“মরীচিকা”-শাপলা জাকিয়া‘র ভৌতিক গল্প -পর্ব-০৩

0
486
Shapla-Zakia

শাপলা জাকিয়া : এতো তীব্র ভয়ের সাথে এর আগে আমার পরিচয় ছিল না। কী অদ্ভুত এক শিরশিরানি আমাকে অবশ করে ফেলছে, নড়াচড়া করতে পারছি না। অথচ শরীরের প্রতিটি বিন্দু চাইছে এই পরিস্থিতি থেকে ছুটে পালিয়ে যেতে। মস্তিষ্কের একটা অংশ প্রাণপণে প্রার্থনা করছে এই মুহূর্তে একজন মানুষ এসে যেন আমাকে এই ভয় থেকে,

আশংকা থেকে মুক্ত করে। আরেকটা অংশ হতাশ হয়ে জানাচ্ছে এই চাওয়া পূর্ণ হওয়া এখন সম্ভব নয়। আমি কি চোখ বন্ধ করে ফেলবো? সামনের ছায়ামূর্তিটি কি করবে আমাকে? বড় জোর মেরে ফেলবে, তারপর? মরার পর আমার আত্মাটাকে কি বন্দী করে রাখবে? যেমন হরর মুভিতে রাখে?

এসব একের পর এক চিন্তা, অনুভূতি সেকেন্ডের গতিতে ঝড়ের তান্ডব তুলছে আমার সমস্ত স্নায়ুজুড়ে। সামনের কম্পমান ছায়ামূর্তি আরও কাছে এগিয়ে আসছে। এটা কি পর্দা বা কোন আসবাবের ছায়া? না, ছায়াটি তো মানুষের আদলের। 
আমি মনে করতে পারছি না এই মুহূর্তে কি পড়তে হয়, আয়াতুল কুরসি না, সূরা ফাতেহা! হয়তো সূরা নাস। আমি প্রাণপনে সূরাগুলি মনে করার চেষ্টা করছি, কিন্তু কোনটারই প্রথম লাইন মনে পড়ছে না। মাঝখান থেকে পড়লে কি হবে? মাঝখানের লাইন কি?

আমার প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হলো, আমার মাথার মধ্যে যেমন চিন্তা, প্রশ্ন আর ভয়ের ঝড় চলছে ঠিক তেমনি আমার শরীরটাকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণির মতো বাতাস ঘুরতে শুরু করেছে। ছায়ামূর্তিটা প্রবল বাতাসে বদলে গেছে। সেই বাতাস কখনও গরম, কখনও ঠান্ডা। বাতাসে শিউলি ফুলের মন খারাপ করা তীব্র সুবাস।

আমার নাকে, কানের মধ্যে শিরশির করতে শুরু করেছে। সমস্ত বাতাস যেন সাপের মতো এঁকেবেঁকে আমার মধ্যে প্রবেশ করছে। হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠলো। বাতাসটা থমকে গেলো। যেমন আমার নাকে,কানে ঢুকেছিল, তেমনই বের হয়ে আসতে শুরু করলো। পুরোপুরি বের হয়ে আসার সাথে সাথেই শরীরটা বলশূণ্য হয়ে পড়লো। তাল সামলাতে না পেরে বিছানায় পড়ে গেলাম।

যখন জ্ঞান ফিরলো তখন মুখের ওপর দুটি উদ্বিগ্ন মুখ চেয়ে আছে। প্রবালকে দেখতে পেয়ে শান্তি লাগলো। পাশের বাসার রুনা ভাবি বললেন,

এই তো চোখ খুলেছে। মাথায় পানি দেয়ায় কাজ হয়েছে। মেঘলা ভাবি, কি হয়েছিল আপনার, বলেন তো ?

প্রবাল বললো,

কি হয়েছিল তোমার? ফোন না ধরায় দুঃশ্চিন্তা হচ্ছিল। অফিসে কাজ ফেলে বাসায় এসে দেখি অজ্ঞান হয়ে পরে আছো। ডাক্তারকে খবর দেয়া হয়েছে, এসে পড়বেন।

আমার কোন কথার জবাব দিতে ইচ্ছা করছিল না। একটা অদ্ভুত নির্লিপ্ততা আমার জবান বন্ধ করে রেখেছিল।

কিছুক্ষণ পর ডাক্তার এলেন, দেখেশুনে কি একটা ইঞ্জেকশন পুশ করলেন, আমি সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়লাম।

যখন আবার ঘুম ভাঙ্গলো, মনে হলো অনেক রাত। পাশে তাকিয়ে দেখি প্রবাল ঘুমাচ্ছে। খাটের যে পাশে প্রবাল শুয়ে আছে তার উল্টো দিকেই একটা রকিং চেয়ার রাখা, সেখানে ধূসর রঙা শাড়ি পরা একটা মেয়ে বসে দোল খাচ্ছে। আমার সাথে চোখাচোখি হতেই হাসলো।

আমি শোয়া থেকে উঠে বসলাম। এই মেয়ে কে? পাশের বাসার রুনা ভাবির কেউ? ঢাকায় আমার বা প্রবালের কোন কাছের আত্মীয়স্বজন নেই যে আমার অসুস্থতার খবর পেয়ে রাতে এসে থাকবে। রুনা ভাবির কোন আত্মীয়ই বা কেনো রাতে আমার আর প্রবালের বেডরুমে বসে থাকবে?

আমি কোন প্রশ্ন করার আগেই মেয়েটি ধীরে ধীরে চেয়ার ছেড়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। এতোক্ষণ তাকে সতেরোআঠারো বছরের তরুণী মনে হলেও কাছে আসার পর তার বয়স আরেকটু বেশি মনে হচ্ছে। স্লিম হওয়ায় তাকে দূর থেকে অল্প বয়সী মনে হচ্ছিল।

কিন্তু চোখের নিচের চওড়া কালি, মুখের ভারি গাম্ভীর্য বলে দিচ্ছে বয়স ত্রিশ হওয়াও বিচিত্র না। চোখের মনি সাদা, বিড়াল চোখী। এসব মেয়েরা শুনেছি খুব প্রেমের কাঙ্গাল হয়, জেদি হয়।

মেয়েটি সামনে এসে কেমন একটা হিসহিস করা গলায় বলে উঠলো,

এই ফ্ল্যাটে তোমরা আর কতোদিন থাকবে? মহিম তোমাদের কে হয়? তোমরা কি মহিমের গেস্ট?

যেসব মেয়ের গায়ের রং চাপা, তাদের কন্ঠ হয় খুব সুমিষ্ট, ধবধবে ফর্সা মেয়েদের কন্ঠ হয় একটু ভারি অনেক সময় কর্কশ। এই মেয়ে ধবধবে ফর্সা বলেই হয়তো তার কন্ঠ এমন খসখসে। আমি বললাম,

আমরা এই ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিয়েছি।

মেয়েটি প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে বললো,

মহিম ফ্ল্যাটটা ভাড়া দিয়েছে! আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলো না!

আমি বললাম,

আপনি কে?

আমি এই ফ্ল্যাটে থাকি। কাগজে কলমে মহিমের ওয়াইফ নই কিন্তু ওয়াইফ বলতেও পারো।

তা কি করে হয়, এই ফ্ল্যাটে তো এখন আমরা থাকি। তাছাড়া আমরা যখন উঠি তখন এই ফ্ল্যাট ফাঁকা ছিল, কেউ ছিল না। কোন ফার্নিচার ছিল না।

মেয়েটা এবার খুব রেগে গেলো।

উড়ে এসে জুড়ে বসে আবার তর্ক করছো? কি ভেবেছো আমি কিছু করতে পারবো না? দেখো, এখনই ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সব জানিয়ে দিচ্ছি। তোমাদের ছবি তুলে ফেসবুকে দিয়ে দেবো।

বলতে বলতে মেয়েটি কম্পিউটারের টেবিলে বসে কী বোর্ডে খট খট করে টাইপ করতে শুরু করলো।

আমাদের কোন ডেস্কটপ কম্পিউটার ছিল না। ছিল না কম্পিউটারের কোন টেবিল। তবে বেডরুমের দক্ষিণদিকে এই টেবিল, চেয়ার আর কম্পিউটার কিভাবে আসলো? কতোদিন ঘুমিয়ে কাটিয়েছি আমি, যে প্রবাল ঘরের সাজসজ্জা বদলে ফেলেছে!

আমি ঘুমন্ত প্রবালকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিলাম। চোখ খুলতেই বললাম,

এই মেয়ে কে প্রবাল? এই টেবিল, কম্পিউটার তুমি কবে রেখেছো আমাদের বেডরুমে?

প্রবাল উঠে বসে আমার মাথাটা ওর বুকে জড়িয়ে ধরে বললো,

কি বলছো এসব? স্বপ্ন দেখেছো? এখন শরীরটা ভালো লাগছে?

আমি প্রবালকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলাম, ওকে ভালো লাগছে না, কথার উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে যেন ও। আর মেয়েটাও কেমন টাইপ করা বাদ দিয়ে হিংসুটে চোখে আমাদের দেখছে।

প্রবাল বললো,

পানি খাবে? দাঁড়াও পানি আনি।

প্রবাল চলে যেতেই মেয়েটি আবার সামনে এসে দাঁড়ালো, আগের চেয়েও কর্কশ গলায় বললো,

এতো ভালো স্বামী থাকা সত্বেও মহিমের সাথে জড়িয়েছো? কি আছে মহিমের, হ্যাঁ? তোমরা মেয়েরা ওর কি দেখে পাগল হও? তুমি যদি কালকের মধ্যে এই ফ্ল্যাট না ছাড়ো তোমায় আমি গলা টিপে মেরে ফেলবো।

মেয়েটির চোখের দৃষ্টি এতো ভয়ংকর হয়ে উঠলো যে, আমি চিৎকার করে উঠলাম,

প্রবাল! প্রবাল!

প্রবাল ডাইনিং থেকে উত্তর দিলো,

এক মিনিট মেঘলা, আসছি!

মেয়েটি এবার তুমি থেকে তুই নেমে বললো,

ঢং দেখে গা জ্বলে যায়। বরের সাথে এতো আহ্লাদ করস কেন? তুই কি কচি খুকি?

তারপর খুব বিরক্তি নিয়ে রুম থেকে চলে গেলো।

প্রবাল যখন পানি নিয়ে ফিরলো তখন আমি হিস্টিরিয়া রুগীর মতো কাঁপছি।

সেই রাতের পর প্রবাল আমাকে ক্লিনিকে ভর্তি করলো। ফুল বডি চেকআপের পরও তেমন কোন অসঙ্গতি ধরা পড়লো না। শুধু প্রেশার লো আর হিমোগ্লোবিন সামান্য কম। ডাক্তার আমাকে সাইকোলজিস্ট দেখাতে বললেন।

ক্লিনিকে থাকা অবস্থায় সাইকোলজিস্ট দেখানো হলো। ভদ্রলোক ছোটখাটো, গোলগাল, মোটাসোটা। আমাকে নানা কথা বলে কাউন্সেলিং করলেন। কিভাবে একটি সন্তানের আশায় আমি ধৈর্য ধরবো, তা শেখালেন। একটা মেডিটেশন শেখালেন, যার শুরুতেই বলতে হয়,

চোখ বন্ধ, ঘুম ঘুম!”

একটা ধাপ করতে হয় আর বলতে হয়,

চোখ বন্ধ, ঘুম ঘুম!”

কথাটা বলার সময় সাইকোলজিস্ট ভদ্রলোকের গলার স্বর আরও মেয়েলী শোনায়। আমি হেসে ফেললাম। তিনি বললেন,

আহা, হাসলে হবে না। এটা কোন ফান ব্যাপার নয়, আপনাকে সিরিয়াসলি করতে হবে। ভয় দূর করার অটোসাজেশন নিজেকে প্রতিদিন দুইবেলা দেবেন। প্রতিদিন নিজেকে বলবেন, “যাবতীয় ভয়ভীতি নেতিবাচক চিন্তা কথার প্রভাব থেকে আমার মন মস্তিষ্ক পুরোপুরি মুক্ত থাকবে।একটা সময় দেখবেন আর ভয় পাবেন না।

তিনি আমাকে একজন সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে রেফার করলেন ওষুধের জন্য। সাইক্রিয়াটিস্ট আমাকে ওষুধ দিলেন যাতে মন প্রফুল্ল থাকে, যেন হেলুসিনেশনে সেই ধূসর শাড়ি পরা মেয়েটিকে আর না দেখি। এছাড়াও তিনি আমাকে খুব ঘুরে বেড়াতে, মানুষের সাথে মিশতে বলেছেন।

ক্লিনিক থেকে বাড়ি ফিরলাম। সবকিছু মেনে ভালোই চলছিলাম। ওষুধ খাওয়ার পর থেকে সারারাত ঘুমাই। ধূসর শাড়ি পরা সেই মেয়ে এসে আমাকে আর ধমকা ধমকি করে না। একটা কাজের বুয়া পেয়েছি, সে সকালে আসে, সন্ধ্যায় প্রবাল অফিস থেকে ফিরলে চলে যায়।

এরমধ্যে প্রবালের অফিসের কাজে ইংল্যান্ডে যেতে হলো পনেরো দিনের জন্য। আমি তখন রাজশাহীতে মায়ের বাড়িতে কাটিয়ে এলাম। আমি প্রায় পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলাম। তবে ওষুধ চলছে। প্রবাল ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পর আমি আবার ঢাকার সেই ফ্ল্যাটে ফিরলাম। কিন্তু কাজের বুয়া ফিরলো না। সে দেশে আরও কিছুদিন থাকবে।

প্রবাল অফিসে গেলে আমি একাই থাকি, ওষুধের গুণ না মেডিটেশনের গুণ আমি জানিনা, আর ভয় করে না। খালি বাড়িতে একদিন দুপুরে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছি, মনে হলো কেউ আমাকে ডেকে তুললো। তাকিয়ে দেখি সেই ধূসর শাড়ি পরা মেয়ে আবার হাজির হয়েছে।

আমি বিড়বিড় করে অটোসাজেশন দিচ্ছি,

যা দেখছি ভুল দেখছি। সব আমার কল্পনা। যাবতীয় ভয়ভীতি নেতিবাচক চিন্তা থেকে আমার মন মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ মুক্ত।

অটোসাজেশনে কাজ হলো না। ধূসর শাড়ীর মেয়েটি আমাকে বললো,

তুই এই মুহূর্তে এই বাড়ি থেকে বের , যদি না যাস তবে খুব খারাপ হবে। আমি রূপালী কতো প্রকারের খারাপ কী কী সেটা তুই বুঝবি।

আমি খাট থেকে নেমে এক দৌড়ে বাইরের গেইটের কাছে চলে এলাম। কাঁপা হাতে ছিটকিনি খুলে পাশের ফ্ল্যাটের দরজায় দুমদাম ধাক্কা দিতে শুরু করলাম। ডোরবেল বাজানোর কথা আমার মনে পড়লো না।

দরজা খুললো একটা চশমা পরা ছেলে। আমি তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ভিতরে চলে গেলাম। রুনা ভাবি আমার উদ্ভ্রান্ত চোখমুখ দেখে বললো,

কি হয়েছে ?

আমি বললাম,

পানি খাবো।

আমাকে বসিয়ে পানি দিলেন রুনা ভাবি তারপর আবার বললেন,

কি হয়েছে?

আমি একবারে পুরো গ্লাসের পানি শেষ করে বললাম,

ভয় পেয়েছি! খুব ভয় পেয়েছি!

দরজা খুলে দেয়া ছেলেটি এতোক্ষণ এক নজরে আমাকে দেখছিল এখন আগ বাড়িয়ে বললো,

অস্বাভাবিক কিছু দেখে ভয় পেয়েছেন?

আমি বললাম, 
হ্যাঁ।

ছেলেটি রুনা ভাবির দিকে তাকিয়ে বললো,

তোমাকে বলেছিলাম না আপা, এই বাড়িতে সমস্যা আছে।

আমি ছেলেটিকে বললাম,

আপনি কিছু জানেন?

এখনও পুরোটা জানিনা, আন্দাজ করেছি। তবে চাইলে জানতে পারবো। ওদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য আমি খুব ভালো মিডিয়াম। মজার ব্যাপার কি জানেন আপনি নিজেও খুব ভালো মিডিয়াম কিন্তু আপনি সেটা জানেন না।

চলবে.. 

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধ“যখন কবিতা লিখি” কবি সুপ্তি জামান‘এর কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধ“দেবতার রাঙ্গা সিঁড়ি”/ মুন্ডা কালিদাসের কবিতা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে