“ইছামতী-সংলগ্ন জনপদের জন্মমৃত্যু-উপাখ্যান” – অমিতকুমার বিশ্বাস

0
845
Bivuti

ইছামতী-সংলগ্ন জনপদের জন্মমৃত্যু-উপাখ্যান” – অমিতকুমার বিশ্বাস

এক প্রলয়ঙ্কর প্লাবনের প্রভাবে বনগ্রাম মহকুমার নিম্নভূমি ১৮৮৯ হইতে ১৮৯১ পর্যন্ত জলতলে আত্মগোপন করিয়াছিল। আপনার ইচ্ছায় জল সরিলে ইছামতীর দক্ষিণপার্শ্বে বনগ্রাম শহরের খয়রামারী হইতে গোপালনগর থানার অন্তর্গত শ্রীপল্লি গ্রাম পর্যন্ত প্রকাণ্ড এক বালুচর পড়িয়াছিল। ইহাতে ইছামতী কিঞ্চিৎ বামপার্শ্বে সরিয়া যায়, আর দক্ষিণপার্শ্বে আপন বিস্তার হারাইতে থাকে ক্রমশ। প্রকাণ্ড মরুভূমির ন্যায় সেই ধূধূ বালুচরে সূর্যালোকে কোনও প্রাণীর আসিবার সাহস ছিল না তখন। সময় ঢের হইল পার। সেথা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্লাবনে কাদাজল আসিয়া জমিল, জল সরিলে বালির উপর জমিল কাদা, আর কাদার উপর উলুখড়-নলখাগড়া-বন্যেবুড়োর প্রাণ ভাসিয়া আসিল। পাখিদের চঞ্চুতে আসিল বাবলা-খেজুরবীজ। বাঘ আসিল, বাঘরোল আসিল, ভাম-শেয়াল-হায়না-বুনোখরগোশ আসিল। চার মাইল দীর্ঘ ও আধ মাইল স্ফীত প্রকাণ্ড রূপকথার রুপোলি মীণ ইছামতী হইতে উঠিয়া ডাঙ্গার জীবকুলের তরে প্রাণের মায়াত্যাগ করিয়া রাখিয়া গেল ভাবীকালের এক মনোরম কথকতা। দিঘিরপাড়, বিচালিহাটা, খেলাঘর ময়দান, বনগ্রাম থানা, ট-বাজার, স্টেডিয়াম, বনগ্রাম শ্মশান, দীনবন্ধু মহাবিদ্যালয়, চাঁপাবেড়িয়া ও পোলতার উত্তরাংশ, নূতন গ্রাম, চালকি ও চরচালকি, শিবপুর, বারাকপুর ও শ্রীপল্লির নদী-সংলগ্ন ভূ-ভাগ ধীরে-ধীরে এই বালুচরের উপর গড়িয়া উঠিয়াছে। একদিন মানুষ গাইল, “কী আশায় বাঁধি খেলাঘর বেদনার বালুচরে…”। বালুচর জাগিলে মানুষের চিরকালীন বেদনাও বুঝি-বা সেথা জ্যোৎস্নার সহিত খেলা করিতে থাকিল অবিরাম। শ্যামলগালিচা-পাতা ভূ-ত্বকে সেইসব বালু চমকাইল না আর, কিন্তু বেদনা পিলে চমকাইতে থাকিল ক্ষণে-ক্ষণে, নদীনখরতলে অর্ধ-নিদ্রারত পুরুষরে সোহাগ কিংবা জিঘাংসায় ফালাফালা করিতে থাকিল পুষ্পশয্যায়। হস্তিনাপুর রাজনের ক্ষমতা কী এত যে নদীরে বাঁধে—–বাহু, বিবাহ কিংবা প্রস্তরখণ্ডে? নদী নদীর আপন পথে আপন ইচ্ছায় একদিন জনপদ ছাড়িয়া সাগরে মিশিবেই, রাখিয়া যাইবে পলি ও পলার চিহ্ন।

জীবন ও মৃত্যুর ন্যায় নদীর অনিবার্য ক্রীড়া চলিতে থাকে অবিরাম। উনবিংশ শতকের অন্তিমলগ্নে বসিরহাট মহকুমার চৌরগন্ধপপুর, আঠুরে ( আটুরে?) প্রভৃতি গ্রামগুলি এক নক্ষত্রনিশীথ-চাদোয়ায় নদীনখরতলে চিরতরে লুপ্ত হইলে উক্ত ভূমির বৈশ্য কপালী সম্প্রদায়ভুক্ত কৃষিকূল দিশাহারা হইয়া বনগ্রামে চলিয়া আসিতে থাকিল। উদ্‌বাস্তু পরিবারগুলি খাজনা-চুক্তির বিনিময়ে নদীয়ার দামুরহুদা থানার অন্তর্গত নাটুদহ গ্রামের জমিদার নফর রায়চৌধুর নিকট হইতে একাংশ এবং গোবরডাঙ্গা জমিদারদের নিকট হইতে একাংশ বন্দোবস্ত লইয়া উক্তস্থানে বসবাস শুরু করিয়া দিল, বর্তমানে যাহার নাম নূতনগ্রাম হইয়াছে, যাহার অর্ধেক বনগ্রাম শহর ও অর্ধেক গোপালনগর থানার অন্তর্গত। মহান কথকঠাকুর বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অশনি সংকেত’ উপন্যাসে এইসব ভূ-ভাগের জন্মমৃত্যু মুহূর্তে মানবজীবনের মহাসংকটের অধ্যায়গুলি চক্ষুসমক্ষে আসিয়া পড়ে। আহা জীবন, আহা মৃত্যু——–এইভাবেই বুঝি-বা নদীর ন্যায় আমারে বাঁধিয়া রাখো। তোমার ঘাটে আমার ক্ষুদ্র তরী——-আমারে ভাসাও, দূরে লইয়া যাও, আরও দূর মায়াবী দ্বীপে লইয়া আমারে তোমার অন্ধকার কোমল বক্ষে জাপটাইয়া ধরো। আমি সুখনিদ্রা যাই! ll

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধ“আমার শখের রঙিন ঘুড়ি”- আবুরুশত মতিনের ছড়া
পরবর্তী নিবন্ধযমজ ঘ্রাণ/ রহমান হেনরী’র কবিতা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে