‘সাহিত্য একাডেমি, নিউইয়র্ক’র মাসিক ১১০তম আসর !- বেনজির সিকদার
ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, ‘সকলের সহিত মিলেমিশে যা উপভোগ করা যায় তাই সাহিত্য। সাহিত্যে সকল মনের সাহায্য থাকে। সাহিত্যের পাত্র-পাত্রী সবই একটা টাইপ বা নমুনা।’
প্রতিমাসের শেষ শুক্রবার অনুষ্ঠিত হওয়া ‘সাহিত্য একাডেমি, নিউইয়র্ক’র মাসিক সাহিত্য আসরটিও যেন তাই।
এখানে নতুন-পুরাতনে হয় দৃষ্টি বিনিময়, সন্ধি। আলাপ চারিতায় ঘটে চোখের সাথে চোখের চরাচর। অনুভূত হয় আত্মিক বন্ধন-প্রেম। এগিয়ে যায় সম্পর্ক। উপভোগের নিমিত্তে একজন অপরজনকে শুনি। কারও কারও লেখা ঔজ্জ্বল্যের উত্তেজনায় ভরিয়ে দেয় মন। শব্দ-বাক্য-গল্প, অতঃপর মর্মর নিক্কনে সেগুলো হয়ে ওঠে বড় বেশি দৃঢ়। জীবন সূত্রকে ছুঁয়ে মনের মাঝে তৈরি করে যেন এক আদুরে-প্রেমালু অনুপ্রাসের ঢেউ জাগানিয়া। কখনোবা মর্মর শব্দে বুকের ভেতর ধাক্কা লাগে, কিন্তু বড় আলগোছেই খেয়াল করি সে ধাক্কায় কোনো প্রকার কষ্ট কিংবা সুচ্যগ্র পরিমান সংঘর্ষেরও সৃষ্টি হয়না।
জো
শুধু তাই নয়, একেকটা আসর যেন স্বপ্ন পূরণের একেকটা ধাপ। সিঁড়ি। মনের ভেতর খসড়া তৈরী হবার পাশাপাশি নির্বাপনশীল প্রতিটি ধাপেই যুক্ত হয় নতুন কিছু অভিজ্ঞতা, আশা-প্রত্যাশার দোলাচল সাথে গল্পের দুর্লভ সৌন্দর্য। যে গল্প সম্মুখপানে অগ্রসর হতে জাগায় অসীম প্রেরণা।
কেবল মাত্র আমি-ই নই, হলফ করেই বলা যায়—
অন্তত আসর চলাকালীন সময়টুকুতে সকলের মননেই আলোড়ন তৈরী হয়।চিন্তার গতি হয় উৎসুক। দু’দন্ডের জন্য হলেও থমকে দাঁড়ায় সকলে।
এবারের আসরে ওয়াশিংটন ডি সি হতে আগত ভয়েস অব আমেরিকার প্রবীণ সাংবাদিক আনিস আহমেদ এর কবিতা সম্পর্কিত জ্ঞানগর্ভ আলোচনাও ছিল আবেশিত হবার মতো তেমনই এক জাদু মাখা নব উপলব্ধি।
শুনছিলাম লেখক হাসান ফেরদৌসের ‘কবিতার শক্তি’ নিয়ে বিশেষ আলোচনা। কবি তমিজ উদদীন লোদী, লেখক সুরীত বড়ুয়া, অধ্যাপিকা হুসনে আরা সহ লেখক সোনিয়া কাদির, এমনকি লেখক এবিএম সালেহ উদ্দীন এর কথামালায়ও ছিল রপ্ত করবার মতো ইন্দ্রিয়ময় অনুভূতি।
পজেটিভ কথা অবশ্যই একটি বিশ্বাসের দৃঢ়তার নাম। দীপ্তির ব্যাপ্তিতে স্থিতবুদ্ধির বিচার। কলমকে পাথেয় করে যাঁদের সামনে চলা তাঁরা তো কেবল সৌন্দর্যেরই উপাসনা করতে চায়। শুধু মাত্র মুখে মুখেই নিজেকে নৈর্ব্যক্তিক বলে দাবি করা নয়; যেভাবে জানকী তাঁর অলংকার ফেলতে ফেলতে গিয়েছিলেন, কেউ এসে পথ চিনে নিবে ভেবে। ঠিক তেমনি ভাবে তাঁরাও অপরের জন্যও ছাপ রেখে যেতে চান।
কোনো প্রগলভতা নয়, তাঁদের শানিত মধুর কথাগুলো হৃদয়সঙ্গী রূপে অবলীলায় ঢুকে পড়ে গহীনে। নির্দেশ করে ব্যক্তির সৌন্দর্যরেখা। কখনো কখনো হয়ে যাই স্তব্ধভাগ। একান্ত নিজস্বতায় মনের মাঝে ঘটে চলে ডুব সাঁতারের দৌড়।
অতঃপর বিচিত্র ঘোরলাগা রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে বহু পথ আর বহু গলিঘুপচি পরিভ্রমণ করে পৌঁছুতে চাই সারৎসার ময় অনিন্দ্য সুন্দর এক সবুজাভ-স্বপ্নালু ভুবনে !
অবসরে ঢেউ দুলে ছলকে ছলকে উঠে। ভাবতে ইচ্ছে করে বিদেশ বিভুঁইয়ে এমনতরো পরিবেশে সাহিত্য একাডেমি নিউইয়র্ক’র করে যাওয়া কাজটিতো সত্যিই আশ্চর্যজনক এবং প্রায় অসম্ভব একটি কাজ।
সীমিত সময়ের এই জীবন। তবুও সবাই স্বপ্ন দেখি। ভালোবাসি হাজারও সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে সে স্বপ্নের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যেতে।
হয়তোবা কখনো কখনো উপস্থাপন শৈলীর চেয়ে ভাবনার জায়গাটা ভিন্নতর হয়, বড় হয়ে ওঠে। তাৎক্ষণিক ভাবে বোঝাতে পারঙ্গম হয়ে ওঠা যায় না, কিন্তু আত্মিক বন্ধনটা রপ্ত করতে জানলে পরমুহূর্তেই অনায়াসে তা করা যায় হৃদয়াঙ্গম।
হ্যা, বন্ধনটা জরুরি। মায়াটা জরুরি। কোনো কিছুর প্রতি মমতা থাকলে, ভালোবাসা জন্মালে তবেইনা স্পষ্ট আর একরৈখিক হয়ে ওঠার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। মিশে গেলেই আবিষ্কার করা যায় কি গভীর, বহুমুখী, বিচিত্রপন্থী কিংবা বিচ্ছুরণশীল অর্থ লুকায়িত রয়েছে তার পরোতে পরোতে।
অনুভবের তর্জনীতে অনুমেয় হয়, দিনকে দিন অন্তঃসলিলা নদীর মতো নিভৃতে দিগন্তপ্রসার উত্থাপন ও প্রসারণ ঘটে চলার অসাধারনত্ব ! যুগ যুগ ব্যাপী অনুশোচনা কিংবা আহত সত্তায় যন্ত্রণার আক্ষেপ বয়ে চলা নয়… অনুমেয় হয়, একমাত্র কর্ম গুনেই সাধারণ ছাড়িয়ে অসাধারণ তথা দধীচির মতোও হয়ে ওঠা যায় অভিবাদনীয়। অতঃপর পরম গ্রহণ যোগ্যতায় ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হয়ে সুবাসটুকুও ছড়িয়ে দেয়া যায় কাল থেকে মহাকালে।
মনের ভেতরে হাজারোটা প্রশ্ন উঁকি দিতেই পারে। ভাবনার বা চিন্তার জায়গাটা যদি হয় দূরদর্শিতামূলক, তবে অনায়াসেই বোঝা যায় তার তল বা সীমা।
কাজেই শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতের লাল রং দেখতে যেমন পুনরায় গর্ত খুঁড়ে ভেতরে প্রবেশ করতে হয় তেমনি ভাবে ‘সাহিত্য একাডেমি, নিউইয়র্ক’র লালিত স্বপ্নটি, উদ্দেশ্যটি জানতে হলে নিজ হতে—সময় দিয়ে, আত্মিক ভাবে নিবেদিত থেকে বোধ বুদ্ধির মাধ্যমে খননের কাজটি করতে হবে। অধিকতর দক্ষতার সঙ্গেই হোক কিংবা মন্থর-ই হোক, ভাবতে হবে আছি। আছি যে এটাই বড় কথা। এটাই সত্য। খননের জন্য এটাই শক্তি।
কোনো ভুল সংযোগের বোধ কাজ না করুক, না থাকুক কোনো মর্মভাঙা শ্লেষোক্তি; সহজিয়া অভিপ্রেত—
আত্ম উদ্ঘাটনের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা সময়ের পাকানো সকল জট অতিক্রম তথা—
খন্ড খন্ড মমতায় গড়ে ওঠা সম্পর্কের শক্তিকে পাথেয় করে প্রকৃতির মতোই অবধারিত সত্যে ‘সাহিত্য একাডেমি, নিউইয়র্ক’ হয়ে থাকুক চির সজীব…চির সবুজ…।
কেবলমাত্র এমনতর অপরিসর রূপটুকুই নয়, সীমানা বিস্তৃত হতে হতে নাম লেখাক শতক হতে সহস্রাব্দে।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন—
‘পড়াকে যথার্থ হিসাবে যে সঙ্গী করে নিতে পারে, তার জীবনের দুঃখ কষ্টের বোঝা অনেক কমে যায়।’
আসরের নিয়মিত কার্যক্রম বই পড়া কর্মসূচিতে এবারে বিতরণকৃত বই সমূহ:
১. নিঃসঙ্গতার একশ বছর—গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস
২.মন মহাকাব্য—অধ্যক্ষ আবু আব্দুল্লাহেল কাফী
৩.একজন কমলা লেবু—শাহাদুজ্জামান
৪.মৈত্রেয় জাতক—বাণী বসু
৫.ক্রাচের কর্নেল—শাহাদুজ্জামান
৬. পান্থ জনের সখা—আবু সয়ীদ আইয়ুব
৭.মার্জিনে মন্তব্য— সৈয়দ শামসুল হক
৮. শ্রেষ্ঠ কবিতা—বুদ্ধদেব বসু এবং
৯. নিঃসঙ্গ পাতার বাঁশি—হোসাইন কবির