মৃত্যুতে জীবন পূর্ণতা পায় -পলি শাহীনা

0
645
Poly-Shahina

মৃত্যুতে জীবন পূর্ণতা পায়

পলি শাহীনা

শীতের ভারী কম্বল সরিয়ে অনেকদিন পর আজ প্রকৃতি আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠলো। সে আনন্দে হৃদয়ের অলিগলি, মাঠ ঘাটে বাঁশরি বাজছে সুরে সুরে। আজ প্রথম চোখ পড়লো, পাতাহীন অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোর সবুজ কিশলয়ে। ঘুম ভেঙেই দেখি পাশের বাসার কার্ণিশে, জোড়া ঘুঘু বাসা বাঁধছে ভালোবেসে।

আজ মনের বাগানে, আম-কাঠালের বনে, তেপান্তরের কোথায় যেন কোকিল ডাকছে সুরে সুরে। ঝলমলে রুপোলী রোদের শরীরজুড়ে বাইরে কত প্রজাপতি উড়ছে। আজ আমার ছুটির দিন। বাতাসের ফিসফাস শব্দে ইচ্ছে করছে সর্ষেক্ষেতে হারিয়ে যেতে।

পুকুরের থৈ থৈ জলে ছিপ ফেলতে, কবিতা পড়তে, গলা ছেড়ে গান গাইতে, পাতার বাঁশি বাজাতে। ইচ্ছে করছে পৃথিবী জুড়ে চাষ করি ফুলের বাগান, চারপাশ ভরে উঠুক ফুলেল সৌরভে। ডাঙায় ঘুঘু বাসা বাঁধছে, মনের বনে কোকিল ডাকছে – এমন দিনে ঘরে থাকা দায়!

আমার বাবা-মা নেই। ভাই-বোনেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পৃথিবীর নানান শহরে। ছুটির দিনে মন চাইলেও তাঁদের কাছে যাওয়ার কোন উপায় নেই। এমন সুন্দর মুহূর্তটি কে উদযাপনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ি বাইরে উদ্দেশ্যহীন ভাবে। অবশ্য, মাঝে মধ্যে সময়-সুযোগ পেলেই এভাবে বেরিয়ে পড়ি আমি অজানার পানে।

হাসপাতাল, পর্বত, সমুদ্র, গভীর অরণ্য – এগুলো আমার হারিয়ে যাওয়ার প্রিয় জায়গা। আজ অনেকদিন পর বাসে চেপে বসলাম। চেনা জায়গা ফেলে বাস চলে যায় বেশ দূরে। বাস থামে, কিছু লোক নেমে যায়। আমি ওদের চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থাকি। মনে মনে ভাবি, মানুষগুলোর কি এখানেই নামার কথা ছিল? নাকি তাঁরাও আমার মত গন্তব্যহীন?

ইচ্ছে হলো কোন একটা জায়গায় নামবে, তারপর আমার মত হাঁটতে হাঁটতে কোথাও বসে জিরোবে। চা, কফি খাবে। মানুষ দেখবে। আপনমনে কথা বলবে। কিছু সময় এভাবে কাটিয়ে পুনরায় আপন কুলোয় ফিরে আসবে। আদতে, মানুষের জীবদ্দশায় নির্দিষ্ট কোন ঠিকানা নেই। তাঁরা ঘুরতে থাকে। মানুষের নির্দিষ্ট ঠিকানা অচেনা কিন্তু অজানা নয় ; সেটি হলো কবর। মৃত্যুতে জীবন চক্র পরিপূর্ণ হয়। মৃত্যুতে জীবন পূর্ণতা পায়। মৃত্যু মানুষের জীবনের শেষ এবং পরিপূর্ণ ধাপ।

মাথাভর্তি হযবরল ভাবনার ভীড়ে আচমকা আমিও নেমে পড়লাম বাস থেকে। নেমেই মনে হলো, আমার তো এখানে নামার কথা নয়। ঝমঝম শব্দে বাস চলে যায়। আমি হাঁটতে থাকি। হঠাৎ গুড়িগুড়ি বৃষ্টি নামে। নিউইয়র্ক শহরে আবহাওয়ার কোন বিশ্বাস নেই। এই রোদ তো এই বৃষ্টি, এই ঠান্ডা তো এই গরম। অচেনা পথিক দল ছুটছে আশ্রয়ে, সঙ্গে আমিও দ্রুত পায়ে ছুটতে ছুটতে আশ্রয় নিই একটি হলরুমের সামনের বর্ধিত ছাউনির নিচে। প্রথমে না বুঝে হলরুম ভাবলেও, পরে দেখি এটি একটি ফিউনারেল হোম।

বিভিন্ন সময়ে চলতি পথে ফিউনারে হোমের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও, ফিউনারেলে কোনদিন ঢুকি নি। সঙ্গে ছাতা নেই বলে বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকি। বৃষ্টির গতি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। উজ্জ্বল দিনটি চোখের সামনে ফ্যাকাসে মন্থর দিনের কোলে ঢলে পড়লো। আসলে প্রকৃতি ও মানুষ কোন কিছুই স্থিতিশীল নয়, কোন অবস্থানও চূড়ান্ত নয়। সবকিছু পরিবর্তনশীল। চোখের পলকে বদলে যেতে পারে মানুষ ও প্রকৃতির অবস্থান।

আমার ভাবনায় ছেদ পড়ে গাড়ীর শব্দে।কয়েকটা গাড়ী এসে থামে ফিউনারেলের সামনে। নারী-পুরুষ, বাচ্চাসহ একদল মানুষ সারিবদ্ধ ভাবে ফুলের তোড়া হাতে গাড়ী থেকে নামে। ছাউনির মাঝখান থেকে এক কোণে সরে গিয়ে আমি তাঁদের জায়গা ছেড়ে দিই। ফুল হাতে সুসজ্জিত মানুষগুলো ভেতরে চলে যায়। তাঁদের দলের শেষ জনের পেছনে আমিও ফিউনারেল হোমে ঢুকে পড়ি।

আমি তাঁদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি, মানসিক অবস্থা বোঝার চেষ্টা করি। ছোটবেলা থেকে মানুষ দেখা আমার অন্যতম প্রিয় অভ্যেস। ফিউনারেলে ঢোকা মানুষগুলোর চোখমুখ জুড়ে, আমি একটা উজ্জ্বল আলোর রেখা দেখতে পাই। তাঁদের সর্বাঙ্গে মৃত মানুষটির জন্য থৈ থৈ মায়া খেলা করছে। সবাইকে ফুরফুরে তৃপ্ত দেখালেও ভয়ে আমার গা ছমছম করছিলো। রুমে ঢুকেই চোখ যায় বরফাচ্ছাদিত কফিনের দিকে।

আমি সবার পেছনে দাঁড়িয়ে আছি। এখানে কাউকে হাউমাউ করে কাঁদতে দেখছিনা। সবাই কায়মনোবাক্যে মৃত মানুষটির আত্মার শান্তি কামনা করছে। তাঁদের অনুভূতি প্রকাশ, আলাপচারিতায় বুঝলাম,সবাই ভীষণ খুশি মৃত মানুষটির উপরে। তাঁর চরণে সবাই ফুল সাজিয়ে রেখেছে। এরমধ্যে একজন এসে মৃত মানুষটির পরিচয় সম্বলিত একটি কার্ড হাতে ধরিয়ে দেয়। আমি পড়তে থাকি। লোকটি জীবদ্দশায় একজন শিক্ষক ছিলেন।

সকলের সঙ্গে তাঁদের ধর্মীয় নিয়মানুযায়ী আমিও প্রার্থনায় যোগ দিই। প্রার্থনা শেষে মৃত মানুষটির স্বজনদেরকে দেখলাম, তাঁরা একে একে লোকটির মাথার কাছে গিয়ে আদর করছে। ময়ুরের মত পেখম তুলে একটা বাচ্চা মেয়েকে দেখলাম টুক টুক করে হাঁটছে, আর সবাইকে দেখাচ্ছে মৃত মানুষটির সঙ্গে তার শেষ তোলা ছবিটি। আমাকেও দেখালো। ছবিতে মেয়েটিকে কোলে নিয়ে আদর করে খাওয়াচ্ছে মৃত লোকটি।

বাচ্চাটি তাঁকে পরম ভালোবাসার মমতায় স্মরণ করছে। ছবির মানুষটিকে চুমু খাচ্ছে। আমার আপাদমস্তক জুড়ে কেমন বিবশ করা অনুভূতি বোধ হলেও, সবাইকে দেখলাম বেশ প্রাণবন্ত, হাসিখুশি। একে অন্যের সাথে মৃত মানুষটির সঙ্গে কাটানো সময়ের সুখকর গল্প করছে, সবাই তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

কেউ বলছে লোকটি জলের মত শান্ত ছিল, কেউ বলছে বন্ধুবৎসল ছিল। কেউ বলছে বিনয়ী, কেউ বলছে মানবিক ছিল। সবার কথায় আমি বুঝলাম – মৃত লোকটি একজন ভালো মানুষ ছিলেন। তাঁর জীবদ্দশায় যত্নে গড়া পরিবার, স্বজনের মাঝে মৃত মানুষটির প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে দশদিক আলো করে।

সবার সঙ্গে আমিও বেরিয়ে আসি ফিউনারেল হোম থেকে। ততক্ষণে বৃষ্টির গতি কমে গেছে। ফিরতি বাসে উঠে পড়ি গন্তব্যের দিকে। বাসে বসে মনে পড়ে আমার এক পরিচিত জনের কথা। তিনি বেশ সম্পদশালী মানুষ হলেও, স্বভাবে কিছুটা কৃপণ প্রকৃতির ছিলেন। টাকা -পয়সার বিষয়ে পরিবার এবং স্বজনদের সঙ্গে রুঢ ব্যবহার করতেন। স্বজনরা সাহায্য চাইলে বিরক্ত হতেন।

শুনেছি ঈদের দিনে নাতি-পুতিদেরকে সালামি পর্যন্ত দিতে চাইতেন না। তাঁর নিজের স্ত্রী, সন্তানদের আর্থিক প্রয়োজনেও কার্পণ্য বোধ করতেন। বাড়ী ভাড়া নিজের কাছে রাখতেন। পরিবারের মৌলিক চাহিদা পূরণেও তিনি কঠিন হস্তের মানুষ ছিলেন। তাঁর মনে কি ছিল কে জানে? মানুষ সম্পদ কিনে, নাকি সম্পদ মানুষকে কিনে নেয়, জানিনা।

তাঁর মৃত্যুর পর দেখেছিলাম, তাঁর পরিবার, স্বজনেরা সবাই শুকনো মুখে ঝিম মেরে বসে আছে। কারো মুখে কষ্ট কিংবা উচ্ছ্বাস কোনটাই নেই। তাঁকে নিয়ে কেউ কথা বলছেনা। এমন কি তাঁর সন্তানদের মাঝে শোকের কোন আবহ দেখলাম না। সবাই যেন অপেক্ষার প্রহর গুনছে।

পরে শুনেছি মৃতদেহ দাফনের তিন দিনের মধ্যেই, তাঁর ছেলে-মেয়েরা উকিল ডেকে এনেছেন ঘরে, সম্পদ ভাগের জন্য। লোকটি জীবদ্দশায় পরিবার, আত্মীয়- স্বজনদের সঙ্গে যেমন ব্যবহার করেছেন, মৃত্যুর পর সবার থেকে সেই ব্যবহার ফেরত পেয়েছেন৷ এটাই প্রকৃতির নিয়ম। জীবিত অবস্থায় মানুষ যেমন জীবন যাপন করবেন, মৃত্যুর পর আপনজনদের স্মৃতিতে তিনি সেভাবেই স্থান পাবেন, প্রস্ফুটিত হবেন।

বাসায় ফিরে সবার আগে ভালো করে হাতমুখ ধুয়ে নিই। বাসা তো শুধু বাসা নয়, এখানে পাতা আছে এক মোহনীয় স্নেহ – মমতার জাল। যে মায়াজাল ছিন্ন করে কোন মানুষ পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে চায় না। বিশ্বজুড়ে এখন করোনা ভাইরাস ভয়ে ভুগছে গোটা মানুষ প্রজাতি। আমিও একদম তার ব্যতিক্রম নই। নিজের এবং পরিবারের সু রক্ষার্থে পুরো ঘর লাইসোল ডিসিনফেকটেন্ট দিয়ে স্প্রে করে নিয়েছি।

ইতিমধ্যে খবরে জেনেছি, চীন থেকে ছড়িয়ে পড়া কভিড-১৯ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে লক্ষাধিক মানুষ। এরমধ্যে সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে গেছেন পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি মানুষ। ক্যালিফোর্নিয়ার সঙ্গে নিউইয়র্কেও জারি করা হয়েছে জরুরি অবস্থা। সবার সাথে আমি এবং আমার পরিবারও ভীতসন্ত্রস্ত। মৃত্যু ভয় মোটামুটি সবাইকে তাড়া করে ফিরছে।

ঘরের কাজ শেষ করে চা নিয়ে বসি প্রিয় জানালার পাশে। এখান থেকে আকাশ অনেকদূর দেখা যায়। আকাশের বুক জুড়ে গোল থালার মত চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলো হুটোপুটি খাচ্ছে আমার ঘরজুড়ে। এই এক অবর্ণনীয় স্বর্গীয় সুখের দৃশ্য। যে দৃশ্য শুধু অনুভব করা যায়, বর্ণনা করা যায় না। ছোটবেলা থেকেই চাঁদ ছিল আমার মনের একটি রহস্য ভাবনা।

এখনকার মত প্রযুক্তির নিত্য নতুন চোখ ধাঁধানো, মন কাঁপানো উন্মাদনার হাতছানি ছিল না আমার চারপাশের জগতে। প্রকৃতির সবুজ আদরে বেড়ে উঠা আমার সময় কাটতো -ফুলের বনে, পাখীর গানে, প্রজাপতির পাখায়, বৃষ্টি জলে, নিঝুম সন্ধ্যার জোসনা দলে আর আমার মায়ের আদর মাখা আঁচল তলে। এমন চাঁদনি রাতে শিশির ভেজা সুপারি পাতা, নারিকেল পাতার সৌন্দর্য আস্বাদনে বেরিয়ে পড়তাম ঘর ছেড়ে।

মায়ের হাত ধরে এমন চাঁদনি রাতে নানার বাড়ী থেকে আসার সময় বলতাম, ‘ আম্মা দেখেন চাঁদ হাঁটে আমাদের সাথে।’ আমার কথা শুনে আম্মার মুখে চাঁদের হাসি গলে গলে পড়তো। আকাশে চাঁদের হাসি, জমিনে মায়ের হাসি, মাঝখানে আম্মার হাত ধরে দু’বেণি দুলিয়ে পথে হাঁটতাম আমি রাজকুমারি।
আমি চাঁদের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকি। আজ আমার পাশে আম্মা নেই। হাত ধরে কেউ পথ পার করে দেয় না। আমি একাই পথ চলি। আম্মার কথা মনে পড়ে বুক ভারি হয়ে উঠে ।

প্রতিটি জীবনকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। মৃত্যু জীবনের একটি অতি স্বাভাবিক অবধারিত প্রক্রিয়া। আমার মা চলে গেছেন, আমিও তাঁর পথ ধরে চলে যাব একদিন। কার জীবনের সমাপ্তি কখন, কিভাবে ঘটবে কেউ জানে না৷ মৃত্যু থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কোন পথ নেই জীবনে।

মৃত্যু মানুষের জীবনের পরিপূর্ণ চক্র বৈকি আর কিছু নয়। মৃত্যু প্রতি মুহূর্তে আমাদের পেছনে হাঁটছে। এই মায়ার সংসার, আপনজন, পৃথিবীর চিত্ত কাড়া এত এত বর্নিল রুপ ছেড়ে মানুষ যেতে না চাইলেও, তারপরও মৃত্যুকে বরণ করতেই হবে। মূলতঃ মৃত্যু জীবন কে পরিপূর্ণ করে তোলে।

বাবা-মা গত হওয়ার পর থেকে আমিও মৃত্যুকে বরণ করার জন্য যেন সদা প্রস্তুত হয়েই থাকি। শুধু আল্লাহর কাছে দোয়া করি, মৃত্যুর আগে যেন আমার উপর অর্পিত সন্তানদের দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করে যেতে পারি। আজ ফিউনারেল থেকে বাসায় ফিরে মনে হলো, মৃত্যু স্নিগ্ধ সুন্দর। জীবনের অতিবাহিত সময়ে চারপাশ জুড়ে যে মানুষ যত বেশি সুন্দরের চর্চা করবে, তাঁর মৃত্যু তত বেশী সুন্দর হবে।

লেখাটি নিউইয়র্ক থেকে ‘সাপ্তাহিক বাঙালী’ তে প্রকাশিত হয়েছে ।

Advertisement
উৎসPoly Shahina
পূর্ববর্তী নিবন্ধকরোনা ও গজব ভাইরাস -ভায়লেট হালদার‘এর অনুগল্প
পরবর্তী নিবন্ধভালোবাসা কারে কয়? -কবি কামরুন্নাহার‘এর কবিতা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে