আরেকটি ঘরবন্দী ঈদ -পলি শাহিনা

0
482
Poly Shahina

আরেকটি ঘরবন্দী ঈদ

সাহিত্যিক পলি শাহিনা

ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি। মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসবের দিন ঈদুল ফিতর আমাদের দোরগোড়ায়। সাধারণত, ঈদের আনন্দ সবাই একত্র হয়ে উদযাপন করে, কিন্তু গত বছরের মতো এবছরও তা খুব একটা সম্ভব হবে না। কারণ, গোটা বিশ্ব এখনও অবরুদ্ধ কোভিডের কারণে। এ ভাইরাসের প্রকৃতি খুব দ্রুত পরিবর্তন হয় বলে মানুষ টিকা নিয়েও আগের মতো স্বস্তিতে মেলামেশা করতে ভয় পায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোভিড মানিয়ে নেয়া এক আতঙ্কের নাম।

বাকি জীবন ভয়ে কাটিয়ে দিতে হবে কীনা, জানিনা। গতবছরের মতো এবারও মুসলিম উম্মাহর অন্যতম প্রধান ধর্মীয় এ উৎসবের দিনটি অনেকটা ঘরবন্দী হয়েই কাটাতে হবে। করোনা পূর্ব পৃথিবীর মতো উচ্ছল- উচ্ছ্বাসে করোনাগ্রস্ত এ পৃথিবীতে নির্ভয়ে ঈদের দিন বন্ধু-আত্মীয়স্বজন-প্রতিবেশীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিলিত হওয়া হবে না। অদৃশ্য একটা ভয় সারাক্ষণ তাড়া করে ফিরবে মানুষকে।

একমাস সিয়াম সাধনার পর ইচ্ছেমতো আনন্দে দিনটিকে আগের মতো আর উদযাপন করা সম্ভব হবে না, কিংবা খাবার টেবিলে আয়োজন করে প্রতিবেশীদের সঙ্গে মিষ্টিমুখ করা হবে না, ভেবে মন খারাপ হয়। কথা আছে, আনন্দ ভাগে দ্বিগুণ হয়। আনন্দ সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিলে আরও বেড়ে যায়। স্থান, কাল, পাত্র, সমাজ, সামাজিক অবস্থান, পরিবেশ, পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে আনন্দের সংজ্ঞা বদলে যায়।

আমার ছোটবেলায় রমজান মাসের শুরুতেই বা এর আগে থেকেই ঈদের নতুন জামা কেনার উম্মাদনায় ভেসে যেতাম। এদেশে বাচ্চাদের মধ্যে ঈদের নতুন জামা কেনার উপচে পড়া আনন্দের ঢেউ চোখে পড়ে না। চোখে পড়বেই বা কীভাবে! ওই যে স্থান, পরিবেশ, পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে আনন্দের স্বরুপ বদলে যায়! আমার শৈশবে ঈদের অন্যতম মূল আকর্ষণ -ই ছিল নতুন জামাটিকে ঘিরে।

এদেশের বাচ্চারা গোটা বছরজুড়ে নতুন জামা পায় বলে ঈদের নতুন জামাটিকে ঘিরে ওদের মনে আনন্দের শিহরণ অনুভূত হয় না। বিষয়টি অতি স্বাভাবিক। গোটা রমজান মাসজুড়ে পরিকল্পনা করতাম ঈদের দিন বন্ধুরা মিলে কোথায় বেড়াতে যাব! এদেশের বাচ্চারা বছরের বিভিন্ন সময়ে স্কুলছুটির মরশুমে দেশ এবং দেশের বাইরে নানান দর্শনীয় স্থানে বেড়াতে যায় বলে ঈদের দিনটিকে ঘিরে বেড়াতে যাওয়ার তেমন কোন উল্লেখযোগ্য হৈ-হুল্লোড় দেখি না।

ঈদের দিন মায়ের হাতে রান্না করা সেমাই – পায়েস, কোর্মা- পোলাও খাওয়ার জন্য পুরো রমজান মাস অধীর আগ্রহ ভরে অপেক্ষায় থাকতাম। এদেশের বাচ্চারা প্রায় প্রতিদিন এগুলো খায় কিংবা বেশ সহজলভ্য বলে, ওরা ঈদের দিন মায়ের হাতের অন্যরকম অমৃতসম খাবারের স্বাদ পায় না। আমার ছোটবেলার মতো ঈদের দিনের রান্নার ফর্দ বানানোর তাড়াও নেই ওদের।

এখনকার মায়েরা কী আগেরকার দিনের মায়েদের মতো বাচ্চাদের পছন্দমতো খাবার বানিয়ে রাখেন কীনা ঈদের দিন, কি জানি! ঈদের আগের দিন সন্ধ্যায় হৈ হৈ রৈ রৈ চাঁদ দেখার যে কি ফূর্তি, এ দেশের বাচ্চারা তা জানেই না। ঈদের দিন রাতে হাতে মেহেদী লাগানো, ঈদের দিনের রান্নার কাজ রাত জেগে এগিয়ে রাখা, ভাইবোন দলবেঁধে ঘর পরিষ্কার করা, রঙিন কাগজ কেটে কিংবা ফুল দিয়ে জানালার গরাদ সাজানো, উঠোনের দু’পাশে গাছেদের শরীরে রঙ লাগানো, ঈদের দিন পুকুরে হল্লা করে গোসল, নতুন জামা পরে সুগন্ধি লাগিয়ে ঘরের বড়দের সালাম করে সালামি সংগ্রহ শেষে ঈদগাহে যাওয়া, আরও কত কী!

এককথায়, ঈদের দিন আনন্দের শেষ হতো না! আসলেই, স্থান, কাল, পাত্র বেদে শুধু আনন্দের সংজ্ঞা নয়, জীবনের অন্য আরও অনেক অনুষঙ্গের সংজ্ঞাও পাল্টে যায়। আমার দেখা ঈদের চিরাচরিত সনাতনী আবহের অনেক কিছুই এদেশে উল্লেখ করার মতো চোখে পড়ে না। ঈদ শব্দটি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গেই আমার মানসপটে ঝলমলে যে চিত্র ভেসে উঠে, তা এখন আর দেখি না।

করোনাক্রান্ত এ সময় যে চিত্রটি আমার মনের গভীর অরণ্যে বারবার দোল খাচ্ছে, তা হলো কোলাকুলি করা। কোলাকুলির সঙ্গে আমার স্বর্গীয় আনন্দ জড়িয়ে আছে। বাবা ছিলেন খুবই অন্তর্মুখী চরিত্রের স্বল্পভাষী মানুষ। বছরজুড়ে তাঁর হাঁটার শব্দ শুনলেই চুপচাপ দূরে সরে যেতাম। তাই বলে কোনদিন মনেও পড়ে না শাসন করেছেন কিংবা উচ্চস্বরে কথা বলেছেন। আম্মার কাছে শুনেছি ছোটবেলায় অন্য ভাইবোনের মতো আমাকেও মশারির নিচে কোলে নিতেন, আদর করতেন।

আজ খুব বুঝি আব্বা কিছুটা লাজুক প্রকৃতিরও ছিলেন। তাঁকে ঠিক বুঝতাম না। তো একমাত্র ঈদের দিন নামাজ থেকে ফিরে বাবা আমাকে তাঁর বুকের সঙ্গে অনেকক্ষণ জড়িয়ে রাখতেন। পাখীর বাচ্চার মতো বাবার বুকে নির্ভয়ে স্বর্গীয় সুখে লেপ্টে থাকতাম। আজ বাবা বেঁচে নেই। ঈদের দিন বাবার সঙ্গে কোলাকুলির হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি আমাকে শুধু কাঁদায়। ঈদের আগে থেকেই মাটির ব্যাংকে পয়সা জমাতাম। কখনো কখনো এক টাকার নোটও রাখতাম। এক টাকা মাটির ব্যাংকে জমানোর আনন্দে বাতাসে ভাসতাম।

আহা! এক টাকার সে কী আনন্দ! আমি এবং আমার ছোটভাই সাজু একসঙ্গে টাকা জমাতাম ঈদের দিনের জন্য। ঈদের দিন সকালে মাটির ব্যাংক ভেঙে দু’জন মিলে টাকা ভাগ করতাম। একসঙ্গে ঈদগাহে যেতাম। মাটির পুতুল, পালকি, টিয়াপাখি সহ নানান খেলনা কিনতাম। বায়োস্কোপ দেখতাম। ধূলা মিশ্রিত আচার খেতাম। রঙিন কাঠির লজেন্স কিনতাম। মনে পড়ে একবার কিছু টাকা বেঁচে যাওয়ায় মায়ের জন্য পিঠা বানানোর একটা ছাঁচ নিয়ে আসি।

মায়ের হাতে সেটি দেয়ার পর মা আমাদেরকে বুকে জড়িয়ে নেন। তাঁর চোখে সেদিন স্পষ্ট পানি দেখে জিজ্ঞেস করেছিলাম, পছন্দ হয় নি আম্মা? উত্তরে মা আরও বেশি শক্ত করে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরেছিলেন। সেদিন মায়ের চোখের পানির অর্থ না বুঝলেও, আজ বেশ বুঝি। বাবা-মায়ের কথা ভেবে ঈদের দিন কোলাকুলির স্মৃতি আমার বিশেষভাবে মনে পড়লেও, এ দিনে মানুষ ভেদাভেদ ভুলে একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করার দৃশ্যটি সত্যিই মধুর ছিলো।

ঈদের দিন পারস্পরিক শত্রুতা, মনোমালিন্য ভুলে একে অপরের সঙ্গে হাত মেলাতেন, বুকে বুক মিলিয়ে আলিঙ্গন করতেন। খুব কাছে থেকে দেখেছি, বছরজুড়ে বাকবিতন্ডায় লিপ্ত থাকা মানুষটাও ঈদের দিন একে অন্যকে বাড়ীতে নিয়ে আপ্যায়ন করতেন। ফলস্বরূপ, তাঁদের পরস্পরের শত্রুতা ভাব দূর হয়ে ভ্রাতৃত্ব জেগে উঠতো। যা এ করোনার দিনে ঈদের দিন অনেকেই করবেন না হয়ত।

করোনার কারণে এ দূরত্ব ঘোচাবার সুযোগ থেকে মানুষ বঞ্চিত হবে। ঈদের দিন বাড়ি বাড়ি ঘুরে খাওয়া -দাওয়া, যা এ সময় ভাবাও নিষেধ। বিকেলবেলা মায়ের সঙ্গে নানার বাড়ী যেতাম। মায়ের উদ্দেশ্য তাঁর পরিবারকে দেখা হলেও আমার খাঁটি উদ্দেশ্য ছিল সালামি সংগ্রহ করা। নানা-নানি, মামা-মামি সহ বয়োজ্যেষ্ঠ সবাইকে সালাম করে টাকা নিতাম। ঈদের দিন ধনী -দরিদ্রের ব্যবধান কমে যেত।

মনে পড়ে, ঈদের দিন কোন ভিখারিকে আম্মা পেটভরে না খাইয়ে বিদায় দিতেন না। এই দূর পরবাসে বসে ভাবছি, অবস্থাসম্পূর্ণ মানুষরা কি তাঁদের দরজা গরীবদের জন্য এ বছর উম্মুক্ত করবেন! যদিও ধর্মীয়ভাবে গরীবদের সঙ্গে নিয়ে ঈদ পালন করা বাধ্যতামূলক। ঈদের নামাজের পূর্বেই তাঁদের পাওনা পরিশোধ করার নিয়ম রয়েছে। ঝর্ণা যেমন পাহাড় থেকে নেমে ভূমিতে ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি ছোটবেলায় দেখেছি বিত্তবানরা ঈদের দিন তাঁদের সম্পদ নিয়ে গরীব -মিসকিনদের মাঝে ছড়িয়ে পড়তেন।

ঈদের দিন ধনী – গরীবের মুখে একইরকম হাসি প্রস্ফুটিত হতো। আসলে করোনা গোটা বিশ্বের স্বাভাবিক চালচিত্র বদলে দিয়েছে। তথ্য প্রযুক্তির এ সময় বেশীরভাগ মানুষ এমনিতেই কেমন যেন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। একজন আরেকজন হতে দূরে সরে যাচ্ছে। করোনা যেন মানুষের এ দূরে সরে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করেছে। মানুষের মাঝে দূরত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বিত্তশালীরা আরও বিত্তবান হচ্ছেন, গরীবরা আরও গরীব।

জগতে অভাবের চেয়ে বড় কোন অসুখ নেই। শৈশবে পরিবার – আত্মীয় – প্রতিবেশীদেরকে দেখে যে শিক্ষা পেয়েছি, জীবনের বড়বেলায় এসে আমিও সে শিক্ষা মেনে চলার চেষ্টা করছি।ঈদ সমাগত। ঈদের আনন্দের বদলে বিষাদের একটা অদৃশ্য বাষ্প উড়ছে চতুর্দিকে। গোটা পৃথিবীটাই আজ যুদ্ধক্ষেত্র। প্রতিটি মানুষ লড়ছে এ যুদ্ধে। জীবন -মরণের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আনন্দ করা যায় না। আমার শেকড় পোঁতা বাংলাদেশে।

আমি কিছুটা স্বস্তিতে থাকলেও আমার দেশ, পরিবার স্বস্তিতে নেই। মানুষ চাইলেও একা ভালো থাকতে পারে না। একা মরে যাওয়া যায় কিন্তু একা বাঁচা যায় না। কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছি, পৃথিবী সেরে উঠুক এ মহামারী থেকে। মানুষের মঙ্গল হোক, আরও ভালো হোক। ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ুক ঈদের আনন্দ, শান্তি ও সমৃদ্ধি। ঈদের আনন্দ হোক একযোগে সবার আনন্দ। রমজান মাসজুড়ে পাওয়া শিক্ষা – সংযম ও মানবতার আলোকজ্জ্বল পথ ধরে আমরা যেন এগিয়ে যেতে পারি সম্মুখে।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে করোনা ভাইরাস সহজেই বিদায় নিচ্ছে না এ গ্রহ থেকে। যদিও ইতিমধ্যে আমরা অনেকেই টিকা নিয়েছি এবং গত বছরের চেয়ে এ বছর কিছুটা স্বস্তিতে আছি। তবে বাংলাদেশ, ভারতসহ অনেক দেশ, স্থান অবিরত লড়ছে এ অদৃশ্য অনুজীবের সঙ্গে। ইন্ডিয়ায় অক্সিজেনের প্রয়োজন, বাংলাদেশে করোনাক্রান্ত রোগীদের জন্য হাসপাতালে পর্যাপ্ত জায়গা নেই। পাশ্ববর্তী দেশ কানাডা লকডাউনে।

পৃথিবীর আরও অনেক দেশ, স্থান বিপর্যস্ত এ মহামারীর সঙ্গে লড়াই করতে করতে। সংবাদ মাধ্যমে এসব সংবাদ যখন দেখি তখন ঈদের আনন্দ বিষাদে রুপ নেয়। চোখের ঘুম উড়ে যায়। মনে প্রশান্তি পাই না। করোনার ভয়াল থাবায় আমাদের ঈদ আনন্দ মুখ থুবড়ে পড়ে আছে গৃহকোণে। মানুষ ভয়ে থমকে আছে ঘরের কোণে। স্বপ্ন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। হয়ত নির্ভয়ে আগামী বছর আমরা আবার মেতে উঠবো ঈদের আনন্দ উল্লাসে। সুদিনের এমন ঝলমলে স্বপ্ন দেখি খুব করে।

Advertisement
উৎসPoly Shahina
পূর্ববর্তী নিবন্ধবাবার চশমা -কবি আজাদুর রহমান‘এর কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধনাটোরের জেলা প্রশাসক পরিবার নিয়ে ঈদ উদযাপন করলেন এতিম শিশুদের সাথে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে