মরীচিকা
ভৌতিক গল্প পর্ব-১২
শাপলা জাকিয়া : ঠিক হলো পরদিন সকালে আমি আর দীপু সিক্স বি ফ্ল্যাটে যাবো রূপালীর সাথে কথা বলতে। প্রবাল সকালে অফিসে ফোন করে হাফ বেলা ছুটিও নিল, সে আমাদের সাথে থাকতে চায়। কিন্তু প্রবালদের ইংল্যান্ড অফিসের হেড আচমকা অনলাইন কনফারেন্স ডাকলেন। তাই ওর অফিসে যাওয়া জরুরী হয়ে পড়লো।
প্রবাল বললো,
-আজ যেও না তোমরা। দেখি কাল ছুটি ম্যানেজ করতে পারি কিনা। অথবা সকালে না গিয়ে সন্ধ্যার পর গেলে কেমন হয়, আমি অফিস থেকে ফিরে তোমাদের সাথে গেলাম?
আমি বললাম,
-ওরে বাবা! সন্ধ্যার পর না, সন্ধ্যার পর অতৃপ্ত আত্মারা পাগল হয়ে ওঠে, তাদের ভায়োলেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। কালকে যাওয়ার জন্য দীপু ভাইকে বলে দেখি।
কিন্তু দীপু বললো, তার জরুরী কাজ পড়ে গেছে আমেরিকাতে। ফিরে যেতে হবে। হাতে বেশি সময় নেই। তাই একটা দিনও অপচয় করা যাবে না। রূপালীর ব্যাপারটা যতো দ্রুত সম্ভব সম্পূর্ণ করে সে ফিরে যেতে চায়।
প্রবাল অসন্তোষ নিয়ে মেনে নিলো। তার চোখ-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ স্থায়ী হয়ে গেছে। কতোদিন ওর নির্ভার মুখটা দেখিনি ভেবে আফসোস হলো। কোন কুক্ষণে যে এই ফ্ল্যাটটা ভাড়া নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম! আমি প্রবালকে অফিস যাওয়ার সময় বললাম,
-ভেবো না। রুনা ভাবিকে সাথে নিয়ে যাবো।
কিন্তু রুনা ভাবি শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসলেন। বললেন,
-শরীরটা ভালো লাগছে না রে, টেনশনে প্রেশারটা হাই হয়ে গেছে। ওখানে গিয়ে আরও অসুস্থ হলে তোদের কাজ পন্ড হবে। আর দীপু সাথে থাকছে, ভয় পাস না। ও খুব ভালো ছেলে।
অগত্যা আমি আর দীপু ঢুকলাম সিক্স বি ফ্ল্যাটে। দীপু যদিও আশ্বস্ত করেছে যে আজ রূপালীর আক্রমণাত্মক আচরণের সম্ভাবনা নেই তবু আমার ভয় করছে। সেইসাথে এই প্রথম দীপুর সাথে একা ফ্ল্যাটে ঢুকছি, প্রবাল নেই।
কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে।
অস্বস্তি নিয়েই ঢুকলাম। ভারি পর্দা টানা বলে ফ্ল্যাটটা সবসময়কার মতো হালকা অন্ধকার। দীপু সদর দরজা বন্ধ করে সামনে এগলো। আমি ওর পিছন পিছন ডাইনিং হলে এসে দাঁড়ালাম। কাল প্রকাশ চলে যাওয়ার পর রূপালীর সাথে কথাবার্তা বলার চেষ্টা করেছিল দীপু, তার প্রমাণ রয়ে গেছে ডাইনিং টেবিলে। মোমবাতি আর হাবিজাবি আরও কি,কি যেন ডাইনিং টেবিলে রয়ে গেছে । ঘরের অল্প আলোতে জিনিসগুলি কি, আমি বুঝলাম না।
হঠাৎ একটা আশার আলো দেখলাম, দীপু যদি রূপালীর সাথে আমাকে ছাড়াই কথাবার্তা বলতে পারে তবে আমাকে দরকার কি?
কথাটা দীপুকে বলতেই ও বললো,
-আপনাকে ছাড়া আমি রূপালীর সাথে কথা বলতে পারতাম কিন্তু ইচ্ছা করেই সেটা করছি না।
আমি অবাক হয়ে বললাম,
-কেনো?
-অনেকগুলি কারণ আছে। বাকি কারণগুলি পরে বলবো, এখন একটা কারণ বলি। সেটা হচ্ছে, ভবিষ্যৎ এ আপনি একজন মিডিয়াম হিসাবে কাজ করবেন। আপনার হাতেখড়ি হচ্ছে আমার সাথে।
-কিন্তু আমি তো মিডিয়াম হিসাবে কাজ করতে চাই না।
-আপনি কাজ করতে চাইবেন আর খুব ভালোও করবেন। অনেক আত্মা অপেক্ষা করে আছে আপনার জন্য। আরেকটা তথ্য দেই, এবার আমি বাংলাদেশে এসেছি শুধুমাত্র আপনার জন্য। আসুন কথা না বাড়িয়ে কাজ শুরু করি।
আমার দীপুকে কেমন ভয় ভয় লাগতে শুরু করেছে। ওর কথাগুলি নিতে পারছি না। আমি এতো গুরুত্বপূর্ণ যে অনেক আত্মা অপেক্ষা করে আছে আমার জন্য? একটু বাড়াবাড়ি লাগে না? ফাঁকা ফ্ল্যাটে ওর সাথে আসা কতোটা উচিত হলো বুঝতে পারছি না। আধ্যাত্মিক গুরু সাজা ভন্ড মানুষেরা আবার লম্পট টাইপের হয়, দীপু সেরকম না তো! যদি এখন জাপটে ধরে আমাকে? চোখের কোণা দিয়ে পাশের আলমিরার মাথায় রাখা ছুরির সেটটা আছে কিনা দেখলাম। আছে!
দীপু আমাকে চমকে দিয়ে বললো,
-আমি যে স্তরে চলে গেছি, সেখানে শারীরিক ভোগের ব্যাপারটা তুচ্ছ। আমাদের আনন্দ-সুখ আর দশটা মানুষের মতো নয়। কাউকে যখন তার সমস্যা থেকে মুক্ত করতে পারি, কোন আশু বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারি, তখন যে তীব্র সুখ পাওয়া যায় , সেটার কাঙ্গাল আমরা। আর সেই সুখ পেতে হলে কাম,ক্রোধ, লোভ এসব থেকে মুক্ত থাকতে হয়। যে যতো মুক্ত থাকতে পারবে, তার আয়না হবে ততো পরিষ্কার। সেই আয়নায় তখন সব জগত দেখা যাবে। আয়না অপরিষ্কার থাকলে সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যায় না।
আমি কিছুটা লজ্জা পেলাম। দীপু কি মনের কথা বুঝতে পারে? ‘ আমরা ‘ বলতে সে কাদের বোঝাচ্ছে তাই জানতে চাওয়া হলো না।
দেয়াল ঘড়িতে দুপুর বারোটা বাজলো, টুং টাং পিয়ানোর সুর বাজিয়ে জানান দিল সেটা। দীপু একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখলো টেবিলের মাঝখানে। কিছু বোতল আর কৌটাও রাখলো। এগুলির মধ্যে কি আছে, জানিনা।
টেবিলের একপাশে আমি বসলাম। মুখোমুখি বসলো দীপু।
হাত দুটি মুষ্টিবদ্ধ করে টেবিলে রেখে চোখবন্ধ করে বিড়বিড় করে কিছু পড়তে শুরু করলো ও। ফ্যান চালানো হয়নি বলেই বোধহয় আমি ঘামতে শুরু করলাম একসময়, অথচ মোমের আলোয় দীপুকে প্রশান্ত দেখাচ্ছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘাড়টা ভারভার লাগতে শুরু করলো। নিশ্চয় প্রেশারটা বাড়ছে এখন। এরসাথে শুরু হয়েছে নাক ও কানের মধ্যে সেই পরিচিত শিরশিরানি। আমি অস্বস্তিতে ঘাড় নাড়ছি, হাতের উল্টোপিঠে নাক ঘষছি, কান টানছি। খুব ইচ্ছা করছে এখান থেকে ছুটে বের হয়ে যাই।
চেষ্টাও করলাম কিন্তু মনে হলো আমি লোহার তৈরি আর ডাইনিং এর চেয়ারটা চুম্বকের । কিছুতেই নিজেকে চেয়ার ছেড়ে উঠাতে পারলাম না। দপ করে নিভে গেলো সামনের মোমবাতিটি। একটা গরম বাতাসের ঘূর্ণি এখন এই টেবিলের ওপর। সেটা দীপুর দিকে চলে গিয়ে আবার কি মনে করে আমার দিকে ফিরে এলো। তারপর আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়লো আমার ওপর। আমি যেন সমুদ্রের প্রবল ঢেউয়ের নীচে তলিয়ে গেলাম!
শরীরে কেউ কিছু ছড়িয়ে দিচ্ছে। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি দীপু নামের চশমা পরা অদ্ভুত ছেলেটা কিছু একটার গুঁড়া আমার সদ্য দখল করা মেঘলার শরীরটায় ছড়িয়ে দিচ্ছে। হাত উঁচু করে থামার নির্দেশ দিতে গিয়ে দেখি হাত ওপরে উঠছে না। ছেলেটা এমন কিছু করেছে, যারজন্য আমি মেঘলার শরীরের কোন অংশ নাড়াতে পারছি না। তবে ঠোঁট ও জিহ্বা নাড়াচাড়া করতে পারছি, চোখ ও চোখের পাতাও নড়ছে।
আর সব আটকে আছে। বুঝলাম, আমাকে বন্দী করেছে এই ছেলেটা। এর ক্ষমতার কাছে আমি এখন অসহায়। বললাম,
– আমাকে এরকম বন্দী না করলেও পারতে।
ছেলেটা বললো,
-বন্দী করতে চাইনা তো। কিন্তু তোমার রেকর্ড ভালো না। পার্কে একজনকে খুন করেছিলে, মেঘলার স্বামীকে মারধোর সহ আমাকে গলা টিপে মেরে ফেলার চেষ্টা করতে তোমায় দেখা গেছে।
-আর করবো না। হাত- পা খুলে দাও।
– হাত,পা দিয়ে তোমার কি কাজ? মুখ খোলা রেখেছি, মুখে কথা বলো।
বুঝলাম ছেলেটাকে মতের বাইরে কিছু করানো যাবে না। তাই বললাম,
-কেনো ডেকেছো? কাল প্রকাশকে হাতের কাছে পেয়ে কিছু করতে পারলাম না একটা শরীরের অভাবে। শয়তানটাকে মেরে ফেলতে ইচ্ছা করছিল।
দীপু প্রশ্ন করলো,
-বেঁচে থাকতে তুমি কাউকে খুন করেছিলে, নিজেকে ছাড়া?
-না।
-তবে মরে গিয়ে এতো খুন করতে চাও কেনো?
-এই অতৃপ্ত আত্মার জগতে আমি যে কষ্ট পাচ্ছি তা শয়তান মানুষগুলিকে দিতে ইচ্ছা করে। তাই খুন করে আমার জগতে পাঠিয়ে দিতে চাই।
-আমি কিন্তু তোমার ক্ষতি চাইনা, শয়তান মানুষ নই। তোমার মহিমকে খুঁজছি।
” আমার মহিম” কথাটা আমায় প্রশান্তি দিলো। আমি নরম গলায় দীপুকে বললাম,
-মহিমের কথা প্রকাশের কাছে জানতে পেরেছো?
-এখনও পারিনি। ও নিজেই বলেছে ফ্ল্যাটটা ওর একার কেনা। কাছের বন্ধুদের নাম জানতে চেয়েছিলাম একদিন। কিছু নাম বললো কিন্তু মহিমের নাম উচ্চারণ করেনি। রূপালী, এই ফ্ল্যাটে মহিমের কোন ব্যবহার করা জিনিস আছে? যদি থাকতো তবে ওটা ছুুুঁয়ে আমি ওর সন্ধান বলতে পারতাম।
প্রকাশের ওপর আমার রাগটা আবার চিড়বিড় করে উঠলো। আমি বললাম,
-প্রকাশ জানেনা, আমি রূপালী এখনও এই ফ্ল্যাটে রয়ে গেছি! ভেবেছে আমার লাশটা টুকরা করে ফেলে দিলেই আমি চলে যাবো? ওকে আমার মুখোমুখি করো, বাপ বাপ করে সব স্বীকার করবে।
মহিমের জামা কাপড় পর্যন্ত ফেলে দিয়েছে প্রকাশ। কিছু নেই। আমার লাশটাও ফেলে দিয়েছে। শুধু ডানহাতের কব্জিসহ আঙুলগুলি স্টোর রুমে পড়েছিল। এখন শুধু হাড্ডি। মাংস-চামড়া পচে গলে কী দুর্গন্ধ ছড়ালো তবু কেউ টের পেলো না।
দীপু বললো,
-বলে যাও। আমি তোমার কথা আমার ফোনে রেকর্ড করছি যাতে পরে মনে না পড়লে আরেকবার শুনে নিতে পারি।
-আমি বললাম,
-সব বলব শুরু থেকে কিন্তু বলতে ইচ্ছা করছে না। লিখতে ইচ্ছা করছে। কতোদিন লিখি না। বেঁচে থাকতে আমি খুব লিখতে ভালোবাসতাম। মহিমের ডেস্কটপে লিখতে খুব সুখ লাগতো। মনে হতো এই কীবোর্ড চেপে ও কতো লিখেছে,আমি যেন লেখার সময় ওর ছোঁয়া পেতাম। সেই কম্পিউটারটা পর্যন্ত প্রকাশ নিয়ে গেছে! আমি বাঁধা দিতে পারিনি একটা শরীরের অভাবে।
দীপু বললো,
-এই বাড়িতে এখন ডেস্কটপ, ল্যাপটপ কিছু নেই। আমার সেলফোনটার নোটপ্যাডে লিখতে পারো। কিন্তু সেক্ষেত্রে তোমার হাত খুলে দিতে হবে। তুমি আবার আক্রমণ করবে না তো।
-চাইলেও করতে পারবো না। তুমি আমার পা আটকে রেখেছো। আর নিজে বসেছো আমার হাতের নাগালের বাইরে।
-আক্রমণ করতে চাও নাকি? হিসাব কষছো যে?
-আপাতত চাই না, যদি কথা দাও মহিমকে এনে দেবে, তোমার কোন ক্ষতি করবো না।
দীপু বললো,
-চেষ্টা করবো।
তারপর খুব সাবধানে দূর থেকে একটা লম্বা তুলি দিয়ে আমার হাতের ওপরের গুঁড়াগুলি সরিয়ে দিলো। আমি আঙুল ও কবজি নাড়াতে পারছি এখন। দীপু ওর মোবাইলটা তুলির কাঠের অংশটা দিয়ে আমার সামনে ঠেলে দিলো। ছেলেটা সাবধানী, ঝুঁকি নিচ্ছে না।
মোবাইলের নোটপ্যাড ওপেন করে দিয়েছে। আমি সেটা দুইহাতে তুলে নিয়ে টাইপ করতে শুরু করলাম। আহ! কতোদিন পর লিখছি! আজ সব লিখবো। আমি লিখতে শুরু করলাম।
আমি রূপালী। জন্মেছিলাম মধ্যবিত্ত এক পরিবারে। যদিও আমার মনে হতো আমার জন্ম হয়েছে ধনী পরিবারে। যা চাইতাম, বাবা- মা তাই দিতেন। কিভাবে সব যোগাড় করতেন,টাকা কোথা থেকে আসতো কখনো খোঁজ নেইনি।
মেধাবী ছিলাম। অল্প পড়ে রেজাল্ট ভালো করতাম। বাবা- মায়ের অবাধ্য ছিলাম না তেমন।
ক্লাস সিক্স- সেভেনে উঠতেই টের পেলাম আমি আসলে খুব সুন্দরী। পাড়ার ছেলেরা স্কুলে যাওয়া আসার পথে দাঁড়িয়ে থাকে। এর,ওর হাতে চিঠিপত্র পাঠায়। কে আমার প্রেমিক হবে তা নিয়ে পাড়ার ছেলেদের মধ্যে ঝগড়া -বিবাদ হয়, আমার কানে আসে সেসব। কিন্তু আমার কাউকে তেমন মনে ধরে না। আমি তখন গ্রীক পৌরানিক কাহিনীর নার্সিয়াসের মতো। নিজের প্রেমে নিজে পড়েছি। সুযোগ পেলেই আয়নায় নিজেকে দেখি, মুগ্ধ ও বিস্মিত হই।
আরও কিছুদিন পর প্রেমে পড়লাম দুজনের। দুটিই গল্পের বই এর চরিত্র। একজন ইকথিয়ান্ডার, সে ছিল উভচর মানুষ। একই সাথে সমুদ্রে থাকতে পারতো আর থাকতো পারতো ডাঙ্গায়। ভীষণ সরল আর ভালো ইকথিয়ান্ডর, গুত্তিয়েরে নামের এক মেয়ের সাথে প্রেম করেছিল। কিন্তু পৃথিবীর খারাপ মানুষদের ষড়যন্ত্রে ইকথিয়ান্ডর চিরদিনের মতো সমুদ্রে চলে যায়। গুত্তিয়েরের সাথে তার মিলন হয়নি।
আরেকজন হলো হিথক্লিফ। ওয়াদারিং হাইটস গল্পের নায়ক ও ভিলেন। হিথক্লিফ তার চারপাশের কোন মানুষকে পছন্দ করতো না, যেন সে শুধু ক্যাথরিনকে ভালোবাসার জন্য জন্মেছে। পৃথিবীর আর কোন মানুষকে ছিঁটেফোটা ভালোবাসাও তাই হিথক্লিফ দিতে পারবে না।
আমি ইকথিয়ান্ডার অথবা হিথক্লিফের মতো একজন প্রেমিককে চাইতাম আমার পাশে। একসময় মনে হলো প্রেম না করলে কিভাবে বুঝবো, কে ইকথিয়ান্ডের মতো অথবা কে হিথক্লিফের মতো?
একসাথে কয়েকজনের ডাকে সাড়া দিলাম। কিন্তু কাউকে পছন্দ হয় না। কিছুদিন পর একেকজনকে একেকটা কারণ দেখিয়ে সরে আসলাম। তারা রাগ করে আমার নামে বাজে কথা বলতে শুরু করলো। আমি পাত্তা দিলাম না। কারণ বাজে কথা ছড়ালেও আমার প্রেমের প্রস্তাব আসায় কোন ভাটা পড়েনি।
আমি আবারও প্রেম করতে শুরু করলাম। তবে এবার একসাথে অনেকজনের সঙ্গে নয়। একজন, একজন করে ছয়মাস, নয় মাস মেয়াদে প্রেম করলাম।
ছয়মাস, নয় মাসের বেশি প্রেম আগায় না কারণ প্রথম এক-দুই মাস যে উথালপাতাল প্রেম প্রেম ভাব থাকে সেটা সময়ের সাথে সাথে কমতে শুরু করে।
এদিকে প্রথম দিকের উথালপাতাল প্রেমের অনুভূতি ছাড়া আমার চলে না। তাই ঘন ঘন প্রেমিক বদলাতে শুরু করলাম।
যখন অনার্সে পড়ি তখন অন্য ধর্মের এক ছেলের সাথে প্রেম দেড় বছর টিকে গেলো। ওর নাম ছিল পার্থ। পার্থ আমার জন্য নিজ ধর্ম ত্যাগ করে আমাকে বিয়ে করতে চাইলো। আমার বাবা-মা সারাজীবন আমার সব চাওয়া মেনে নিলেও পার্থকে মেনে নিলেন না। আমি একদিন পার্থের সাথে পালালাম। প্রথমবারের মতো বাবা-মায়ের কাছে কিছু চেয়ে পাইনি, তাই খুব অভিমান হয়েছিল । ভেবেছিলাম, বাবা-মা তাদের ছোট মেয়েকে নিয়েই সুখে থাকুন আমি আমার মতো করে সুখে থাকবো।
আমি আর পার্থ বিয়ে করলাম নিজ নিজ পরিবারের অমতে। পার্থ একটা মফস্বল শহরে ব্যাংকে চাকরি পেয়েছিলো বিয়ের কিছুদিন আগে। সেই শহরেই থিতু হয়েছিলাম আমরা। দুই কামরার সাদামাটা সেই বাড়িটাকে স্বর্গ মনে হতো। কিন্তু একসময় সেই স্বর্গ, নরক হয়ে গেলো।
উথালপাতাল প্রেমে ভাটা পড়েছিলো বছর গড়াতেই।সংসারের নানা দায়িত্ব, আমার তখনই সন্তান নিতে না চাওয়া আর পরিবারের কাছ থেকে দূরে থাকার মানসিক চাপ পার্থকে দিনদিন খিটখিটে মেজাজের করে তুলছিল। এদিকে আমার কেবলই মনে হচ্ছিল পার্থ তার ইচ্ছাগুলি জোর করে আমার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। আগের মতো আমায় খুশি করতে ব্যস্ত থাকে না। আমার সাজগোজ দেখে মুগ্ধ হয় না।
পার্থকে বিরক্ত লাগতে শুরু করলো। আসলে আমি ততোদিনে ওর ব্যাপারে খুব আশাহত হয়ে পড়েছিলাম। পার্থ যখন আমার জন্য নিজের পরিবার ছেড়ে চলে এসেছিলো, তখন ভেবেছিলাম ও আমার ইকথিয়ান্ডর,ও আমার হিথক্লিফ।
কিন্তু পার্থের কাছে আমার মূল্য দিনদিন কমছিল টের পাচ্ছিলাম। আমি ছটফট করতাম প্রেমের ছটফটানির অভাবে। নিজেকে শান্ত রাখতে ছবি আঁকাটা আবার ধরলাম। কিন্তু ভালো লাগতো না।
দিনদিন সংসারে অমনোযোগী হয়ে উঠলাম আর পার্থ হয়ে উঠলো আরো দুর্দমনীয়। সে সন্দেহ করতে শুরু করলো অন্য পুরুষের সাথে আমার সম্পর্ক আছে। তা কিন্তু ছিল না। পার্থের সাথে বিয়ের পর অন্য কারোও সাথে জড়াইনি আমি। পার্থের পরিবর্তনে এতোটাই হতাশ হয়ে পড়েছিলাম যে ধরেই নিয়েছিলাম, পৃথিবীর কোন পুরুষ আমার জন্য ইকথিয়ান্ডর হবে না অথবা হিথক্লিফ।
আর ঠিক তখনই আমার জীবনে মহিম এলো। ফেসবুকে টুকটাক লিখতাম। সেগুলি পড়ে খুব মুগ্ধতা নিয়ে একদিন নক করেছিল আমাকে মহিম। আমি প্রেমে পড়বো না পড়বো না করেও ওর প্রেমে পড়েছিলাম। বহুদিন পর আবার সেই উথালপাতাল করা প্রেমের ছটফটানি। যারজন্য আমি কাতর থেকেছি সারাজীবন।
আমার মনে হলো আমি আসলে সারাজীবন মহিমের অপেক্ষাতেই ছিলাম। মহিমও হয়তো আমার।
আমি পার্থের কাছে ডিভোর্স চাইলাম, সে রাজি হলো না। আমাকে ঘরে তালা বন্ধ করে রাখা শুরু করলো।
একদিন সুযোগ পেয়ে আমি পার্থের সংসার ছেড়ে পালিয়ে মহিমের কাছে চলে এলাম। মহিম আমাকে নিকুঞ্জকাননের এই ফ্ল্যাটে এনে তুললো। তারপর ছয়টা মাস আমার জীবনের সেরা মাস ছিল।
চলবে.