। এটাও আমাদের মেনে নিতে হয়েছে কারণ পুলিশ যাকে মাওবাদী বলে ধরেছে তার বউ – মেয়ের পরিণতি এর চেয়ে ভাল হতে পারে না। কৈশোরে বাবাকে হারানো শচীনের এক অবিবাহিত কাকা ছিলেন, শচীনের বউ – মেয়ের মাথার উপর। তিনিও চলে গেলেন কয়েক দিন আগে গত ৮ই জানুয়ারীর রাতে। পরের দিনই পুলিশকে জানানো হয়েছিল, জানানো হয়েছিল আদালতকে এ অবস্থায় শচীনকে কয়েকদিনের জন্য প্যারোলে ছেড়ে দিতে, যাতে এ-সময় শচীন কটা দিন পরিবারের পাশে থাকতে পারে।এরকম তো কতই হয়।
গত ১৪ই জানুয়ারী শচীনের কেস ছিল আদালতে। শুনেছি সেদিন উকিল বিচারক কাবেরী বসুর কাছে আবেদন জানায় এবং বিচারক শচীনের তিন দিনের প্যারোলে মুক্তি মঞ্জুর করে। তখনই নাকি পুলিশ এর বিরোধিতা করে, তিনদিনের পরিবর্তে একদিনের প্যারোলের আবেদন জানায় যদিও বিচারক তিনদিনের প্যারোলই বজায় রাখেন। কোন এক অজ্ঞাত কারণে তিনদিনের দুদিন ইতিমধ্যেই চলে গেছে শচীন কিন্তু বাড়ি আসেনি। আমাদের আয়ত্বে থাকা সব স্তরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি মেদিনীপুর জেলে নাকি প্যারোলের অর্ডারটাই এখনো পৌঁছায় নি। আসলে এখানে এত নাকি,এত যদি থেকে গেছে যে আমরা বুঝতেই পারছি না গাফিলতিটা কার বা কাদের। আমাদের শহরে কত মানবাধিকার কর্মী কত বন্দী মুক্তি কমিটির নেতা আছেন যারা টিভির পর্দায় বসে কত আইন কানুনের কথা বলেন, খবরের কাগজে কত বিবৃতি দেন তাদের বারে বারে জানানো সত্বেও কিছু করে উঠতে পারলন না তাঁরা। শচীনের মেয়েটা কয়েক ঘন্টা বাবার সঙ্গ পাবে বলে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল তার স্বপ্নটা ভেঙে গেল। আমরা জানি মাওবাদীর মেয়ের স্বপ্ন এভাবেই ভেঙে যায়।
ওই সরল মেয়েটা জানেনা চোর ডাকাত, খুনি, ধর্ষকের চেয়েও ওর বাবার অপরাধ অনেক বেশি কারণ ওর বাবা সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখে, ওর বাবা গরীবের কথা ভাবে। এখানও আমরা জানি পুলিশ মিথ্য বলেনি,মিথ্যা বলতে পারেনা সত্যি সত্যি পুলিশের কাছে শচীনের তিনদিনের প্যারোলে ছাড়া পাওয়ার কাগজ পৌঁছায়নি সে কাগজ পাঠায়নি কমিশনার সে-তো আর পুলিশ নয়। শেষ পর্যন্ত জানা যায় আধুনিক ডিজিটাল যুগেও ১৪ তারিখের ইমেল পৌঁচেছে ১৮ তারিখ বিকেল গড়িয়ে, যখন কিনা কোর্টের অর্ডার সত্বেও দুটো দিন হারিয়ে গেছে। APDR এর মাধ্যমে সকালে যখন পুলিশ কমিশনারকে ফোন করা হয় তিনি ফোন ধরেন নি।পরে ডেপুটি কমিশনারের সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব হলে জানা যায় সেদিন শনিবার তাই কোন ফোন কমিশনার রিসিভ করেন না এবং সেটাই নাকি নিয়ম।
ডেপুটি কমিশনার জানান তিনি জানেন না প্যারোলে মুক্তি মেলা শচীনের ইমেলটি কেন মেদিনীপুর জেলে পৌঁছাল না। পরে অবশ্য সেখান থেকেই খোঁজ মেলে ইমেলটি ভুল করে চলে গেছে উলুবেড়িয়া থানায়। ভাবুন একবার যে দেশে ভোর রাতে রাষ্ট্রপতি কাগজে সই করে সরকার গড়ে সে দেশেই সাধারণ এক রাজ্যের পুলিশ প্রধান শনিবারে অজুহাতে ফোন ধরে না। পুলিশের দ্বিতীয় প্রধান জানে না ইমেলের খবর। যেখানে একটি ইমেল একইসঙ্গে হাজার যায়গায় করা যায় সেই ইমেল নিখোঁজ হয়ে পড়ে থাকে সম্পর্ক হীন অন্য কোন থানায়। শচীন বন্দী আছে আপাতত মেদিনীপুর জেলে, তার বাড়ি হাওড়ার বাগনানে , বাড়ির পাশেই থানা। কোন ভাবেই উলুবেড়িয়া থানার সঙ্গে এঘটনার সম্পর্ক নেই তবুও এত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইমেল চারদিন নিখোঁজ হয়ে পড়ে থাকলো সেখানে। এটা কি বাস্তবত ভুল করে ঘটা সম্ভব? যদি না কোন উপর মহলের মদত থাকে? শেষ পর্যন্ত শচীন মাত্র একদিনের প্যারোল নিতে অস্বীকার করে।
আমরা জানি ১৪ই জানুয়ারি যখন বিচারক কাবেরী বসু তিনদিনের প্যারোল মঞ্জুর করেন তখনই সরকার পক্ষের উকিল বিরোধিতা করে একদিনের প্রস্তাব রেখেছিলেন, তাই সরকার পক্ষ সেই সিদ্ধান্তে অনড় থাকলো তাতে আদালত অবমাননা হলেই বা কী? তারা তো রাষ্ট্রপক্ষ সুতরাং তাদের সাতখুন মাফ। জানি আমাদের দেশে আদালত অবমাননা করার ঘটনা অজস্র, আর সে অবমাননার জন্য কারো কোন শাস্তি হয়েছে বলে আজ পর্যন্ত শুনিনি।
এর পরেও আমাদের বলতে হবে মহামান্য আদালত, এরপরেও এই বিচার ব্যবস্থার উপর এই পুলিশের উপর আমাদের নাকি আস্থা রাখতেই হবে। না হলে আপনি দেশদ্রোহী। যেভাবে শচীনেরা আজ দেশদ্রোহী। যে দেশে চোর-ডাকাত, চোরাকারবারি, খুনী, ধর্ষকদের যারা সহজেই জামিন দেয়, যারা শচীনের বাচ্চা মেয়েটার কয়েক ঘন্টা বাবার সঙ্গ পাওয়ার স্বপ্ন কেড়ে নেয় ছল করে, তারা দেশপ্রেমিক। আর যারা আইনের আশ্রয় নিয়ে তিনদিনের জায়গায় একদিন কেন? সেই প্রশ্ন তুলে বুকের হাজার কষ্ট চেপে রেখে শিরদাঁড়া সোজা করে সেই একদিনটা কে নিতে অস্বীকার করে তারাই দেশদ্রোহী। এ কারণেই রাষ্ট্র বোধহয় এদের ভয় করে।
বি:দ্র: নাটোরকন্ঠে মুক্তমত শাখার সকল লেখাই লেখকের একান্ত নিজের মত। এর জন্য নাটোরকন্ঠ কোনভাবেই দায়বদ্ধ নয়। লেখাটি সরবরাহ করেছেন-সৌমিক ডি মজুমদার, (ফেসবুক)