জন্মদিনে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও শওকত আলীর প্রতি শ্রদ্ধা- স্বকৃত নোমান

0
326

গতকাল ছিল কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও শওকত আলীর জন্মদিন। বাংলা সাহিত্যের দুই প্রধান লেখক তাঁরা। খুব নীরবেই চলে গেল দুজনের জন্মদিন। জন্মদিনে বিশেষ মানুষদের স্মরণ করা ও শ্রদ্ধা জানানোর মধ্যে একটি ভালো দিক আছে। স্মরণ-শ্রদ্ধার মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্মের কাছে একটি শুভ বার্তা যায়। প্রজন্ম চিনতে পারে তাদের বিশেষ মানুষদের।

ফেসবুক তো এখন বিশিষ্ট মানুষদের জন্ম-মৃত্যু দিন উদযাপন ও স্মরণ-শ্রদ্ধার প্রধান মাধ্যম। জাতীয় গণমাধ্যমগুলোকেও পেছনে ফেলে দিয়েছে ফেসবুক। কিন্তু বিস্ময়করভাবে গতকাল ফেসবুক ছিল নীরব। দু-একটি ছাড়া এ দুই লেখককে নিয়ে কোনো পোস্ট চোখে পড়েনি। আমিও দিইনি। দেওয়া উচিত ছিল। ব্যস্ততার কাছে হার মানা ঠিক হয়নি। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এ দুই লেখককে নিয়ে ফেসবুক লাইভ জাতীয় কোনো অনুষ্ঠান করেছিল? চোখে পড়েনি।

দৈনিক পত্রিকাগুলোর সাহিত্য পাতায় দুজনের ওপর কোনো লেখা ছাপা হয়েছে কিনা জানি না। করলেও দায়সারা গোছের কিছু হয়ত করেছে। দৈনিকের সাহিত্য পাতায় তো এখন সাহিত্য থাকে না। ভবিষ্যতে হয়ত সাহিত্যপাতা নামের কিছু থাকবেও না। কেন থাকবে? সাহিত্য ছেপে কী লাভ? ছাপতে হবে ক্ষেপনাস্ত্র টাইপের প্রতিবেদন, যাতে সমাজে উত্তেজনা তৈরি হয়। উত্তেজনা তৈরি করতে না পারলে সেই পত্রিকার দাম আছে? কে পড়বে?

পত্রিকাগুলোর সবেচেয়ে অবহেলিত পাতাটির নাম সাহিত্যপাতা। প্রথা মেনে রাখতে হয় বলে রেখেছে। অনেক পত্রিকা তো চান্স পেলেই সাহিত্যপাতা ছাপা থেকে বিরত থাকে। বড় কোনো বিজ্ঞাপন এসেছে? কোথায় ছাপা হবে? সাহিত্যপাতা ছাড়া কোথায় আবার? এ সপ্তায় পাতাটি বন্ধ থাকুক। শুনেছি নতুন তিনটি দৈনিক আসছে। একটিতেও সাহিত্যপাতা বলে কিছু থাকবে না। প্রজন্মের জন্য সাহিত্যের কী প্রয়োজন? তাদের জন্য তো বাংলা সিনেমার নায়ক-নায়িকারা আছে। তাদের প্রেম, পরিণয়, পরকীয়া; তারা কী খায়, কী রান্না করে, আম-দুধ দিয়ে তারা ভাত খেতে পছন্দ করে কিনা, কাচ্ছি খেতে তাদের কেমন লাগে, কোন রঙ তাদের পছন্দ, শীতে তারা কী গায়ে দেয়, গরমে কোন রঙের জামা পরে―এসব নিয়ে স্টোরি বানাও। বানিয়ে ছেপে দাও। নতুন প্রজন্ম এগুলোই খাবে। একটি দেশ কোন দিকে হাঁটছে, এসব সংকেতের মাধ্যমে তা বোঝা যায়।

ইলিয়াস-শওকতের জন্মদিন উপলক্ষে টেলিভিশনগুলো যে কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করেনি, তা খোঁজ না নিয়েই বলে দেওয়া যায়। কেন করবে? ইলিয়াস-শওকতকে নিয়ে অনুষ্ঠান করলে কে দেখবে? না দেখলে টিআরপি বাড়বে? টিআরপির দৌড়ে এগিয়ে থাকতে না পারলে প্রতিষ্ঠান টিকবে? টিআরপির জন্য চাই হট নিউজ, গরম গরম টক শো। টক শো-র মধ্য দিয়ে যত উত্তেজনা ছড়ানো যায় ততই লাভ। টক শো-তে মারামারি লাগিয়ে দিতে পারলে আরো ভালো। হিট বাড়বে। হিট চাই, হিট।

কদিন আগে এক সিনিয়র সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। বললেন, এক টিভির এমডি শিল্পী মর্তুজা বশীরকে চেনেন না, কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমানকে চেনেন না, এবং সৈয়দ শামসুল হককেও চেনেন না। তিনি চেনেন না, তাই এঁদের নিয়ে কোনো অনুষ্ঠান করা যাবে না। তাঁদের জন্ম-মৃত্যু দিনে শ্রদ্ধাও জানানো যাবে না। কী করতে হবে? দর্শক যা খায় তাই করতে হবে। প্রয়োজনে হিরো আলমকে নিয়ে স্টোরি বানাও। তাকে টকশো-তে ডাকো। প্রয়োজনে আরেকজন হিরো আলম তৈরি করো। কাজী ইব্রাহিমের মতো মাওলানা ডাকো। তাদের কথাই মানুষ বেশি খায়।

বাংলা ভাষার দুই প্রধান কথাশিল্পীর জন্মদিন নীরবে চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে বোঝা গেল আমাদের সাহিত্য রুচিবোধ যে নিম্নগামী। ভবিষ্যতে এই বোধ তলানিতে গিয়ে ঠেকবে। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-মানিক-জীবনানন্দও তখন উপেক্ষিত হতে থাকবেন। তাঁদের জন্ম-মৃত্যু দিনে নেমে আসবে গভীর নীরবতা। কেউ টুঁ শব্দটি করবে না। সাহিত্য-সংস্কৃতিহীন একটি জাতির রূপ কেমন হবে, তা তো সকলেই আন্দাজ করতে পারি।

জন্মদিনে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও শওকত আলীর প্রতি শ্রদ্ধা।

মহাকালে রেখাপাত
১৩.০২.২০২১

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধনৌকা দেশে উন্নয়ন এনে দিয়েছে – পলক
পরবর্তী নিবন্ধLittle Falicity- Chinmayi Haldar

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে