এরশাদ শিকদারের জল্লাদের ছবি তুলেছিলেন এ হাই স্বপন-কাজী ইমরুল কবীর সুমন

0
905
স্বপন, সুমন
এরশাদ শিকদারের জল্লাদের ছবি তুলেছিলেন এ হাই স্বপন=কাজী ইমরুল কবীর সুমন

মানবজমিনের কিংবদন্তী ফটো সাংবাদিক এ হাই স্বপন আর নেই। আমেরিকা প্রবাসী এই সাংবাদিক করোনা মহামারী যুগে বিদায় নিলেন। জানতে পারলাম সোমবার রাতে। ফেসবুকের পাতায় স্বপন ভাইয়ের ছবি ও বিদায় নেয়ার সংবাদ। করোনা দুর্যোগে এমনিতেই মনমরা হয়ে আছি। এসময় প্রিয়জনদের অসহায় আত্মসমর্পন আরো কাবু করে ফেলছে আমাদের।মানবজমিন দক্ষিন এশিয়ার প্রথম রঙিন ট্যাবলয়েড জাতীয় দৈনিক।

এটার শুরুর দিকের রমরমা যুগে আমারও সুযোগ হয়েছিল সেখানে কাজ করার। স্পোর্টস রিপোর্টার হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম। পরে সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার ও স্পোর্টস-ইন-চার্জ হিসেবেও সেখানে কাজ করেছি। মানবজমিনে ২ দফা কাজ করি। প্রথম দফা কাজ করার সময় আমাদের স্পোর্টস ইন চার্জ ছিলেন এম এম কায়সার ভাই, চিফ রিপোর্টার সারোয়ার হোসেন ভাই, আর নিউজ এডিটর শহিদুল আজম ভাই। কিছুদিন চিফ রিপোর্টার ছিলেন জাহেদ চৌধুরী ভাই।

দ্বিতীয় দফায় শহিদুল আজম ভাই নির্বাহী সম্পাদক, মিলান ফারাবী ভাই প্রধান বার্তা সম্পাদক, শামিমুল হক ভাই বার্তা সম্পাদক ও কাজল দাদা চিফ রিপোর্টার। ফটো সাংবাদিক ছিলেন কাজী বোরহান, এ হাই স্বপন, গোলাম মোস্তফা, মোহাম্মদ শাহিন, তারেক আজিজ ভাই। একদিন প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী ভাই জানালেন স্পোর্টসের আমাকে ও কালচারাল বিটের সীমান্ত খোকনকে জেনারেল বিটে কাজ করতে হবে। সেসময় ক্ষমতায় বিএনপি সরকার। যথারিতি মাঠে নেমে গেলাম। আমি ও সীমান্ত খোকন প্রথমে এক সাথে হরতালের মধ্যে তারেক জিয়া ও হাওয়া ভবনের লোকজনের প্রদর্শনী ক্রিকেট ম্যাচ কাভার করতে গেলাম হাওয়া ভবনের পাশের মাঠে।

সারোয়ার ভাই সীমান্তকেই প্রথমে পাঠাতে চাইলেন। আজম ভাই সাথে আমাকেও পাঠাতে বললেন- ক্রিকেট খেলা বলে কথা। সেখানে গিয়ে দেখলাম, বিএনপির নামকরা নেতারা খেলতে বা খেলা দেখতে এসেছেন। তারেক জিয়া মাঠে নামলেন ব্যাট হাতে। কোকো জিয়া মাঠে বসে খেলা দেখছেন। মিডিয়ার নামকরা জাদরেল সব কূটনৈতিক সাংবাদিক। আমরা দুজন তো সেখানে অতি নস্যি। তাই বলে তো বসে থাকলে চলবে না। কাজ করলাম আমি ও খোকন। সাথে ফটো সাংবাদিক স্বপন ভাইসহ অন্যরা। পরদিন সব পত্রিকায় বিশাল নিউজ তারেক জিয়ার ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে।

ইস্কাটনে অফিস দেশের একটি বিগ বাজেটের পত্রিকা নিউজ করলো ১২ উইকেটে ম্যাচ জিতলো তারেক জিয়ার দল। ১২ রানের জায়গায় পলিটিক্যাল বিটের রিপোর্টার লিখে দিয়েছেন ১২ উইকেট। মানবজমিন সেটা আমার জন্য শুদ্ধ সংবাদ ছাপলেও সেদিন অনেকেই সে একই ভুল করেছিল। সেদিন বেশ কিছু ছবি পেয়েছিলাম কাজী বোরহান, এ হাই স্বপন, গোলাম মোস্তফা ভাইয়ের কাছ থেকে। এ কথাটা বলা শুধু মানবজমিনের সবার আন্তরিকতা প্রকাশের জন্য। সেসময় আমরা ছিলাম অলরাউন্ডার। কর্তৃপক্ষ যেখানেই কাজ করতে দিয়েছেন সেখানেই আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করেছি।

ওয়ালসো টাওয়ার ও জেনিথ টাওয়ার দু’জায়গাতেই মানবজমিনে কাজ করেছি আমি। অফিস বদলের সময়ও আমি সেখানে কাজ করছিলাম।মানবজমিনের ফটো সাংবাদিকরা অনেক সময়ই রিপোর্টারদের সাহায্য করতেন সঠিক তথ্য ও ছবি সংগ্রহের ক্ষেত্রে। জেনারেল বিটে ফিরে আসার পর কিছুদিন আমাকে কাজ দেয়া হলো ক্রাইম নিয়ে কাজ করতে। সেসময় ক্রাইম বিটের প্রধান আজহার মাহমুদ ভাই। হরতালে গ্রেফতার হওয়া মানুষদের দুঃখ-দুর্দশা দেখতে একদিন আমাকে পাঠানে হলো ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে। সেটা তখন পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দীন রোডে অবস্থিত।

আমি ও স্বপন ভাই গেলাম সেখানে। অনেকের সাথেই কথা বলছিলাম। হঠাৎ দেখলাম স্বপন ভাই দৌড়ে আসছেন। কাছে এসে বললেন, ঐ দিকে আসো। কথামতো ছুটে গেলাম। দেখলাম ডান্ডাবেরী পড়া ৩ জন লোক। স্বজনরা তাদের ঘিরে ভিড় জমিয়েছে। কেউ কেউ কাঁদছে। স্বপন ভাই বললেন, আমি ছবি তুলেছি, তুমি তথ্য নাও। কথা বলে জানলাম, এরা মার্ডার কেসের আসামী। যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত আসামী। কাজ করেন জল্লাদ হিসেবে। ঢাকা থেকে খুলনা যাচ্ছেন এরশাদ শিকদারের ফাঁসি কার্য্যকর করতে। জেলগেট থেকে বের করে দ্রুত তাদের গাড়িতে তোলা হয়। অল্পসময়ের চলতি পথেই তাদের নাম, ঠিকানাসহ অন্যান্য তথ্য জানার চেষ্টা করি। সেসময় এরশাদ শিকদার বাংলাদেশের ত্রাস।

খুলনায় বরফ কলে তার মানুষ হত্যার কাহিনী সবার মুখে মুখে। গ্রেফতারের পর তার ফাঁসির দন্ড দেয়া হয়। আমি ও স্বপন ভাই প্রয়োজনীয় তথ্য ও ছবি নিয়ে অফিস ফিরলাম। স্বপন ভাই ছবি দিলেন, আমি তথ্য জানালাম চিফ রিপোর্টার সারোয়ার ভাইকে। স্বপন ভাই ছবি দিয়ে বাসায় চলে গেলেন। কিছুক্ষন পর নিউজ এডিটর আজম ভাই ডাক দিলেন। জানতে চাইলেন, এই ছবি আর কে কে তুলেছে, তথ্য আর কে কে জানে। আমি জানালাম, তথ্য আমি ছাড়া কেউ জানে না। ছবি শেয়ারের বিষয়টি আমি বলতে পারবো না, সেটা স্বপন ভাই জানে। উনি বললেন, আর কাউকে এ বিষয়ে কিছু বলবেন না। এটা এক্সক্লুসিভ।

তবে কারাগারে যোগাযোগ করে একটু ক্রস চেক করে দেখুন নামগুলো ঠিক আছে কিনা। আমি জেলার ও জেল সুপারকে ফোন দিলাম। তারা কোন তথ্য জানেন না বলে জানালেন। একটু পর ক্রাইম চিফ আজহার মাহমুদ ভাই এলেন। জল্লাদদের নামগুলো জানতে চাইলেন। আমি মনে করলাম উনি ক্রাইম চিফ। হয়তো ক্রসচেক করছেন। উনার সাথে আবার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী মতি ভাইয়ের ভালো সম্পর্ক। ভয়েস অব আমেরিকার একটি শ্রোতা ফোরামের সংগঠক। জুনিয়র ক্রাইম রিপোর্টার হিসেবে ক্রাইম চিফকে সরল মনে নামগুলো বলে দিলাম।

একটু পর দেখলাম, উনি ফোন করে করে অন্য মিডিয়াকে নামগুলো বলে দিচ্ছেন। আমাকে দিয়ে ক্রাইম বিটে কাজ করানো হচ্ছে এটা তিনি হয়তো সহজভাবে নিতে পারেননি! এটা বুঝতে পেরে তাকে বাঁধা দিলাম। বললাম, নিউজ এডিটর আজম ভাইয়ের নিষেধ আছে নামগুলো কারো সাথে শেয়ার করা যাবে না। উনি বিপদ আঁচ করতে পেরে থেমে গেলেন। পরদিন দেখলাম, মানবজমিনে এরশাদ শিকদারের জল্লাদদের ছবি ও নিউজ ছাপা হলো ফলাও করে। অন্য পত্রিকা ছবি ছাপলেও জল্লাদদের তথ্য দিতে পারলো না। একদিন পর সাপ্তাহিক মিটিং। মতি ভাই আমাকে ও স্বপন হাইকে এই কাজের জন্য বাহবা দিলেন। আজহার মাহমুদের কাজেরও নিন্দা করলেন সবাই। আজহার মাহমুদ বিপদ আঁচ করতে পেরে সেদিন মিটিংয়ে অনুপস্থিত ছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই
আজহার মাহমুদ ক্রাইম চিফের পদ হারালেন। নাশরাত আর্শিয়ানা চৌধুরীকে নতুন ক্রাইম চিফ করার সিদ্ধান্ত নিলো অফিস।

আমি এরপর ক্রাইম বিট ছেড়ে দিলাম। আবার স্পোর্টস বিটে ফিরে আসলাম। স্পোর্টস-ইন-চার্জ এম এম কায়সার ভাই ও জাকারিয়া হোসেন ভাই মানবজমিন ছেড়ে আমারদেশ এ চলে গেলেন। মতি ভাই ও সারোয়ার ভাইয়ের সাথে আলাপ করে আমাকে আবার স্পোর্টসে কাজ করার কথা বললেন, আজম ভাই। তালহা ভাইকে ইন-চার্জ করে স্পোর্টস টিম সাজালাম। স্বপ্নের জেনারেল বিট বাদ দিয়ে বাধ্য ছেলের মতো আবার কাজ করা শুরু করলাম স্পোর্টসে। সেখানে ফিরে ১০টি আলোচিত স্পোর্টস রিপোর্ট করলাম। এর বেশিরভাগ আইডিয়া নিউজ এডিটর শহিদুল আজম ভাইয়ের দেয়া। সেবার ডিআরইউ এর সেরা রিপোর্টের নাভানা পুরস্কার পায় আমার লেখা একটি রিপোর্ট। এরপরের ২ বছরও এই পুরস্কার পাই আমি। গুরুত্ব দিয়েই এই সংবাদ ছাপে মানবজমিন। ৩য় বার এই পুরস্কার পাওয়ার পর মানবজমিন রিপোর্ট করে ‘ইমরুল সুমনের হ্যাটট্রিক’।

মানবজমিনে আমার সাথে কাজ করা শওকত ওসমান রোচি ভাই, আশরাফুল আলম নওশাদ ভাই, মোহনা টিভির সোহেল মাহমুদ ভাই, একুশে টিভির তারিক মল্লিক, বৈশাখী টিভির হাসানুজ্জামান সাকি ভাই, শহিদুল ইসলাম ভাই, পিনাকি তালুকদার ও প্রাইমের সুলতানা রহমান পুতুলও থাকেন আমেরিকায়। আছেন হাবি মামার পরিবার। এদের মধ্যে আমাদের আপনজন স্বপন ভাই তো চলেই গেলেন। শুনলাম চ্যানেল ওয়ানের ফরিদ আলম ভাই অসুস্থ্য। মানবজমিনের ইফতেখার রাজিব থাকেন ইতালিতে। এজিবি কলোনীর হাকিম ভাই, সিজার মামাও আছে সেখানে। কানাডায় কবির আছে।

আমার ছোট ভাই ইঞ্জিনিয়ার কাজী মইনুল কবীর রিগান আছে জার্মানীতে। সেখানে আছে আরামবাগের বন্ধু আশরাফ (আফসার) এর ছোট বোন শাহিদা সুমীও। বৃটেনে আছে কবি সানাউল হক খানের মেয়ে বাঁধন হক। আছে আমাদের বন্ধু ফেরদৌস, অলিসহ আরো অনেকেই। করোনার থাবায় আর যেন কেউ কাবু না হয় সে কামনাই করি। স্বপন ভাই জান্নাতবাসী হন সে কামনাই করি। তার পরিবার এ শোক সহ্য করার শক্তি পাক। হে রাব্বুল আল আমিন আমাদের সকল গুনাহ মাফ করে বাংলাদেশীদের সাথে সাথে প্রবাসী ভাই, বোন ও বন্ধুদেরও হেফাজত করুন। আমিন।

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধঅচেনা আতংক সময়ে -কবি কাজী আতীক‘এর কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধ“মিটিং” – আহমেদ শিপলু’র কবিতা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে