ধর্ম, রাজনীতি, সরকার ও বর্তমান প্রেক্ষিত – স্বকৃত নোমান

0
262
নোমান এনকে

ধর্ম,রাজনীতি,সরকার ও বর্তমান প্রেক্ষিত – স্বকৃত নোমান

সাহিত্যের বাইরে আমি রাজনীতি ও ধর্মের একজন কৌতূহলী পর্যবেক্ষক। রাজনীতি ও ধর্মের প্রতি এই বিশেষ আগ্রহের প্রথম কারণ, বাংলাদেশ তো বটেই, পৃথিবীর গতিপ্রকৃতি নির্ধারিত হচ্ছে রাজনীতি ও ধর্ম দ্বারা। ইউরোপীয় রেনেসাঁসের আগে ধর্ম নিয়ন্ত্রণ করত রাজনীতি, এখন কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে ধর্ম। ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে রাজনীতির দাবার গুঁটি হিসেবে। তার প্রমাণ সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে একটি প্রভাবশালী রাষ্ট্র কর্তৃক ধর্মদানব ওসামা বিন লাদেন সৃষ্টি। ইসলামিক স্টেট বা আইএস-এর ধর্মদানবরা ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়াকে কীভাবে ছারখার করেছে, তা তো সম্প্রতিক ঘটনা। ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের কারণে একটি ভঙ্গুর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে পাকিস্তান। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে দিচ্ছে ধর্মীয় উগ্রপন্থিরা। বাংলাদেশও সেই ঝুঁকির বাইরে নয়। একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীকে খুশি করতে স্কুলের পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন করে দেওয়ার ঘটনা আমাদের চোখের সামনে ঘটেছে। কোনো জাতিকে বিনাশ করে দিতে হলে প্রথমে বিনাশ করতে হয় তার সংস্কৃতি, তারপর শিক্ষা। এই দুটি ধ্বংস হয়ে গেলে সেই জাতির আর কিছুই থাকে না। রাজনীতি ও ধর্মের প্রতি এই বিশেষ আগ্রহের দ্বিতীয় কারণ, আমি যেহেতু বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার লেখক, সেহেতু এই জনপদের অধিবাসীদের সকল মত ও পথ সম্পর্কে আমাার জানা থাকাটা জরুরি মনে করি।

বাংলাদেশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু তারা সুন্নি, ওয়াহাবি, খারেজি, মারেফতি, মাযহাবি, লা মাযহাবি, আহলে হাদিস, শিয়া, আহমদিয়া―এরকম বহু ভাগে বিভক্ত। ইসলামি দলগুলোও বহু দলে বিভক্ত। এই বাঙালি মুসলমানদের এক পক্ষ আরেক পক্ষকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মুসলমান বলেই স্বীকার করে না। যেমন আহমদিয়ারা। এদেরকে অমুসলিম ঘোষণার জন্য এক পক্ষ রাষ্ট্রের প্রতি এখনো চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছে। আবার কখনো কখনো এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ‘কাফের’ বা ‘মোনাফেক’ বলতেও ছাড়ে না। স্মরণ করা যেতে পারে গত জোট সরকারের আমলে হযরত শাহ জালালের মাজারে বোমা হামলার ঘটনা। সেই হামলায় আহত হয়েছিলেন বৃটিশ রাষ্ট্রদূত আনোয়ার চৌধুরী। সেই হামলা তো আর হিন্দু-বৌদ্ধ বা খৃষ্টানরা করেনি, করেছিল মুসলমানদের একটি দল। মুসলমান হয়ে কেন তারা শাহ জালালের মতো একজন মুসলিম নেতার সমাধিতে হামলা করল? মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে কেন তারা হত্যা করল? ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে কথা বলায় চট্টগ্রামে কেন দশজন আলেমকে হত্যার হুমকি দিয়েছিল? কেন শোলাকিয়ায় ঈদের ময়দানে বোমা হামলা হয়েছিল? কেন বাঙালি মুসলমানের বুদ্ধির মুক্তির লোকনায়ক শরিয়ত বয়াতির বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তাকে জেলে চালান করল? তার মানে বোঝাই যাচ্ছে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে বিভক্তি কোন পর্যায়ে। ধর্মীয়, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক কারণে তাদের পক্ষে এক কাতারে আসা সম্ভব নয়।

এমনই বহুধা বিভক্ত বাঙালি মুসলমানের একটি দল হচ্ছে ‘আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত’। এদের মধ্যেও আবার বিভক্তি আছে। কিন্তু তারা একটি জায়গায় ঐক্যবদ্ধ। সেটি হচ্ছে, শরিয়তের পাশাপাশি মারেফাতকেও (আধ্যাত্মবাদ) তারা সমান গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তারা কিছুটা উদার, পরমত সহিষ্ণু, সহজিয়া ও বহুত্ববাদী। ধর্মকে ইহলৌকিক রাজনীতির সঙ্গে মেলবন্ধনের ব্যাপারে তারা অনাগ্রহী। তারা রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকা-না-থাকা নিয়ে উচ্চবাচ্য করে না। রাজনীতিতে তারা প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ করতে চায় না। অন্য ধর্মানুসারীদের প্রতি তারা খানিকটা শ্রদ্ধাশীল। তারা প্রকাশ্যে ওয়াহাবিবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরোধী। তাদের কাছে সৌদি আরব হয়ে সাম্রাজ্যবাদের কোনো পেট্রো ডলার আসে না। তারা অস্ত্রের জেহাদ বা মানুষ হত্যার জেহাদের চেয়ে ‘নফসের জেহাদ’কে (মনের সঙ্গে লড়াই) গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। তারা প্রকাশ্যে ওয়াহাবি মতাবলম্বী জামায়াতে ইসলামী, তাবলিগ জামায়াত ও হেফাজতে ইসলামের বিরোধী। রাষ্ট্রীয় রীতি-নীতি আইন-কানুনের প্রতি তারা শ্রদ্ধাশীল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত জাতীয় সংগীত নিয়ে তাদের কোনো এলার্জি নেই। ফকির লালন সাঁই, হাছন রাজা, শাহ আবদুল করিম, রাধারমণ, জালাল খাঁ প্রমুখ বঙ্গীয় সংগীত-সাধকদের প্রতি তারা শ্রদ্ধাশীল। তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সমর্থক। সেকারণেই চট্টগ্রামে তাদের দশজন আলেমকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। রাষ্ট্র বায়াত্তরের সংবিধানে ফিরে গেলে এ নিয়ে তারা রাজপথ গরম করবে না।

এই ‘আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতে’র একজন শীর্ষ নেতার নাম মাওলানা আলাউদ্দিন জিহাদী। তিনি ধর্মীয় বক্তাও। হেফাজত নেতা আহমদ শফীর মৃত্যুর পর আলাউদ্দিন জিহাদীর ফেসবুক পেজ থেকে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে একটি পোস্ট দেওয়া হয়। বলা হচ্ছে, পোস্টটি দিয়েছিল তার পেজের একজন এডমিন। পরে তিনি পোস্টটি দেখতে পেয়ে মুছে দেন এবং লাইভে এসে দুঃখ প্রকাশপূর্বক ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কিন্তু তার প্রতিপক্ষ আহমদ শফির অনুসারীরা তাকে ক্ষমা করতে নারাজ। নারায়ণগঞ্জে তার বিরুদ্ধে তারা ঠুকে দিল আইসিটি আইনে মামলা। সঙ্গে সঙ্গেই আলাউদ্দিন জিহাদীকে গ্রেপ্তার করল পুলিশ। পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিল। বর্তমানে তিনি নারায়ণগঞ্জ কারাগারে বন্দি।

রাজনীতি ও ধর্মের একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে এখানে আমার ছোট্ট একটি প্রশ্ন। সম্প্রতি অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মৃত্যুর পর কিংবা সংগীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একদল ‘মানুষ’ যেভাবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিল, তাদের কারো বিরুদ্ধে কি আইসিটি আইনে কোনো মামলা হয়েছিল? আমার জানামতে হয়নি। কেন হয়নি? এজন্য যে, বাংলাদেশের প্রগতিশীল সমাজ আইসিটি আইনের বিরুদ্ধে। ফলে তাদের কেউ উদ্যোগী হয়ে এ আইনে কারো বিরুদ্ধে মামলা করেনি। রাষ্ট্রও উদ্যোগী হয়ে কারো বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়নি। কখনো নেবেও না। কারণ ক্ষমতাসীন দলের এমন একটা ধারণা হয়েছে যে, কবি-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিকর্মীরা তো আমাদের পক্ষে আছেই, তাদেরকে খুশি করার কী দরকার? আমাদের ছেড়ে তারা যাবে কোথায়? আমাদের ছাড়া তো তাদের গতি নাই। তাদের কে মারল, কে গালি দিল, তা নিয়ে অত সিরিয়াস হওয়ার দরকার নেই।

যাই হোক, আলাউদ্দিন জিহাদীকে গ্রেপ্তারের পর রাজপথে নামতে অনিচ্ছুক, সহিংসতায় অনিচ্ছুক, বহুত্ববাদী ও সহজিয়াপন্থি এই ‘আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতে’র অনুসারীরা নড়েচড়ে বসল। তাদের সুখনিদ্রা ভেঙে গেল। ‘সুখনিদ্রা’ শব্দটি সচেতনভাবেই ব্যবহার করছি। কারণ, মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে আসা আওয়ামী লীগ সবসময় মধ্যপন্থি, বহুত্ববাদী, সহজিয়াপন্থি এই ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতে’র প্রতি ছিল সহানুভূতিশীল। এই দলের অনুসারীরাও সবসময় আওয়ামী লীগকে নিঃশর্তভাবে সমর্থন দিয়ে এসেছে। তারা ভেবেছিল আওয়ামী লীগ ভবিষ্যতেও তাদের কোনো ক্ষতি করবে না। তাদের মতধারার লোক শরিয়ত বয়াতীকে গ্রেপ্তারের পর তাদের কেউ কেউ মৃদু প্রতিবাদ করলেও সামগ্রিক অর্থে সেই গ্রেপ্তারকে তারা বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু আলাউদ্দিন জিহাদীকে গ্রেপ্তারের পর তারা সম্মুখে সমূহ বিপদ দেখতে পেল। ভাবল, আজ আলাউদ্দিন জিহাদীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, কাল যে অন্য কেউ গ্রেপ্তার হবে না, তার গ্যারান্টি কী?

তাই তারা রাজপথে নামল। গত চারদিন ধরে আলাউদ্দিন জিহাদীর মুক্তির দাবিতে সারা দেশে তারা শান্তিপূর্ণ মানব বন্ধন করেছে। বৃহস্পতিবার কুমিল্লায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেছে, চট্টগ্রামে ব্যাপক বিক্ষোভ করেছে, ঢাকায় গিয়াস উদ্দিন আত তাহেরির নেতৃত্বে জাতীয় প্রেসক্লাব ও শাহবাগে মানবন্ধন ও মিছিল হয়েছে। গতকাল শুক্রবারও সারা দেশে মানবন্ধন হয়েছে। আগামী কাল রোববার সারাদেশ থেকে তারা নারায়ণগঞ্জ অভিমুখে যাত্রা করবে। ঘোষণা দিয়েছে নারায়ণগঞ্জ অবরোধের। অর্থাৎ আগামী কাল নারায়ণগঞ্জে একটা বড় ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। তাদের প্রতিরোধ করতে ওয়াহাবিপন্থিরা যদি রাস্তায় নামে, তবে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কাকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

খেয়াল করার মতো ব্যাপার হচ্ছে, এই যে চার দিন ধরে তারা ব্যাপক আন্দোলন করছে, এই ব্যাপারে আমাদের মূলধারার গণমাধ্যমগুলো রহস্যজনকভাবে নীরব। এ নিয়ে কোথাও কোনো সংবাদ নেই। দৈনিক যুগান্তরসহ দু-একটি পত্রিকা ভেতরের পাতায় নিউজ করেছে। কোনো টেলিভিশনে এ নিয়ে কোনো খবর চোখে পড়েনি। মিডিয়ার এই মৌনতা নিয়ে আমার মধ্যে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। কেন তারা নীরব? তারা কি ধর্ম বলতে শুধু হেফাজতকে বোঝে? শাপলা চত্বরে নির্বিচার বৃক্ষ নিধন ও জ্বালাও-পোড়াওকে বোঝে? চাপাতি দিয়ে মানুষ হত্যাকে বোঝে? টঙ্গিতে ওয়াহাবিপন্থি তাবলিগ জামায়াতের ইজতেমাকে বোঝে? অধিকাংশ পত্রিকা প্রতি বছর ইজতেমার খবর মোনাজাতের বিশাল ছবিসহ প্রথম পাতায় লীড করে। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ইজতিমার মাঠ থেকে লাইভ সম্প্রচার করে। কিন্তু ফরিদপুরের আটরশির মাজারে, চট্টগ্রামের মাইজ ভাণ্ডারের মাজারে কিংবা সুরেশ্বরী, চন্দ্রপুরী, শাহ মাখদুম, খান জাহান আলীর মাজারে প্রতি বছর ওরসের সময় যে লাখ লাখ মানুষের সমাগম ঘটে কিংবা কুষ্টিয়ায় লালন সাঁইর আখড়ায় যে বছরে দু-বার হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে―এ নিয়ে কিন্তু কোনো পত্রিকা বা টিভিতে কোনো সংবাদ প্রচারিত হয় না। কেউ কি কখনো দেখেছেন লালনের আখড়া থেকে লাইভ হচ্ছে? আমি দেখিনি। তার মানে বোঝাই যাচ্ছে আমাদের গণমাধ্যম যে একচোখা। তারা শান্তিবাদী, সহিষ্ণু, বহুত্ববাদী কোন গোষ্ঠীর খবর প্রচার করতে অনিচ্ছুক। এগুলোকে তারা খবরের ‘আইটেম’ মনে করে না। আটটেম মনে মনে করে সেসব গোষ্ঠীকে, যারা অসহিষ্ণু, সহিংস, সন্ত্রাসী; যারা ধর্ম নিয়ে বিবাদ করে মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করে, তাবলিগ জামায়াতের দু-পক্ষ যেমন করেছে।

আলাউদ্দিন জেহাদীর মুক্তির দাবিতে কাল অবরুদ্ধ হতে যাচ্ছে বন্দরনগরী নারায়ণগঞ্জ। নারায়ণগঞ্জের চাপ হয়ত রাজধানী ঢাকার ওপরও পড়বে। সারাদেশ থেকে মানুষ আসছে, পড়াটাই স্বাভাবিক। আলাউদ্দিন জেহাদীকে মুক্ত করতে না পারলে নিশ্চিতভাবেই তাদের পরাজয় ঘটবে। পরাজিত হলে আওয়ামী লীগের উপর থেকে তাদের সমর্থন ধীরে ধীরে প্রত্যাহার করে নেবে। দেখার বিষয় আওয়ামী লীগ কোন গোষ্ঠীকে চায়? বিভক্ত হেফাজতকে, নাকি বর্তমানে ঐক্যবদ্ধ বাঙালি মুসলমানের শান্তিবাদী দল এই ‘আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত’কে? আগামীকালের ঘটনায় মিডিয়ার কী ভূমিকা হবে, সরকারের কী ভূমিকা হবে, তা দেখার অপেক্ষায়।

মহাকালে রেখাপাত
২৬.০৯.২০২০

[সংযুক্তি : শায়খ হাসান আল আজহারির একটি বক্তব্যের ভিডিও ক্লিপ]

সাহিত্যের বাইরে আমি রাজনীতি ও ধর্মের একজন কৌতূহলী পর্যবেক্ষক। রাজনীতি ও ধর্মের প্রতি এই বিশেষ আগ্রহের প্রথম কারণ, বাংলাদেশ তো বটেই, পৃথিবীর গতিপ্রকৃতি নির্ধারিত হচ্ছে রাজনীতি ও ধর্ম দ্বারা। ইউরোপীয় রেনেসাঁসের আগে ধর্ম নিয়ন্ত্রণ করত রাজনীতি, এখন কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে ধর্ম। ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে রাজনীতির দাবার গুঁটি হিসেবে। তার প্রমাণ সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে একটি প্রভাবশালী রাষ্ট্র কর্তৃক ধর্মদানব ওসামা বিন লাদেন সৃষ্টি। ইসলামিক স্টেট বা আইএস-এর ধর্মদানবরা ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়াকে কীভাবে ছারখার করেছে, তা তো সম্প্রতিক ঘটনা। ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের কারণে একটি ভঙ্গুর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে পাকিস্তান। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে দিচ্ছে ধর্মীয় উগ্রপন্থিরা। বাংলাদেশও সেই ঝুঁকির বাইরে নয়। একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীকে খুশি করতে স্কুলের পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন করে দেওয়ার ঘটনা আমাদের চোখের সামনে ঘটেছে। কোনো জাতিকে বিনাশ করে দিতে হলে প্রথমে বিনাশ করতে হয় তার সংস্কৃতি, তারপর শিক্ষা। এই দুটি ধ্বংস হয়ে গেলে সেই জাতির আর কিছুই থাকে না। রাজনীতি ও ধর্মের প্রতি এই বিশেষ আগ্রহের দ্বিতীয় কারণ, আমি যেহেতু বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার লেখক, সেহেতু এই জনপদের অধিবাসীদের সকল মত ও পথ সম্পর্কে আমাার জানা থাকাটা জরুরি মনে করি।বাংলাদেশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু তারা সুন্নি, ওয়াহাবি, খারেজি, মারেফতি, মাযহাবি, লা মাযহাবি, আহলে হাদিস, শিয়া, আহমদিয়া―এরকম বহু ভাগে বিভক্ত। ইসলামি দলগুলোও বহু দলে বিভক্ত। এই বাঙালি মুসলমানদের এক পক্ষ আরেক পক্ষকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মুসলমান বলেই স্বীকার করে না। যেমন আহমদিয়ারা। এদেরকে অমুসলিম ঘোষণার জন্য এক পক্ষ রাষ্ট্রের প্রতি এখনো চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছে। আবার কখনো কখনো এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ‘কাফের’ বা ‘মোনাফেক’ বলতেও ছাড়ে না। স্মরণ করা যেতে পারে গত জোট সরকারের আমলে হযরত শাহ জালালের মাজারে বোমা হামলার ঘটনা। সেই হামলায় আহত হয়েছিলেন বৃটিশ রাষ্ট্রদূত আনোয়ার চৌধুরী। সেই হামলা তো আর হিন্দু-বৌদ্ধ বা খৃষ্টানরা করেনি, করেছিল মুসলমানদের একটি দল। মুসলমান হয়ে কেন তারা শাহ জালালের মতো একজন মুসলিম নেতার সমাধিতে হামলা করল? মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে কেন তারা হত্যা করল? ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে কথা বলায় চট্টগ্রামে কেন দশজন আলেমকে হত্যার হুমকি দিয়েছিল? কেন শোলাকিয়ায় ঈদের ময়দানে বোমা হামলা হয়েছিল? কেন বাঙালি মুসলমানের বুদ্ধির মুক্তির লোকনায়ক শরিয়ত বয়াতির বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তাকে জেলে চালান করল? তার মানে বোঝাই যাচ্ছে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে বিভক্তি কোন পর্যায়ে। ধর্মীয়, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক কারণে তাদের পক্ষে এক কাতারে আসা সম্ভব নয়।এমনই বহুধা বিভক্ত বাঙালি মুসলমানের একটি দল হচ্ছে ‘আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত’। এদের মধ্যেও আবার বিভক্তি আছে। কিন্তু তারা একটি জায়গায় ঐক্যবদ্ধ। সেটি হচ্ছে, শরিয়তের পাশাপাশি মারেফাতকেও (আধ্যাত্মবাদ) তারা সমান গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তারা কিছুটা উদার, পরমত সহিষ্ণু, সহজিয়া ও বহুত্ববাদী। ধর্মকে ইহলৌকিক রাজনীতির সঙ্গে মেলবন্ধনের ব্যাপারে তারা অনাগ্রহী। তারা রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকা-না-থাকা নিয়ে উচ্চবাচ্য করে না। রাজনীতিতে তারা প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ করতে চায় না। অন্য ধর্মানুসারীদের প্রতি তারা খানিকটা শ্রদ্ধাশীল। তারা প্রকাশ্যে ওয়াহাবিবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরোধী। তাদের কাছে সৌদি আরব হয়ে সাম্রাজ্যবাদের কোনো পেট্রো ডলার আসে না। তারা অস্ত্রের জেহাদ বা মানুষ হত্যার জেহাদের চেয়ে ‘নফসের জেহাদ’কে (মনের সঙ্গে লড়াই) গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। তারা প্রকাশ্যে ওয়াহাবি মতাবলম্বী জামায়াতে ইসলামী, তাবলিগ জামায়াত ও হেফাজতে ইসলামের বিরোধী। রাষ্ট্রীয় রীতি-নীতি আইন-কানুনের প্রতি তারা শ্রদ্ধাশীল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত জাতীয় সংগীত নিয়ে তাদের কোনো এলার্জি নেই। ফকির লালন সাঁই, হাছন রাজা, শাহ আবদুল করিম, রাধারমণ, জালাল খাঁ প্রমুখ বঙ্গীয় সংগীত-সাধকদের প্রতি তারা শ্রদ্ধাশীল। তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সমর্থক। সেকারণেই চট্টগ্রামে তাদের দশজন আলেমকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। রাষ্ট্র বায়াত্তরের সংবিধানে ফিরে গেলে এ নিয়ে তারা রাজপথ গরম করবে না।এই ‘আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতে’র একজন শীর্ষ নেতার নাম মাওলানা আলাউদ্দিন জিহাদী। তিনি ধর্মীয় বক্তাও। হেফাজত নেতা আহমদ শফীর মৃত্যুর পর আলাউদ্দিন জিহাদীর ফেসবুক পেজ থেকে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে একটি পোস্ট দেওয়া হয়। বলা হচ্ছে, পোস্টটি দিয়েছিল তার পেজের একজন এডমিন। পরে তিনি পোস্টটি দেখতে পেয়ে মুছে দেন এবং লাইভে এসে দুঃখ প্রকাশপূর্বক ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কিন্তু তার প্রতিপক্ষ আহমদ শফির অনুসারীরা তাকে ক্ষমা করতে নারাজ। নারায়ণগঞ্জে তার বিরুদ্ধে তারা ঠুকে দিল আইসিটি আইনে মামলা। সঙ্গে সঙ্গেই আলাউদ্দিন জিহাদীকে গ্রেপ্তার করল পুলিশ। পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিল। বর্তমানে তিনি নারায়ণগঞ্জ কারাগারে বন্দি।রাজনীতি ও ধর্মের একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে এখানে আমার ছোট্ট একটি প্রশ্ন। সম্প্রতি অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মৃত্যুর পর কিংবা সংগীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একদল ‘মানুষ’ যেভাবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিল, তাদের কারো বিরুদ্ধে কি আইসিটি আইনে কোনো মামলা হয়েছিল? আমার জানামতে হয়নি। কেন হয়নি? এজন্য যে, বাংলাদেশের প্রগতিশীল সমাজ আইসিটি আইনের বিরুদ্ধে। ফলে তাদের কেউ উদ্যোগী হয়ে এ আইনে কারো বিরুদ্ধে মামলা করেনি। রাষ্ট্রও উদ্যোগী হয়ে কারো বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়নি। কখনো নেবেও না। কারণ ক্ষমতাসীন দলের এমন একটা ধারণা হয়েছে যে, কবি-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিকর্মীরা তো আমাদের পক্ষে আছেই, তাদেরকে খুশি করার কী দরকার? আমাদের ছেড়ে তারা যাবে কোথায়? আমাদের ছাড়া তো তাদের গতি নাই। তাদের কে মারল, কে গালি দিল, তা নিয়ে অত সিরিয়াস হওয়ার দরকার নেই।যাই হোক, আলাউদ্দিন জিহাদীকে গ্রেপ্তারের পর রাজপথে নামতে অনিচ্ছুক, সহিংসতায় অনিচ্ছুক, বহুত্ববাদী ও সহজিয়াপন্থি এই ‘আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতে’র অনুসারীরা নড়েচড়ে বসল। তাদের সুখনিদ্রা ভেঙে গেল। ‘সুখনিদ্রা’ শব্দটি সচেতনভাবেই ব্যবহার করছি। কারণ, মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে আসা আওয়ামী লীগ সবসময় মধ্যপন্থি, বহুত্ববাদী, সহজিয়াপন্থি এই ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতে’র প্রতি ছিল সহানুভূতিশীল। এই দলের অনুসারীরাও সবসময় আওয়ামী লীগকে নিঃশর্তভাবে সমর্থন দিয়ে এসেছে। তারা ভেবেছিল আওয়ামী লীগ ভবিষ্যতেও তাদের কোনো ক্ষতি করবে না। তাদের মতধারার লোক শরিয়ত বয়াতীকে গ্রেপ্তারের পর তাদের কেউ কেউ মৃদু প্রতিবাদ করলেও সামগ্রিক অর্থে সেই গ্রেপ্তারকে তারা বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু আলাউদ্দিন জিহাদীকে গ্রেপ্তারের পর তারা সম্মুখে সমূহ বিপদ দেখতে পেল। ভাবল, আজ আলাউদ্দিন জিহাদীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, কাল যে অন্য কেউ গ্রেপ্তার হবে না, তার গ্যারান্টি কী?তাই তারা রাজপথে নামল। গত চারদিন ধরে আলাউদ্দিন জিহাদীর মুক্তির দাবিতে সারা দেশে তারা শান্তিপূর্ণ মানব বন্ধন করেছে। বৃহস্পতিবার কুমিল্লায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেছে, চট্টগ্রামে ব্যাপক বিক্ষোভ করেছে, ঢাকায় গিয়াস উদ্দিন আত তাহেরির নেতৃত্বে জাতীয় প্রেসক্লাব ও শাহবাগে মানবন্ধন ও মিছিল হয়েছে। গতকাল শুক্রবারও সারা দেশে মানবন্ধন হয়েছে। আগামী কাল রোববার সারাদেশ থেকে তারা নারায়ণগঞ্জ অভিমুখে যাত্রা করবে। ঘোষণা দিয়েছে নারায়ণগঞ্জ অবরোধের। অর্থাৎ আগামী কাল নারায়ণগঞ্জে একটা বড় ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। তাদের প্রতিরোধ করতে ওয়াহাবিপন্থিরা যদি রাস্তায় নামে, তবে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কাকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।খেয়াল করার মতো ব্যাপার হচ্ছে, এই যে চার দিন ধরে তারা ব্যাপক আন্দোলন করছে, এই ব্যাপারে আমাদের মূলধারার গণমাধ্যমগুলো রহস্যজনকভাবে নীরব। এ নিয়ে কোথাও কোনো সংবাদ নেই। দৈনিক যুগান্তরসহ দু-একটি পত্রিকা ভেতরের পাতায় নিউজ করেছে। কোনো টেলিভিশনে এ নিয়ে কোনো খবর চোখে পড়েনি। মিডিয়ার এই মৌনতা নিয়ে আমার মধ্যে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। কেন তারা নীরব? তারা কি ধর্ম বলতে শুধু হেফাজতকে বোঝে? শাপলা চত্বরে নির্বিচার বৃক্ষ নিধন ও জ্বালাও-পোড়াওকে বোঝে? চাপাতি দিয়ে মানুষ হত্যাকে বোঝে? টঙ্গিতে ওয়াহাবিপন্থি তাবলিগ জামায়াতের ইজতেমাকে বোঝে? অধিকাংশ পত্রিকা প্রতি বছর ইজতেমার খবর মোনাজাতের বিশাল ছবিসহ প্রথম পাতায় লীড করে। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ইজতিমার মাঠ থেকে লাইভ সম্প্রচার করে। কিন্তু ফরিদপুরের আটরশির মাজারে, চট্টগ্রামের মাইজ ভাণ্ডারের মাজারে কিংবা সুরেশ্বরী, চন্দ্রপুরী, শাহ মাখদুম, খান জাহান আলীর মাজারে প্রতি বছর ওরসের সময় যে লাখ লাখ মানুষের সমাগম ঘটে কিংবা কুষ্টিয়ায় লালন সাঁইর আখড়ায় যে বছরে দু-বার হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে―এ নিয়ে কিন্তু কোনো পত্রিকা বা টিভিতে কোনো সংবাদ প্রচারিত হয় না। কেউ কি কখনো দেখেছেন লালনের আখড়া থেকে লাইভ হচ্ছে? আমি দেখিনি। তার মানে বোঝাই যাচ্ছে আমাদের গণমাধ্যম যে একচোখা। তারা শান্তিবাদী, সহিষ্ণু, বহুত্ববাদী কোন গোষ্ঠীর খবর প্রচার করতে অনিচ্ছুক। এগুলোকে তারা খবরের ‘আইটেম’ মনে করে না। আটটেম মনে মনে করে সেসব গোষ্ঠীকে, যারা অসহিষ্ণু, সহিংস, সন্ত্রাসী; যারা ধর্ম নিয়ে বিবাদ করে মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করে, তাবলিগ জামায়াতের দু-পক্ষ যেমন করেছে। আলাউদ্দিন জেহাদীর মুক্তির দাবিতে কাল অবরুদ্ধ হতে যাচ্ছে বন্দরনগরী নারায়ণগঞ্জ। নারায়ণগঞ্জের চাপ হয়ত রাজধানী ঢাকার ওপরও পড়বে। সারাদেশ থেকে মানুষ আসছে, পড়াটাই স্বাভাবিক। আলাউদ্দিন জেহাদীকে মুক্ত করতে না পারলে নিশ্চিতভাবেই তাদের পরাজয় ঘটবে। পরাজিত হলে আওয়ামী লীগের উপর থেকে তাদের সমর্থন ধীরে ধীরে প্রত্যাহার করে নেবে। দেখার বিষয় আওয়ামী লীগ কোন গোষ্ঠীকে চায়? বিভক্ত হেফাজতকে, নাকি বর্তমানে ঐক্যবদ্ধ বাঙালি মুসলমানের শান্তিবাদী দল এই ‘আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত’কে? আগামীকালের ঘটনায় মিডিয়ার কী ভূমিকা হবে, সরকারের কী ভূমিকা হবে, তা দেখার অপেক্ষায়।মহাকালে রেখাপাত২৬.০৯.২০২০[সংযুক্তি : শায়খ হাসান আল আজহারির একটি বক্তব্যের ভিডিও ক্লিপ]

Gepostet von Swakrito Noman am Samstag, 26. September 2020

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধনাটোর কেন্দ্রীয় বাস স্ট্যান্ড ভোগান্তির অপর নাম
পরবর্তী নিবন্ধনাটোরের বাগাতিপাড়ায় গাঁজাসহ ২ জন আটক

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে