জাদুকর ও জাদুবাস্তবতার গল্প (বড় গল্প) – তন্ময় ইমরান

0
211

জাদুকর ও জাদুবাস্তবতার গল্প (বড় গল্প) – তন্ময় ইমরান

জাল বিস্তার পর্ব
এক
তারাভরা এক রাতে মেয়ের হাত ধরে জাদুকর এডওয়ার্ড ডি কস্তা ফিরে এসেছিল তার গ্রামে, প্রায় বিশ বছর পর। তারপরও আট বছর বয়সী মেয়ের হাত ধরে পূর্বপুরুষের জমিদার বাড়ি খুঁজে পেতে তার মোটেও কষ্ট হয় না। সে আবিষ্কার করে গুটিকয়েক পাকা দোতলা বাড়ি ছাড়া তার গ্রামের তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি। হ্যা সত্যিই কোন পরিবর্তন হয়নি। এমনকি নদীটা পর্যন্ত অনেক নদীর মতো শুকিয়ে যায়নি। ঠিক কিশোরকালের মতোই জোনাকির আলোয় পথ চিনে সে তার পূর্বপুরুষের ভিটার দিকে এগোতে থাকে। তার আশ্চর্য সুন্দর মেয়েটি চুপচাপ চারিদিক তাকাতে তাকাতে হাত ধরে এগোয়। কোন প্রশ্ন করে না। যেন নিজেই বুঝে নিতে চায় সবকিছু।

দুই
রাইসুল আমিন রহিমপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী ছিলেন। নৌকায় করে দূর বাণিজ্যে যেতেন। এখানকার সাবেক জমিদার একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন সবকিছু বিক্রি করে চলে যাচ্ছিলেন, তখন রাইসুল তার দুইশ’ বিঘা জমি নামে-বেনামে কিনে নেন। অবশ্য সেসময় তিনি ছাড়া এই তল্লাটে কারো সেরকম সামর্থ্যও ছিল না। তাকে ঘিরে গ্রামের মুসলমান জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক ধরনের অহংকার জেগে ওঠে। রাইসুল আমিনের দান খয়রাতের হাতও ছিল ভাল। ফলে গ্রামের মানুষের কাছে তিনি খুব দ্রুত প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন।

কিন্তু বাহাত্তুর সালের এক বর্ষায় চলনবিল অঞ্চলে নৌকার বহর নিয়ে এক দূর বাণিজ্যে যাবার পর মাস ছয়েকের জন্য রাইসুল গায়েব হয়ে যান। সাতটি নৌকার বহরসহ স্রেফ গায়েব। যদিও মাস খানেক পর ওই একই গ্রামের দুজন মাঝি ফেরত এসে জানিয়েছিল রাইসুল আমিনের পুরো নৌকার বহর ডাকাতির কবলে পড়েছে। ডাকাতরা প্রত্যেককে কেটে পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছে। এমনকি রাইসুল আমিনও বেঁচে নেই। কিন্তু দেখা গেল ছয়মাস পরেই রাইসুল আমিন ফেরত এসেছেন বহাল তবিয়তে। সবকিছু আগের মতোই আছে। গলায় শুধু একটা রুপার ক্রুশ ঝোলানো। হ্যা তিনি খ্রিস্টান হয়ে গেছেন। বেঁচে রয়েছেন প্রভু যিশুর কৃপায়! আর তার নতুন নাম হয়েছে রইস ডি কস্তা।

গ্রামের মুসলমান জনগোষ্ঠীর জন্য এই ব্যাপারটি ছিল বিশেষ ধাক্কা। এই ধাক্কার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় রাইসুল আমিনকে তারা একঘরে করে। কিন্তু মাস ছয়েক যেতে না যেতেই, তাদের এ সিদ্ধান্ত বদলাতে হয়। কারণ রাইসুল আমিনের হাতে টাকা এবং তাদেরকে কাজ ছিল যে! আর গ্রামের মানুষেরও ছিল কাজ এবং টাকার অভাব। এক বছরের মাথায় তারা আগের মতোই রাইসুল আমিন ওরফে রইস ডি কস্তার সঙ্গে আগের মতোই সহজ হয়ে ওঠে।

যে বছরটায় রইস ডি কস্তা গ্রামে একঘরে হয়েছিলেন সেই বছরেই এডওয়ার্ড ডি কস্তার জন্ম। রইস ডি কস্তার জন্য একঘরে হয়ে থাকাটা খুব একটা সমস্যার ছিল না। কিন্তু এডওয়ার্ড ডি কস্তার জন্মের সময় এটা একটা প্রকট সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। গ্রামের কোন ধাত্রীকে এই বাচ্চা প্রসবের সময় থাকতে রাজি করানো যায়নি। ফলে বাচ্চা জন্মালো ঠিকই, মারা গেলেন বাচ্চার মা। আর এর ঠিক মাস খানেক পরেই রইস ডি কস্তা আরেকটা বিয়ে করতে বাধ্য হলেন। সম্ভ্রান্ত খ্রিস্টান ঘরের এক মেয়েকে। এডওয়ার্ড ডি কস্তার তিনি সৎ মা হলেও বাস্তবে আসল মা হয়ে গেলেন।

তিন
সাধারণত যা হয় রইস ডি কস্তার ক্ষেত্রে তা হয়নি। তিনি আর তার বউ ছাড়া তার পুরো পরিবারের কেউ আর খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেননি। ফলে গ্রামের খ্রিস্টান সংখ্যা ওই দুইজন ছাড়া আর বাড়েনি। এডওয়ার্ড কস্তার নতুন মা কোন সন্তান নেননি। ষোলো বছর বয়সেই এডওয়ার্ড কস্তাকে পড়াশোনার জন্য ঢাকা শহরে মামার বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তারপর এই গ্রামে এডওয়ার্ড কস্তা এসেছে মাত্র বার তিনেক। একবার দুই বছর পর অর্থাৎ আঠারো বছর বয়সে বাবার মৃত্যুর সময়। একবার মাকে শহরে নিয়ে যাওয়ার জন্য এবং শেষবার মায়ের মৃত্যুর পর বাবার পাশে কবর দেয়ার জন্য। সেবার অবশ্য পুরনো কেয়ারটেকার জমির উদ্দিনের সঙ্গে একটা চুক্তি করে এখানকার ল্যাঠা চুকিয়ে সে চলে যায় এবং তারপর বিশ বছর বিস্মৃত থাকে গ্রাম সম্পর্কে।

মাঝখানের এ সময়ে এখানকার সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিলো কেবল জমির উদ্দিন। জমির উদ্দিন যক্ষের ধনের মতো তাদের বিপুল সম্পত্তি আগলে রেখেছে। শুধু আগলেই রাখেনি সে বরং নিজের সম্পত্তি মনে করে এটি বাড়িয়েছে। নিজ দায়িত্বে এডওয়ার্ডকে ষান্মাসিক কিংবা বাৎসরিক হিসাব ও ফসল পৌঁছে দিয়েছে। এরকম সৎ লোকের কথা কেবল পাঠ্যপুস্তকেই পাওয়া যায়।

অবশ্য জমির উদ্দিনের সৎ থাকা ছাড়া বোধ করি কোন উপায় ছিল না। কারণ তার একমাত্র ছেলেটি ছিল মানসিক প্রতিবন্ধী। ফলে আত্মলোভ কমে গিয়েছিল, পাশাপাশি সমৃদ্ধির স্বপ্ন হয়ে গিয়েছিল ফিকে। তবে সুন্দরী মেয়েটিকে যথেষ্ঠ ভালো ঘরে বিয়ে দেয়ার মতো সামর্থ্য তার ছিল। কিন্তু সে সুযোগ নেয়ার আগেই, যাচাই-বাছাই করতে করতেই জমির উদ্দিন জমিদারের মতোই সারাজীবন কাটিয়ে গত বছর দুয়েক আগে মর্ত্যলোক ত্যাগ করে। তার অবর্তমানে ডিগ্রি পাশ তনয়া জমিলা বুঝে নিয়েছে কেয়ারটেকারির দায়িত্ব। বাঙালি নারীর স্বাভাবিক দক্ষতা দিয়েই সে এডওয়ার্ডের সম্পত্তি দিনকেদিন আরো বাড়িয়েই তুলছে।

চার
এডওয়ার্ড ষোলো বছর বয়সে গিয়েছিল শহরে মামার বাড়িতে। খ্রিস্টান মামা ছিলেন অতিশয় সজ্জন ব্যক্তি। সেই সঙ্গে সংস্কৃতমনাও ছিলেন। কবি, সাহিত্যিক, গায়ক কে আসতো না তার বাড়িতে। কিন্তু বরাবরই এডওয়ার্ডের নজর কেড়ে নিয়েছিল এক অদ্ভুত চুপচাপ লোক। কিন্তু এ লোকটাকে নিয়েই গড়ে ওঠে এডওয়ার্ডের পৃথিবী। লোকটা একজন জাদুকর কিন্তু পসার তেমন ছিল না।

জাদু দেখিয়ে কোনওমতে ‘দিন আনি দিন খাই’ ধরনের বাস্তবতার মধ্যে বসবাস ছিল তার। এডওয়ার্ডের সঙ্গে তার হয়েছিল কিভাবে কিভাবে যেন খাতির! আসলে প্রকৃত এবং বিশুদ্ধ ভালোলাগা চাপা থাকে না। হয়তো সে কারণেই এডওয়ার্ডের সঙ্গে তার খাতির হয়েছিল। সে এডওযার্ড শিখিয়েছিল কিছু ছোটো-খাটো জাদু।

যেন পরাবাস্তব জগৎ থেকে লোকটার কণ্ঠস্বর ভেসে আসতো। সে এডওয়ার্ডকে বলতো- শোনো জাদু হচ্ছে বিজ্ঞান। যে দেশে বিজ্ঞান নেই সে দেশে জাদুও নেই। এডওয়ার্ড এটাকে ফিলোসফি হিসাবে নিয়েছিল। সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছিল- আরেকটি নিজস্ব ফিলোসফি- কিছু হলে এক নম্বর হতে হবে, নইলে পথই মাড়াবো না।

এ দুটো মটো মিলিয়েই এডওয়ার্ড শুরু করেছিল তার জাদুকর জীবন। জাদু বাস্তবতার জীবন। আর উঠে এসেছিল জাদুকরদের প্রথম সারিতে। তার পুঁজি ছিল চমৎকার বাচনভঙ্গি, সুশ্রী চেহারা এবং একদল বিজ্ঞানী ও টেকনিশিয়ান বন্ধু। এসময় সে প্রেম করেছিল, বিয়ে করেছিল এবং শুরু করেছিল এক স্বাপ্নিক জীবন। জন্মেছিল নোরা। তার একমাত্র মেয়ে। যে তার এখন একমাত্র সঙ্গী।

নোরার জন্মের পর থেকেই এডওয়ার্ডের উপলব্ধি হতে থাকে জাদুকর জীবনের অবসান হওয়া উচিৎ। যদিও সে তখন জাদুকর জীবনের শীর্ষে। কিন্তু এদেশ থেকে বিজ্ঞান হারিয়ে গেছে। জাদু নেমে এসেছে শিল্প থেকে সাধারণ ভোজবাজির কাতারে। আর তার সেই বিজ্ঞানী কিংবা টেকনিশিয়ান বন্ধুরাও একে একে পাড়ি জমিয়েছে বিদেশ। সবশেষ নোরার মাও বছর তিনেক আগে সুখ স্বপ্নের নেশায় তারই এক বন্ধুর হাত ধরে চলে গেছে। যাওয়ার সময় ছোট্ট এক চিরকুটে ক্ষমা করে দেয়ার কথা বলেছে। অথচ তাদের বিয়েটা ছিল প্রেমের। নোরার মার অনেক চাপাচাপিতে এডওয়ার্ড বসেছিল বিয়ের পিঁড়িতে। এর জন্য নোরার মার ছাড়তে হয়েছিলো তার মুসলমান সমাজ। সহ্য করতে হয়েছিল কতো কথা! মানুষ কত দ্রুত বদলে যায়। নয় বছর কি এমন সময়?

পাঁচ.
রাত সাড়ে আটটায় এডওয়ার্ড তার বাপের বসত ভিটায় এসে পৌঁছায়। চারিদিকে তখন সুনসান। এ বাড়িটা এককালে জমিদার বাড়ি হওয়ায় এখান থেকে মূল গ্রামের বসতি বেশ তফাতে।

নোরার মুখ থেকে প্রথম কথা বেরিয়ে আসে- বাবা, এতো সুন্দর বড়োবাড়ি কি আমাদের? আমরা কি এখানে থাকবো?

– হ্যা এইটা তোমার দাদুর বাড়ি। এখন থেকে আমরা এখানে থাকবো।

জবাব দিয়ে এডওয়ার্ডের হঠাৎ ভালো লাগতে শুরু করে। নোরা শহর ছেড়ে এখানে এসে ঘাবড়ে যায়নি। বরং মজা পাচ্ছে। অবশ্য কতোদিন মজা পায় সেইটা একটা বিষয়। তার ভালো লাগা আরো বেড়ে গেল যখন জমিলা একটা চার্জার বাতি নিয়ে হাজির হলো। সে সম্ভবত তাদের অপেক্ষাতেই বসে ছিল। তার সঙ্গে বেশ কয়েকজন চাকর গোছের লোক ছিল। দুয়েকজন মহিলাও ছিল। সুন্দরী জমিলাকে দেখে এডওয়ার্ডের ভালো লেগেছিল তা নয়, বরং ভালো লেগেছিলো অনেক মানুষ বাড়িটাতে দেখে। এরা সবাই এই বাড়ির নানা কাজে যুক্ত। এখানে আসার আগে তার ধারণা ছিল বাড়িটা মৃতপ্রায়। লোকজন নেই। তার সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হওয়ায় সে খুশি।

ছয়.
জমিলা এডওয়ার্ডকে নিয়েছিল আশ্রয় হিসাবে। বাস্তবিকই এডওয়ার্ডের ভিতর ছিল তীব্র পুরুষালি অভিব্যক্তি, অথচ পুরুষতান্ত্রিক নয় । তার উপস্থাপন ভঙ্গি ছিল দারুণ। কাউকে ঠকানোর কোন রকম পরিকল্পনা ছিল না। ছিল না প্রভুত্ব করার মতি-গতি।

প্রথমদিকে গ্রামের চেয়ারম্যান বা মোড়ল গোত্রীয়
লোকজন তাকে বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছিল। কিন্তু যখন তারা দেখলো এডওয়ার্ড মানুষটা তাদের কোন সাতেপাঁচে নেই, কোন রাজনীতিতে নেই- তখন তারা বেশ তার বন্ধু হয়ে গেল। এমনকি জমিলার সঙ্গে তার গোপন অভিসারও গ্রামে কোন অহেতুক সমস্যার সূত্রপাত করেনি।

এদিকে এডওয়ার্ড একজন জাদুকর। ফলে সে বিজ্ঞান ভালো জানে। চেয়ারম্যানের কাছে সে তদবীর নিয়ে গিয়েছিল গ্রামের হাই স্কুলে রসায়ন ও ফিজিক্স পড়ানোর জন্য। চেয়ারম্যান খুশি হয়েই তা অনুমোদন করেছিলেন। কারণ এডওয়ার্ডের ক্ষমতা সম্পর্কে তিনি জানতেন। ইচ্ছে হলেই এডওয়ার্ড যে তার চেয়ারের সব কয়টা পায়া ধরে টান মারতে পারে, ভেঙ্গে দিতে পারে ত্রিশ বছরের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার- তা তিনি জানতেন।

এডওয়ার্ড গ্রামে একটা বিনোদন কেন্দ্র বসিয়েছিল। তার অভিনব আইডিয়ার এই বিনোদন কেন্দ্রটিকে ঘিরে গ্রামের মাওলানা গোষ্ঠীর তীব্র আপত্তি ছিল। কিন্তু যখন তা তাদের উপকারেও আসতে লাগলো তখন তারা অনেকটা আনন্দের সঙ্গেই বিষয়টার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলেন।

এডওয়ার্ডের বিনোদন কেন্দ্রটিতে ছিল একটা বিশাল মঞ্চ, পাকা। মঞ্চে বিশাল টিভি স্ক্রিন লাগানো ছিল।
তবে মঞ্চটি ছিল মাটি থেকে মাত্র ফুট খানেক উপরে। সামনের কাঠা দুই জায়গা নিয়ে ছিলো বসার জায়গা। তাতে পাতা থাকতো মাদুর। এখানে টিভি স্ক্রিনে কোন কোন সময় নতুন হিন্দি, বাংলা সিনেমা চলতো। চলতো ক্রিকেট বা ফুটবল খেলা। কখনো কখনো কালচারাল অনুষ্ঠান হতো, গ্রামের বিয়ে সাদি হতো, ওয়াজ মাহফিল হতো, সভা হতো, আর হতো প্রতি বৃহস্পতিবার এডওয়ার্ডের জাদু সন্ধ্যা। উপরে তেরপল টাঙ্গানো ছিল। ছিল জেনারেটরের ব্যবস্থা। বর্ষার দিনগুলোতে চারপাশে তেরপল নামিয়ে দিয়ে পাকা জায়গাটিতে বৃষ্টি আটকানো হতো। বিনোদন কেন্দ্রের পুরো বিষয়টা ছিল উন্মুক্ত। এর চারপাশেই গড়ে উঠেছিল চায়ের দোকান।

আশেপাশের দশগ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিল এ বিনোদন কেন্দ্রের নাম। আর এতে রহিমপুর গ্রাম হয়ে উঠছিল এক জমজমাট কেন্দ্র। এখানকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা হচ্ছিলেন লাভবান।

এডওয়ার্ডকে নিয়ে গ্রামের মানুষ গর্বিত ছিল । কারণ সে ছিল প্রকৃত অর্থেই অনুসরণীয় এবং দারুন জাদুকরও বটে। বিশেষ করে বৃহস্পতিবারের জাদুর শো হয়ে উঠেছিলো বিশেষ বিখ্যাত। অন্তত তিল ধারণের ঠাঁই বিনোদন কেন্দ্রে থাকতো না। আশেপাশের জেলা শহর থেকেও লোক আসতো। এই খ্যাতিতে এডওয়ার্ডের বিশেষ কিছু যায় আসতো না। বিখ্যাত তো এর চেয়ে ঢের বেশি ছিল আগের শহুরে জীবনেই।

সে তার পুরনো মতবাদ নিয়েই ছিল- বিজ্ঞান ছাড়া জাদু হয় না। এদেশে বিজ্ঞানী দরকার। এ কথা বলেই সে তার জাদু শুরু করতো।

সপ্তাহের বাকি সময়টা দিনের বেলায় সে স্কুলে পড়াতো। রাতে অভিসার চলতো জমিলার সঙ্গে।

গভীর জলে জাল পর্ব
এক
রতন বিস্মিত হয়ে জাদু দেখছে। মেয়েটাকে কিভাবে লোকটা দু’টুকরো করে ফেললো! আতঙ্কে তার দম বন্ধ হয়ে আসতে শুরু করে। মেয়েটা কী সুন্দর! এমন একটা মেয়েকে কেটে দুই টুকরো করছে তারই বাবা। এখন যদি আর জোড়া না লাগানো যায়? দশ বছরের জীবনে রতন এমন আজব ঘটনা আর দ্যাখেনি।

বন্ধু মকবুলের সঙ্গে সে বাজি ধরেছিল। এটা সম্ভব না। এ জায়গাটার কথা সে তার মুখ থেকেই প্রথম শুনেছে। যদি জাদুকর মেয়েটাকে জোড়া লাগাতে পারে, তাহলে রতন একশ টাকা বাজিতে হারবে। সেই সঙ্গে পনের কিলোমিটার দূরে তাদের গ্রামে পৌঁছানোর জন্য বাসভাড়াও তাকে দিতে হবে। কিন্তু এসব কোনকিছুই তাকে এখন ভাবাচ্ছে না। তার মনে উঁকি দিয়েছে অন্য এক সম্ভাবনা।

অবশেষে জাদুকর যখন মেয়েটাকে জোড়া লাগালো তখন পুরো হল রুম হাত তালিতে ফেটে উঠলো।এডওয়ার্ড এই কাটার জাদুটি প্রতি তিন মাসে একবার দেখায়। আসলে সে বিনোদন কেন্দ্রে কোন জাদুই একবারের বেশি দেখাতে চায় না। তবে টেকনোলজির অভাবে তা সবসময় হয়ে ওঠেনা। একই জাদুর পুনরাবৃত্তি হয়।

রতন বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এমন সময় মকবুল তার দাঁত কেলিয়ে এসে বলে- কি তরে কইছিলাম না। এহন ট্যাকা দে।

রতন টাকা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, তুই যা গা আমার কাম আছে।

বলেই সে ভিড় ঠেলে এগিয়ে যায়। তাকে জাদুকরের সঙ্গে দেখা করতে হবে। কিন্তু ভদ্রলোককে কিভাবে জিজ্ঞেস করবে জাদুর মন্ত্র ? সে শুনেছে যারা জাদু টোনা করে তারা কুফরি কালাম করে। জাদুকররা কাফের। তাদের সঙ্গে যারা কথা বলে তারাও নাকি কাফের হয়ে যায়। এরা নাকি মানুষের মাথা খেয়ে ফেলে। তা সে যাই হোক, এই কেটে জোড়া লাগানোর জাদু তাকে শিখতেই হবে। কিন্তু জাদুকরকে হারিয়ে ফেলেছে সে। এদিকে তীব্র প্রস্রাবও চেপেছে। সামান্য চিন্তা করে সে বিনোদন কেন্দ্র থেকে বের হয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়।

একটু দূরে একটা জংলা মতো এক জায়গায় সে প্রস্রাবের জন্য হাফ প্যান্টের জিপার খোলে। তারপর আসল কাজ শুরু করতেই সে দ্যাখে, মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে জাদুকর মেঠো পথের দিকে হেটে যাচ্ছে। তখন প্রায় সন্ধ্যা ছিলো। তড়িঘড়িতে কাজ সারতে গিয়ে তার পায়ে-হাতে ক’ফোঁটা প্রস্রাব পড়ে।

পিছু নেয় সে আশ্চর্য জাদুকরের।

দুই
দিনটা নোরার সুন্দর শুরু হয়েছে। বাবা কাল শহর থেকে অনেক বই এনে দিয়েছে। পরীক্ষার যন্ত্রণাও শেষ। এখন সে পিছন দিককার পুকুরে পা ডুবিয়ে দিব্বি ঘণ্টা তিনেক বই পড়বে। জায়গাটা বেশ অদ্ভুত। চারিদিক জংলা মতো। প্রচুর পাখির আওয়াজ। বিরক্ত করার কেউ নেই। জংলা জায়গাটার পেছনে গ্রামের কবর স্থান বলে এ জায়গাটা সবাই এড়িয়েই চলে। এমনিতে তাদের বাড়ির চাকরবাকরেরাও এদিকে সচরাচর আসে না। সে এখানে থাকে এটা জানে শুধু জমিলা। জমিলাই তাকে এ জায়গা চিনিয়েছে। জমিলা ফুপুটা আজব। ফুপু অথচ মায়ের মতো। জমিলা তার মা হলে বেশ ভালো হতো। সে তার এবং বাবার কী খেয়ালটাই না রাখে!

এসব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতেই সে বই খুলে পানিতে পা ডুবিয়ে বসেছিল। বইটা ইন্টারেস্টিং। ঠিক এসময়েই সে প্রথমে ডাল ভাঙ্গার শব্দ, তারপর আর্তনাদ শুনতে পায়। পুকুরের অপর প্রান্তে একটা নিচু ডালে বসে ছিল রতন। গাছে থাকা বোলতার বাসায় অলক্ষ্যে হাত পড়তেই হুল ফুটিয়েছে। আর রতনও সঙ্গেই সঙ্গেই অনিচ্ছা অবরোহনের শিকার।

নোরা আওয়াজ শুনে মোটেই ঘাবড়ে যায়নি। বরং বই বন্ধ করে ধীরে সুস্থে সে রতনের দিকে এগিয়ে যায়। কাছে গিয়ে বলে- উঠতে পারবে।

তার গলার স্বরে ছিল আন্তরিকতার ছোঁয়া। রতন ভালোই ব্যথা পেয়েছিল, কিন্তু মেয়েটার সামনে তার নিজের প্রেস্টিজ-এর কথা চিন্তা করে সে উঠে দাঁড়ায়।

তিন
সেদিন রতন নিজ থেকেই নোরাকে বলেছিল তার সব কথা। সে যে সপ্তাখানেক ধরে প্রায় সারাটাদিন নোরা এবং তার বাবাকে ফলো করছে সেই কথা। তার মনে হয়েছিল এসব কথা নোরাকে বলা যায় কারণ নোরার চেহারা ছিল গল্পে শোনা রাজকন্যাদের মতো। মায়াবি রাজকন্যা।

রতন আর নোরার বন্ধুত্ব হয়েছিল। দুজনের বয়সই দশ বছর ছিল। সেটা প্রেমের বয়স না। কিন্তু প্রেম প্রেম ভাব আসার বয়স।

সবকিছু শুনে নোরা রতনকে বলেছিল- আমি যতটুকু জানি জাদুর জন্য সব উপকরণ থাকতে হয়।

রতন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকেছিল কিছু না বুঝেই। তার দৃষ্টি দেখে নোরা বুঝিয়ে বলেছিল- ধরো তুমি জাদু দিয়ে চাল থেকে কবুতর বানাবে, তাহলে তোমার চালও লাগবে কবুতরও লাগবে।

নোরা তাকে এও বলেছিল, জাদু একটা বিজ্ঞান নির্ভর শিল্প। যা মানুসকে বিনোদন দেয়। আর জানিয়েছিল, তার বাবা তাকে ছেটোখাটো জাদু শেখালেও কেটে জোড়া লাগানোর জাদুটা এখনো শেখায়নি। বলেছে ওটার জন্য আরো দক্ষ হওয়া দরকার।

একথা শুনে রতনের মন হতাশায় ছেয়ে গিয়েছিল। তবে তাতে সে হাল ছাড়েনি। নোরা তার বাবাকে ধরলে যে সবই সম্ভব একথা রতনের সামান্য অভিজ্ঞতাই তাকে বুঝতে শিখিয়েছিল।

চার
মায়ের কছে না বলেই রতন বিক্রি করে দেয় তার জন্মদিনে পাওয়া চারহাজার টাকার প্রাইজ বন্ড। তারপর ছুটে চলে হাসপাতালের দিকে। একসময় তারা বেশ ধনী ছিল। তার নানার পরিবার তো রীতিমতো বনেদি। বাবার অতো টাকা না থাকলেও তাদের বাড়িটা বাবার পরিশ্রমে চলে যেত। বাবা তখন পাটকলের শ্রমিক সুপার ভাইজার ছিলেন। যাক সে কথা, আজকের পর আবার তাদের পরিবারের অবস্থা ফিরবে। তার এই মুহূর্তে মনে হতে থাকে কেন যে, নোরার বাবার মতো অনেক জাদুকর নেই দেশে! এই দেশে মানুষ কেন যে চিকিৎসা করায়? এতো এতো ডাক্তার দিয়ে কী লাভ?

এসব চিন্তা করতে করতেই সে হাসপাতালের সামনে এসে দাঁড়ায়। সেখানে বাদশা মিয়া তার জন্য একটা বাক্সে করে মাল নিয়ে অপেক্ষা করছিল। সে বাদশা মিযাকে গুনে গুনে চারটা পাঁচশ’ টাকার নোট দেয়। দুই হাজার টাকা। অথচ বাদশা মিয়া বিনা পয়সায় কাজটা করে দিতে পারতো। এই জিনিস জোগাড় করা তার পক্ষে কোন ব্যাপার ছিল না। তার নাকি বিরাট রিস্ক নিতে হবে। আরো অনেককে টাকা দিতে হবে। বাদশা মিয়া তাকে ভ্যান ঠিক করে দেয়। মাল উঠিয়ে দেয়।

ভ্যান চলতে থাকে। শেষ দুপুর। প্রচণ্ড রোদ। তারপরও রতনের ভালো লাগছে। বাকি টাকায় আজ বাড়িতে একটা বাজার করে উৎসব হবে। কতোদিন তাদের বাড়িতে উৎসব হয়না!

পাঁচ
রতনের চেহারায় কোন বৈশিষ্ট্য নেই। তবু এডওয়ার্ড তার দিকে তাকিয়ে আছে। রতনের চোখ উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছে। এই বাচ্চাকে সে কিভাবে বোঝাবে সেটা নিয়ে ভাবছে। জীবনে সে বহু বিব্রত পরিস্থিতিতে পড়েছে। একজন জাদুকরকে তা পড়তেই হয়। সবকয়টি পরিস্থিতি সে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মোকাবেলা করেছে। কিন্তু কোন জাদুবলে সে আজ এ পরিস্থিতির মোকাবেলা করবে।

তার সামনে বীভৎস এক দৃশ্য। একটা সদ্যকাটা রক্তাক্ত পা। রতন এনেছে। রতনের বাবার একটা পা নেই। এখন কেটে জোড়া লাগানোর জাদুটা দিয়ে এই পা তার বাবার পায়ে লাগিয়ে দিতে হবে।

পাটকলে কাজ করার সময় একদিন বাড়ি ফেরার পথে দুর্ঘটনায় রতনের বাবার পা হারাতে হয়েছিল। তারপর থেকে রতনদের পরিবারে নেমে আসে অভিশাপ। মাকে স্কুলের চাকরি নিতে হয়। বড় আপুর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। ছোটো ভাইটাকে রোজ রাতে দুধ খাওয়ানো বন্ধ করতে হয়। এরকম আরো কতো কি!

আর তার বাবা যেন কেমন খিটখিটে হয়ে গেছেন। সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে ক্যাচ ক্যাচ করতেই থাকেন। এখন এই পা লাগালে রতনের বাবা সুস্থ হয়ে যাবে। তাকে এই পা জোগাড়ের বুদ্ধি দিয়েছে তার রিয়েল বন্ধু মকবুল। জোগাড় করা কাটা পা জোড়া লাগানোতেই বাবা আগের মত হয়ে যাবে, তা সে নোরার কাছ থেকে।

মৎস্য আহরণ পর্ব

এডওয়ার্ড রতনের পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছিল। তার বাবাকে দিয়েছিল বিনোদন কেন্দ্র তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব। আর তার বোনের পড়াশোনা আবার শুরু হয়েছিল।

কিন্তু জাদু দিয়ে নাই হয়ে যাওয়া কাটা পা জোড়া লাগানো যায় না- একথা শোনার পর রতনের হতাশ ম্রিয়মান মুখ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জাদুকর এডওয়ার্ডকে রেখেছিল একটা অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে।

সেদিন রতনের আব্দার পূরণ না করাটা ছিল তার স্ত্রী চলে যাওয়ার বেদনার চেয়েও নির্মম। সেদিন সে বুঝেছিল, একজন জাদুকর কতো অক্ষম- সে কেবল বিনোদন দিতে পারে- নির্মাণ করতে পারে না। কিংবা হয়তো নির্মাণ করতে পারে, এডওয়ার্ড তার খোঁজ পায়নি। এ ঘোরেই কিনা জানা নেই- এডওয়ার্ড অনেকটা ঘরকুনো হয়ে পড়েছিল এবং বন্ধ করে দিয়েছিল বৃহস্পতিবারের জাদুর আসর। কিন্তু জমিলার সঙ্গে তার অভিসারের মুহূর্তগুলো আগের মতোই রয়ে গিয়েছিল।

পরিশেষ

এডওয়ার্ড মারা যাওয়ার বছর খানেক আগে নোরা এবং রতনের বিয়ে হয়েছিল। আইনি ঝামেলা ও পারিবারিক ঝামেলা এড়াতে ইসলাম ধর্মমতেই সে বিয়ে হয়। নোরা হয়েছিল মুসলমান। কাজেই এডওয়ার্ডের মৃত্যুর পর রহিমপুর গ্রামে আর খ্রিস্টধর্মের কোনও অনুসারী থাকলো না।

(প্রায় একযুগ আগে লেখা একটা গল্প। এতোবার সিনেমার স্ক্রিপ্ট করতে হয়েছে এই গল্পটা নিয়ে, যে মূল গল্প হারিয়েই ফেলেছিলাম। একটি রাজনৈতিক দলের পত্রিকায় এটি প্রকাশ হয়েছিল। এখন এ গল্পটা বানান ও ভুল বাক্য ছাড়া কিছুই এডিট করিনি। তবে নতুন করে একই থিমে গল্প লিখবো, যদি কখনো আবার ছোটগল্পের সংকলন করি।)

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধধানের দাম বৃদ্ধির যৌক্তিক কোন কারন নেই -কৃষি মন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধনাটোর কালেক্টরেট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের স্কুল বাসের উদ্বোধন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে