বরগুনা পুলিস সুপার ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে একদিন- ভায়লেট হালদার
বরিশাল বিভাগের একটি জেলার নাম বরগুনা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৯নং সেক্টরের দুইটি সাব সেক্টরের একটির নাম বরগুনা। এই শহরটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে যতটা আলোচিত ও সমাদৃত তার চেয়েও বেশী সমালোচিত-আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ড ঘিরে। সবচেয়ে বেশী যে নাম মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়েছে তাদের নাম নয়ন বন্ড, মিন্নিসহ অন্যান্যরা। দুঃখের বিষয় এটাই, এই শহরে যতজন লোক মিন্নি, নয়ন বন্ড গংদের নিয়ে যতটুকু সময় ব্যয় করেছে তার থেকে সিকিভাগ সময়ও ব্যয় করেনি তাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস জানতে।
বরিশাল থেকে আমি ও বন্ধু সুশান্ত ঘোষ (সাংবাদিক ডেইলি স্টার) আজ ব্যাক্তিগত সফরে বরগুনা গিয়েছিলাম। প্রথমেই দেখা হলো রোকেয়া আপার সঙ্গে। তিনি আমাদের সাদরে সম্ভাষণ জানালেন। আপার সঙ্গে ছিলেন তার পরিবারের আরও কয়েকজন সদস্য। এরপরে আমরা সবাই সেখানকার পুলিস সুপারের কার্যালয়ে গেলাম, গেট দিয়ে ঢুকতে বাম পাশে চোখ আটকে গেল, সবুজ জমিনে লাল পাড়ের শাড়িতে মায়ের কোলে শিশু ভাস্কর্য দেখে। কয়েক মুহূর্ত অপলক চেয়ে রইলাম ভাস্কর্যটির দিকে। মুহূর্তেই মন ভরে গেল। অদ্ভুত রকমের ভাললাগায় যেন সতেজতা অনুভব করছিলাম। মনের ভেতরে ছোটবেলার কিছু দৃশ্য আমার চোখের সামনে এসে দাঁড়াল। সে সময়কার মা, খালা, ফুপু, কাকীর পরনে থাকতো একরঙা জমিনে লাল পাড়ের শাড়ী। শহরের নারীরা শাড়ী পরে দৈনন্দিন গৃহস্থালির কাজকর্ম করে এমন দৃশ্য সচারাচর চোখে পড়ে না। শাড়ী পরা নারীর সংখ্যা দিন দিন কমছে। এ দেশে এখন ভিনদেশের সংস্কৃতির পোশাকে আবৃত করে চলাফেরা করে বেশীরভাগ নারীরা। শাড়িতে বুঝি আর নারীকে মানায় না ভারী!? শাড়ীর আঁচলে ঢাকা ঘোমটা মাথায় মা-খালাদের দেখা যায় না। বাহারী রঙের স্কার্ফ ও ওড়নায় ঢাকা মাথাগুলো প্রদর্শিত হচ্ছে। মনে মনে ভাবি, মাথাগুলো আকারে বেড়েছে নাকি শাড়ীর আঁচল ছোট হয়ে গেছে!? অদুর ভবিষ্যতে এদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শাড়ীর দেখতে যাদুঘরে যাবে।
হেঁটে হেঁটে কার্যালয়ের ভেতরে প্রবেশ করলাম। হাতের ডানপাশেই চোখে পড়ল মহান মুক্তিযুদ্ধের বীরশ্রেষ্ঠদের সিরামিকের ম্যুরাল। অনেকটা সময় আমরা সেখানে দাঁড়ালাম, শ্রদ্ধার সাথে সেইসব বীরদের স্মরণ করলাম। এরপরে দোতালায় উঠে প্রবেশ করলাম পুলিশ সুপার জনাব মারুফ হোসেন (পিপিএম) এর রুমে। সৌজন্য সাক্ষাৎ এ সাধারণ আলোচনা ও চা পর্ব শেষ করে এলাম শিল্পকলা একাডেমীতে। সেখানে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন দৈনিক সংবাদের সিনিয়র সাংবাদিক চিত্ত্ব রঞ্জন শীল দাদা। তিনি আমাদের সঙ্গে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন। শিল্পকলা একাডেমী ভবনের নীচতলায় মুক্তিযুদ্ধের যাদুঘর। অত্যন্ত চাকচিক্য না হলেও খুব ছোট পরিসরে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর নির্মাণ করা হয়েছে। আমরা সবাই মিলে ছবিগুলো দেখলাম, আরও দেখলাম দুইটি ভাঙা টিনের টুকরো, মুক্তিযুদ্ধের সময় ট্রেনিং এ ব্যবহৃত রাইফেল, ক্ষয়ে যাওয়া ঘরের খুঁটি, মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত পোশাক, ছিঁড়ে যাওয়া একজোড়া বুটজুতা, কয়েক খণ্ড পাথর ও একটি পাঁচ কেজি ওজনের তালা। এই তালাটি নাকি মুক্তিযুদ্ধের সময় খাদ্য মজুদ করা গুদামে ব্যবহার করা হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর থেকে বেরিয়ে এলাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে। উদ্দেশ্য জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ। চিত্তরঞ্জন”দা আমাদের নিয়ে এলেন। বর্তমান জেলা প্রশাসক জনাব মোস্তাইন বিল্লাহ আমাদের বসতে বললেন। গল্প প্রসংগে জানতে পারলাম তিনি মাগুরার একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। শ্রদ্ধার সাথে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে স্মরণ করে তিনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষার কথা বলেছেন। বরগুনার স্কুলের শিক্ষার্থীরা যাতে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে পারে সেই লক্ষ্যে তিনি কাজ করছেন। জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে এবং জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ব্যক্তিগত অর্থায়নে ৫০জন স্কুল শিক্ষার্থীদের গোপালগঞ্জের টুংগীপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য পাঠিয়েছেন । এছাড়াও প্রশাসনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিজ অর্থায়নে জেলা প্রশাসনিক ভবনের ছাদের করেছেন ছাদ বাগান। এখানেও চা পর্ব শেষ করে আসি অফিসার্স ক্লাব ক্যাফেটেরিয়াতে। মধ্যাহ্ন ভোজন শেষে বরিশালের উদ্দেশ্যে বিদায় নেই বরগুনা থেকে।
আসার সময় পুরোটা পথে ভাবি, কেন সমগ্র বাংলাদেশের চিত্র এরকম নয়? কেন প্রতিটি শহর থেকে গ্রাম তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে বদ্ধ পরিকর নয়? কারো আদেশ না নির্দেশে নয়। নিজের ভেতরের বোধের উপলব্ধি থেকে প্রতিটি মানুষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে। নতুন প্রজন্মকে গর্বের সহিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে চিনিয়ে দিতে হবে। একটি সুন্দর বাংলাদেশের জন্য আমাদের গর্বের ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষায় সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। যারা শ্রম ও সময় দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস রক্ষায় কাজ করছেন এবং মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর সমৃদ্ধ করে চলেছেন তাদের প্রচেষ্টা সার্থক হোক।