মরীচিকা
ভৌতিক গল্প পর্ব-১৫
শাপলা জাকিয়া : প্রকাশ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রবল আতংক নিয়ে বললো,
-এ হতে পারেনা। রূপালী মারা গেছে। তুমি রূপালী হতে পারো না। তুমি মেঘলা।
আমি বললাম,
-প্রমাণ দেই? রূপালী কিভাবে মারা গেছে বলবো? সুইসাইড করে, এই ঘরের সিলিং ফ্যানের সাথে ফাঁস দিয়েছিল রূপালী। ওর জিভ বের করা লাশটা ইলেকট্রিক করাত দিয়ে কেটে, সুটকেসে ভরে, এই বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলে তুমি। ঠিক বলছি?
প্রকাশ গলায় খুব চেষ্টা করে জোর এনে বললো,
-কে বলেছে তোমাকে এসব মিথ্যা কথা? তুমি আমাকে ব্ল্যাকমেইল করতে চাও?
আমি জবাবে সজোরে চড় কষালাম ওর গালে।
প্রকাশ আর্তনাদ করে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো,
-কতোটাকা চাও বলো?
-টাকা চাই না। মহিমের খবর দাও। মহিম কোথায়?
-ম..মহিম মারা গেছে।
-কবে?
-দুই বছর আগে।
-কিভাবে?
-জানিনা।
আমি এবার আরেকটা লাথি কষালাম। প্রকাশ তবু মুখ খুললো না। কেবল আহ, উহ করে চলেছে। মাথাটা খারাপ হয়ে গেলো। বেড সাইড টেবিলের ওপর রাখা কাঁচের ফুলদানিটা দেয়ালে বাড়ি দিয়ে ভেঙ্গে মাথাটা ধারালো করে নিলাম। আর একবার জিজ্ঞেস করবো, যদি উত্তর না দেয়, পেট বরাবর ঢুকিয়ে দেবো। তাতেও যদি না মরে ঘাড়টা মটকে দেবো। বললাম,
শেষবার জিজ্ঞেস করছি,
– মহিম কিভাবে মারা গেছে?
প্রকাশ যথেষ্ট মনের জোর দেখাচ্ছে। অপরাধীদের ভয়-ডর আসলেই কম থাকে। প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মেঝেতে বসা অবস্থায় ঘষটে ঘষটে পিছু হটছে। হঠাৎ হাতের নাগালের মধ্যে পাওয়া একটা ছোট টেবিল আমার দিকে ছুড়ে মারলো। টেবিলটা এসে পড়লো আমার পায়ের পাতায়। ব্যাথায় চোখে অন্ধকার দেখলাম। ব্যাথাটা সামান্য কমতেই ভাঙ্গা ফুলদানিটা নিয়ে ছুটে গেলাম প্রকাশের দিকে। ঠিক তখনই দীপুর গলা পেলাম।
-রূপালী! এক মিনিট! থামো!
প্রবাল আর দীপু ছিল বেডরুমের বারান্দায়। আড়াল থেকে লক্ষ্য রাখছিল। দীপু দ্রুত বের হয়ে এসে প্রকাশের সামনে দাঁড়ালো, ইশারা করায় প্রবালও এলো। ওরা দুজন ঘিরে ফেললো প্রকাশককে। দীপু বললো,
-ভালোয় ভালোয় সব বলো নইলে এই কাঁচের ফুলিদানিটা তোমার পেট দিয়ে ঢুকিয়ে পিঠ দিয়ে বের করতে এই মেয়েটার এক মিনিট লাগবে।
প্রকাশ এবার মুখ খুললো,
-মহিম গাড়ি চালিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসছিল, গাড়িতে মারা যায়, লাশ পাওয়া যায় পরে।
-গাড়িটা লাশসহ কোথায় পাওয়া যায়?
রূপগঞ্জের কাছাকাছি একটা জায়গায়।
আমি বললাম,
-প্রকাশ মিথ্যা বলছে। এই সহজ কথাটা বলতে ও এতো দেরি করলো কেনো?
দীপু বললো আমরা এখন রূপগঞ্জে রওয়ানা হবো। ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারলে সব জানা যাবে।
প্রকাশের হাত শক্ত করে ধরে আমি বের হয়ে এলাম সিক্স বি ফ্ল্যাট থেকে। প্রকাশ হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু আমার সাথে শক্তিতে পারবেনা বুঝতে পেরে থেমে গেছে। চালকের আসনে বসেছে মেঘলার স্বামী প্রবাল আর পিছনের সিটে আমি আর দীপু বসে আছি প্রকাশকে মাঝে নিয়ে।
সন্ধ্যার কিছু আগে আমরা ঘটনাস্থলে পৌঁছালাম। বড় রাস্তা। চারদিক দিয়ে সাঁই সাঁই গাড়ি ছুটছে। গাড়ি একপাশে পার্ক করা হলো। গাড়ি থেকে নামলাম না আমরা। দীপু পকেট থেকে মহিমের স্কেচটা বের করে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থম ধরে রইল, তারপর বললো,
-প্রকাশ মিথ্যা বলছে, মহিমের মৃত্যু এখানে হয়নি। এই জায়গার সাথে মহিমের কোন সম্পর্ক নাই।
শুনে আমার এতো রাগ হলো, যে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। এক হাতে প্রকাশের মুখ চেপে ধরলাম যাতে শব্দ করতে না পারে, আরেক হাতে ওর একটা আঙুল ভেঙ্গে দিলাম। প্রকাশ যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে বললো,
-কি ক্ষতি করেছি তোমাদের? কেনো এমন করছো?
আমি বললাম,
-ন্যাকামি কম কর। ঠিকঠাক বল, নইলে বাকি আঙুলগুলি ভাঙ্গবো।
দীপু বললো,
-মিথ্যা বিলে লাভ নেই প্রকাশ। তোমার মিথ্যা আমি ধরতে পারি তার প্রমাণ এতোক্ষণে পেয়ে গেছো। বাঁচতে হলে সত্য বলো। মহিমের কবর কোথায়?
প্রকাশ ভেঙ্গে যাওয়া আঙুলটা ধরে কোন রকমে বললো,
-গাজিপুর।
আমাদের গাড়ি গাজিপুরের দিকে রওয়ানা হলো। গাজিপুর পৌঁছাতে রাত হলো। প্রকাশের নির্দেশ অনুযায়ী আমাদের গাড়ি গোরস্থান নয়, বরং একটি একতলা বাড়ির সামনে এসে থামলো। পুরো বাড়ি অন্ধকারে ডুবে আছে, হয়তো বাড়িতে কেউ থাকে না।
গাড়ি থেকে নেমে খোলা জায়গা পার হয়ে আমরা বাড়ির পিছনে চলে এলাম। প্রবাল তার মোবাইলের টর্চ জ্বেলে রেখেছে। আমার হাতে বন্দী প্রকাশ পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে। একটা ঝোপঝাড়ের পিছন দিক দেখিয়ে বললো,
-এখানে কবর হয়েছে মহিমের।
দীপু বললো,
-এখানে কেনো? কবরস্থানে নয় কেনো?
-প্রকাশের এরকমই ইচ্ছা ছিল। এটা ওদের পৈত্রিক বাড়ি।
প্রকাশের কথা শেষ হবার পর দীপু পুরো জায়গাটা কয়েকবার চক্কর দিলো। তারপর প্রকাশকে এসে বলল,
– মহিম কি এটাও বলেছিল, তার লাশ টুকরা করে কেটে সুটিকেসে ভরে কবর দিতে?
প্রকাশ ভয় পাওয়া গলায় বললো,
– আমি কিছু জানিনা।
দীপু বললো,
-ইবলিশ! তুই-ই জানিস। দীপুর হিসাব কখনো ভুল হয় না, আর রূপালীর টুকরা করা শরীরটাও তো এখানেই কবর দিয়েছিস, তাইনা?এটাও সুটকেসে ভরে? এই সুটকেস শিল্প শিখলি কোথায়?
প্রকাশ হাত ছাড়িয়ে পালানোর চেষ্টা করতেই আমি ওর গলা চেপে ধরলাম।
প্রকাশ গোঁ গোঁ করতে করতে হাতের ইশারায় আমাকে থামতে বললো। হয়তো মুখ খুলবে, আমি গলা ছেড়ে দিলাম।
নিজের গলা ধরে কিছুক্ষণ কাশলো প্রকাশ তারপর বললো,
-বেশ করেছি, মহিমকে মেরেছি। বুঝতে পারছি তোমরা মহিমের কাছের লোক। কিন্তু আমি ওর আরও কাছের ছিলাম। তোমরা যা জানো না, তা আমি জানি। আমার জায়গায় তোমরা থাকলে তোমরাও ওকে মেরে ফেলার কথা ভাবতে।
দীপু বললো,
-কি করেছিল মহিম?
-কি করেনি বলো? এমন কোন অপকর্ম ছিল না, যা ও করতো না। আমি খারাপ, লম্পট সবাই জানে। যা করি খুললাম খোল্লা করি। কিন্তু মহিম সবার সামনে সাধু সেজে থাকতো আর আড়ালে চলতো তার অনাচার।
সারাজীবন আমরা একসাথেই নানা অপকর্ম করলেও কেউ কখনো একে অন্যের ক্ষতি করি নাই। আমি লম্পট, বদমাশ হলেও বন্ধুত্বের ব্যাপারে বিশ্বস্ত ছিলাম। কিন্তু এই মহিম আমার একমাত্র বোনের দিকে হাত বাড়ালো।
এদিকে রূপালীকে নিয়ে এসে ফ্ল্যাটে তুলেছে, ওদিকে আমার বোনকে বিয়ের লোভ দেখিয়ে ভোগ করে চলেছে। আমার বোনটা সরল, মহিমের প্রেমে পড়ে ওকে মহাপুরুষ ভাবতে শুরু করেছিল, ধরতেই পারেনি মহিমের মিথ্যাচার। আমার কাছেও সব গোপন করে গেছে মহিমের নির্দেশে।
বোন প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর আমি জানতে পারি। মহিমকে অনুরোধ করি ওকে বিয়ে করতে। মহিম তার বিখ্যাত বাণী শোনায়, সে বিয়ে প্রথায় বিশ্বাসী নয়। মনের সম্মতিতে বিশ্বাসী। সেই হিসাবে আমার বোনের সাথে তার বিয়ে নাকি হয়ে গেছে। বোন এ্যাবরশন করায় মহিমের কথায় কিন্তু তারপরই অনুতাপে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে। কিন্তু বেঁচে যায়।
এরপরও মহিম ওকে ছাড়ে না। ফুঁসলিয়ে, ফাঁসলিয়ে আবার মেলামেশা শুরু করে। আমার হাতে ধরা পড়ে একদিন। নিজের বোনের কথা কি বলবো, মেয়েরা প্রেমে পড়লে প্রেম ওদের অর্ধেক ঘিলু খেয়ে ফেলে। আমার বোনেরটাও খেয়েছে। সে বললো, মহিমকে যেন মাফ করে দেই, মহিমকে ছাড়া সে বাঁচবে না। তার প্রেম নাকি অতি বড়, প্রেমিকের সব অপরাধ ক্ষমার চোখে দেখে।
শুনে মাথায় আগুন ধরে গেলো। আমার গাধী বোনের ব্রেণ ওয়াশ করে নিজের ফায়দা লুটছে মহিম। মেয়েদের পটানোর জন্য বড় বড় বাণী দেয় সে। সেইসব বাণীই এখন আমার বোনের মুখ দিয়ে বের হচ্ছে।
আমিও ভান করলাম, বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে ওদের মহান প্রেম মেনে নিয়েছি। তারপর একদিন মহিমকে বাড়িতে দাওয়াত করে খাবারের সাথে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ দিলাম।
বোনকে আগেই জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম ফুপুর বাসায়। মহিমকে একটা ঘরে হাত- পা বেঁধে ফেলে রাখলাম। যখন জ্ঞান ফিরলো ওর তখন জোর, জবরদস্তি আর অত্যাচার করে ওর যাবতীয় বিষয়- সম্পত্তি, বিজনেস আমার নামে করে নিলাম। বিষ খাইয়ে মেরে ফেললাম ওকে। তারপর সুটকেসে ভরে কবর দিলাম এখানে।
-আর রূপালী? রূপালীর লাশটা পুলিশকে দিলি না কেনো?
-রূপালীকে ওর স্বামী পার্থ হন্যে হয়ে খুঁজছিল। পার্থের সাথে আমার ভালো সম্পর্ক। আমার ফ্ল্যাটে রূপালী সুইসাইড করেছে জানলে পার্থ আমায় ছেড়ে কথা বলতো না। তাছাড়া পুলিশ রূপালীর লাশ পেলে মহিমকে খুঁজতো। আমি ধরা খেতাম।
এতোক্ষণ আমি অনেক ধৈর্য ধরে প্রকাশের কথা শুনছিলাম। প্রকাশ থামতেই চিৎকার করলাম,
-মিথ্যা! সব মিথ্যা বলছে ও! দীপু আমি কথা রাখতে পারছি না, ওকে আমার খুন করতেই হবে।
দীপু আবার বাঁধা দিলো,
-রূপালী! ওকে একটা শেষ সুযোগ দাও। ও প্রমাণ করুক যে সত্য বলছে।
প্রকাশ দ্রুত বললো,
-আছে! প্রমাণ আছে। মহিমের সাথে আমার বোনের প্রেগনেন্সি নিয়ে ফোনে কথা হয়। সেখানে মহিম স্বীকার করেছিল সম্তানটা ওর। ফোনকল রেকর্ড আমার ইমেইল এ্যাকাউন্টে সেভ করা আছে।
প্রবাল তার মোবাইল এগিয়ে দিয়ে বললো,
-এই সেট থেকে মেইল এ্যাড্রেসে ঢুকে প্রমানটা দেখান।
প্রকাশ তাই করলো। বহুদিন পর আমি মহিমের কন্ঠটা পেলাম। ভরাট, প্রাণবন্ত কন্ঠে মহিম বলছে,
-সন্তানটাকে নোংরা বলে অপমান করিস না প্রকাশ। ওটা আমার আর তোর বোন কনার প্রেমের ফসল। প্রেম কি করে নোংরা হয়? এখন এবরেশন করতে বলেছি কারণ বাবা হওয়ার জন্য আমি ঠিক রেডি না, তাছাড়া রূপালী ঝুলে আছে গলায়। তুই তো সবই জানিস।
আমি প্রকাশের হাত ছেড়ে দিলাম। প্রকাশ দৌঁড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই দীপু ওকে ধরে ফেললো। জোর করে তুললো গাড়িতে। প্রবাল আমার সামনে এসে বললো,
-রূপালী! গাড়িতে আসুন।
আমি চোখ তুলে প্রবালের দিকে চাইলাম, চোখাচোখি হতেই ওকে ভীত মনে হলো। প্রবাল দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো। নিজের বৌকে অন্যের নাম ধরে ডাকছে মানুষটা!