মাতামহী
কবি সুপ্তি জামান
বৈশাখ এলেই সুবাসিত
কুর্চি ফুলের কথা মনে পড়ে;
কুর্চি ফুলের কথা মনে পড়লেই
আমার প্রয়াত মাতামহীর কথা মনে পড়ে;
তাকে আমি নানু বলে ডাকতাম।
আমার নানু শ্বেত বসনা
কুর্চি ফুলের মতোই সুহাসিনি ছিলেন,
নিশব্দে ঝড়ে পরা কুর্চি ফুলের মতো
তার বেদনাগুলো নিশব্দে ঝড়ে পড়েছিল একদিন।
তিনি ঝড়ে পড়া ফুল দিয়ে
নকশী কাঁথা সেলাই করতেন।
মাটির সাথে দু ফোঁটা চোখের জল মিশিয়ে
মাটির ঘড়া বানাতেন,
নারিকেল পাতা ছেঁচে শলা বানাতেন।
তিনি কখনো বেদনাকে বেদনা ভাবেননি
তার দু হাতে দু গাছি রুপোর চুড়ি ছিল
তিনি বলতেন বয়লা
বয়লা দুটোকে মেঝে ঘঁষে চকচকে রাখতেন
তিনি তার বেদনাকে বয়লা দুটির মতো
সযতনে পরিধেয় করে নিয়েছিলেন।
তার পুরুষটি অন্য এক রমনীকে ভালবেসেছিল
এই নিয়ে তিনি কোন দিন
বচসা করেননি সেই রমনীর সাথে;
সেই রমনীর সন্তানকে
সন্তানের মতোই ভালবেসেছিলেন;
তিনি ছেড়ে দেয়া অধিকারের দিকে
আর ফিরে তাকাননি;
তিনি তো কুর্চি ফুলের মতো সুহাসিনী ছিলেন!
কুর্চি ফুল বিবর্ণতাকেই একটি রঙে রুপ দেয়।
আমার মাতামহী কুর্চি ফুলের মতো ছিলেন
তার ফোঁকলা দাতের সেই শুভ্র হাসি
আমি কেবল কুর্চি ফুলেই দেখি।
বৈশাখ আসলেই আমার
কুর্চি ফুলের কথা মনে পড়ে;
কুর্চি ফুল দেখলেই আমার
মাতামহীর কথা মনে পড়ে
তাকে আমি নানু বলে ডাকতাম
আমি কুর্চি ফুলের মতো সুবাসিত
আর কোন ফুল দেখিনি
আমি আমার মাতামহীর মতো
এমন বিশুদ্ধ আর কোন মানুষ দেখিনি।
তিনি শুধু ভালবাসতেই জানতেন
ছলনা জানতেন না এক রত্তি
তাই বুঝি মন ভোলাতে পারেননি তার পুরুষটির।
তাতে কি
কুর্চি ফুলের মর্ম সকলে বোঝে না
কুর্চি ফুল দেখলেই আমার নানুর কথা মনে পড়ে।
আমার মাতামহী কারো নিন্দা করতেই জানতেন না
কটুকথা কোনদিন শুনিনি তার মুখে
শেষ সম্বলটুকু বিলিয়ে দিয়ে
পরম তৃপ্তিতে নির্ভার হয়েছিলেন;
ফোঁকলা দাঁতে শিশুর মতো হাসতেন।
তার হাসিতে কুর্চি ফুল ঝরে পরতো রাশি রাশি
বুড়োর জন্য দরদ ছিল তার
হাড় জিরজিরে পাঁজরে পাঁজরে।
দূর থেকে তার মঙ্গল কামনা করেছেনন অকাতরে।
আসলে তিনি তো কারো
অমঙ্গল কামনা করতেই জানতেন না।
তিনি যে এসেছিলেন কুর্চি ফুল হয়ে ভবে।
পরিশ্রমে মুক্তোর মতো
স্বেদ বিন্দু জমতো তার কপালে
স্বেদ বিন্দুগুলোও কুর্চি ফুলের মতো ছিল
মুছে ফেলেছেন বার বার
কারো কাছে কোন নালিশ না জানিয়ে।
কুর্চি ফুল দেখলেই আমার তার কথা মনে পড়ে।
তার কোন ঘর ছিল না
যখন যার ঘরে ছিলেন
সে ঘর আপনার ঘরের মতো গুছিয়েছেন।
তাকে আমি আগুনের পাশে
বসে থাকতে দেখেছি
কয়েক যুগ ধরে;
বাড়তে না পারলেও রেঁধেছেন বিরামহীন
আগুনের সাথে তার এমনই ছিল সখ্যতা
না দেখলে বোঝা যাবে না।
তার ছিল নিজস্ব কিছু একান্ত সম্পত্তি
একটি প্লাস্টিকের ছোট ঝুড়ি,
দুখানি কাপড় ধরতো তাতে।
একটি বাঁশের ছেঁচুনি
দাঁত ছিল নাতো বুড়ির,
পান খেতে ভালবাসতেন
সেখানেও ছিল পরিমিতি বোধের মাধুরী
একটি গোটা পান একসাথে খাননি কোনদিন
অর্ধেক বরাবর,
চার ভাগের এক ভাগও খেতেন দাম বেড়ে গেলে।
তাইতো তাকে আমার কুর্চি ফুল মনে হয়,
অলক্ষে সুবাস ছড়িয়েছেন সারাবেলা।
কুর্চি ফুল দেখলেই আমার তার কথা মনে পড়ে।