‘৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর ক্যারিশমাটিক নেতৃত্বের বহিঃপ্রকাশ’-কামরুল হাসান কামু
সামনে জনগণ,পেছনে গুলি,প্রস্তুত পাকিস্তানের বোমারু বিমান-এমন এক পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ দিয়েছিলেন।বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন-সারথি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন যদি সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিতেন তবে রেসকোর্স ময়দানেই লাখ লাখ মানুষ শহিদ হতো।তাঁর ক্যারিশমাটিক ভাষণের মাধ্যমে একই সাথে তিনি যেমন জনগণের কাছে স্বাধীনতার বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন তেমনি পাকিস্তানের অগণতান্ত্রিক স্বৈরশাসকের ভীত নড়ে ফেলেছিলেন ও বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতার জন্যে একত্রিত হওয়ার যে দৃশ্য তা পৌঁছাতে পেরেছিলেন।
৭ মার্চের সেই মহাকাব্যিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু ধারাবাহিকভাবে স্বাধীনতা ও গেরিলাযুদ্ধের দিক-নির্দেশনা দিয়েছিলেন।তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের পর বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে ও আওয়ামীলীগকে ভোট দেন।আমাদের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বসবে,আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরী করবো এবং এদেশকে আমরা গড়ে তুলবো।’ এই বক্তব্যে তার গণতান্ত্রিক মনোভাব ফুটে উঠেছে।তিনি বলেন, ‘ ২৩ বছরের ইতিহাস মুমূর্ষু নরনারীর আর্তনাদের ইতিহাস।’তিনি এই বক্তব্যে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর তীব্র নির্যাতন,নিপীড়ন ও মৌলিক অধিকার বঞ্চিত পূর্ব- বাংলার চিত্রাঙ্কিত করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন অসাম্প্রদায়িক মনোভাব লালন করে ছিলেন।তিনি সেদিনের ভাষণে বলেন, ‘এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-অবাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই,তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপর,আমাদের যেন বদনাম না হয়।’ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্লোভী ছিলেন তাইতো তাঁর বক্তব্যে তিনি সুদৃঢ় ভাবে বলেছিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাইনা।আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই।’ সেদিনের সেই মহাকাব্যে বঙ্গবন্ধু,বাঙালি জাতির সকল অধিকারের কথা বলেছিলেন অকপটে।তাঁর বক্তব্যে সেটা প্রতীয়মান হয় ‘এদেশের মানুষ অর্থনীতি,রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে।’ একজন দূরদর্শী নেতা জানেন কিভাবে একটি দেশের মুক্তিযুদ্ধের রোডম্যাপের কথা বলতে হয়,কিভাবে একটি জনযুদ্ধ পরিচালনা করতে হয়।বঙ্গবন্ধু সেদিনের সেই ভাষণে প্রশাসনিক দিক-নির্দেশনা দিয়েছিলেন।তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক গ্রামে,প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো।’ এদেশের নিরীহ বাঙালির হাতে তেমন কোন ভারী অস্ত্রের মহড়া ছিলোনা,তাদের ছিলো মনোবল,তাদের মরার কোন ভয় ছিলোনা।বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির এই মনোবল খুব ভালোভাবে বুঝতেন।
তাইতো সেদিনের সেই বিশ্বনন্দিত ভাষণে তিনি পাকিস্তানের সুসজ্জিত সমরাস্ত্রের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত গেরিলা যুদ্ধের দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন।তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক ঘরে দুর্গ গড়ে তোল,তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে,রাস্তাঘাট যা যা আছে আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে,আমরা ভাতে মারবো,আমরা পানিতে মারবো।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই ঐতিহাসিক ভাষণে সুস্পষ্টভাবে চারটি দাবি উপস্থাপন করেছিলেনঃ ১. সামরিক আইন মার্শাল ল’ উইথড্র করতে হবে ২.সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে ৩. যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে ৪. জনগণেরর প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
স্বাধীনতার স্বপ্ন- সারথি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেদিনের সেই তেজোদীপ্ত,কাব্যিক ভাষণের শেষ অংশে বাঙালির সামনে উপস্থাপন করলেন কাঙ্ক্ষিত বাণী।তিনি বললেন, ‘ মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি,রক্ত আরো দেবো।এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ্।এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।জয় বাংলা।’ সময়ের প্রয়োজনে এমন বক্তব্য শুধুমাত্র ক্যারিশমাটিক লিডারশীপের কারণে জাতিরজনক লাখ লাখ মানুষের সামনে উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন।তিনি যদি সেদিন বক্তব্যে গণতন্ত্রের পরিবর্তে বিচ্ছিন্নতাবাদের কথা বলতেন তাহলে পাকিস্তানের স্বৈরশাসকেরা রেসকোর্স ময়দানকে কসাইখানায় পরিণত করতো।।হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি,যাঁর স্বপ্নে প্রোথিত ছিলো আমাদের স্বাধীনতার স্বর্ণালী অলংকার তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক- কৃষিবিদ কামরুল হাসান কামু।