নাটোরের ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ গোলা এখন দৃষ্টির আড়ালে

0
223
nATORE KANTHO

নাটোর কন্ঠ : গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু অবহমান বাংলার কাব্যিক চরন, বর্তমানে প্রবাদ বচন। গোলা বা কৃষকের শষ্যগুদাম এক সময় গ্রামের সম্ভ্রান্ত কৃষকের উঠোনে উঠোনে শোভা পেলেও এখন সেটা দৃষ্টির আড়ালে।

পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে কেউ কেউ এই গোলা রেখে দিয়েছেন। এক সময় গ্রাম-গঞ্জের কৃষক তাঁর উৎপাদিত ধানসহ অন্যান্য ফসল সংরক্ষনের জন্য বাড়ির উঠোনের এক কোনে একটু উঁচু জায়গায় গোলা স্থাপন করতেন। যাদের জমির পরিমাণ একটু বেশি তারা ধানসহ অন্যান্য ফসলাদী সংরক্ষণের জন্য গোলা ব্যবহার করতেন।

নাটোরের সিংড়া উপজেলার শেরকোল ইউনিয়নের খড়মকুড়ি গ্রামের আবু বকর সিদ্দিক জানান, ‘বাপ দাদার আমলে বাড়ির উঠোনে এই গোলা আমাদের বাড়িতে ছিলো, এখন কালের বিবর্তনে, চোরের উপদ্রপে বাড়ির ভিতরের ঘরে সংরক্ষণ করা হয় ধান।

নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার বিয়াঘাট ইউনিয়নের রাবারড্রাম এলাকার কৃষক হাসান আলী বলেন, ‘এক সময় মাঠ ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু, আর গোলা ভরা ধান গ্রামের গৃহস্থ্যের পরিচয় বহন করতো।

মানব সভ্যতার বিবর্তন আর আধুনিক কৃষি সংরক্ষন পদ্ধতি আবিস্কারের ফলে হারাতে বসেছে গৃহস্থ্যের ঐতিহ্যবাহী ধানের গোলা। আমরা পুর্বপুরুষদের ব্যবহৃত সেই ধানের গোলা এখনও স্মৃতি চিহ্ন হিসাবে রেখে দিয়েছি।’

গুরুদাসপুর পৌর সদরের আনন্দনগর গ্রামের কৃষক আহাদ আলী বলেন, ‘বাঁশ দিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরী গোল আকৃতির কাঠামোই গোলা। গোলাকৃতির কাঠামোতে এঁটেল মাটির মন্ড তৈরি করে ভেতরে সে মাটির প্রলেপ লাগিয়ে রোদে ভালোভাবে শুকিয়ে তার উপরে পিরামিড আকৃতির টিনের চালা দিয়ে বিশেষ উপায়ে তৈরি করা হতো এই গোলা।

কৃষক তার উৎপাদিত ফসল প্রথমে রোদে ভালোভাবে শুকিয়ে গোলায় সংরক্ষন করতেন। ছোট বড় মানভেদে এসব গোলায় ১০০ থেকে ৩০০ মণ ফসল সংরক্ষণ করা হতো। প্রয়োজন অনুযায়ী সে ফসল বের করে নিজে ব্যবহার কিংবা বিক্রি করতেন।

সেই সময় এক একটা গোলা তৈরীতে খরচ হতো ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। গোলা নির্মাণ করার জন্য বিভিন্ন এলাকায় আগে দক্ষ শ্রমিক ছিল। এখন এই পেশাটিও হরিয়ে গেছে। বাধ্য ও সহজলভ্য হওয়ার কারণে এখন আমরা চট বা পলিথিনের বস্তায় ভরে কোন সময় প্লাষ্টিকের ড্রামে ভরে ফসলাদি সংরক্ষন করি।’

আব্দুলপুর সরকারী কলেজের ভুগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হাসেম আলী জানান, ‘পারিবারিক ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে গোলা ঘরটি তারা টিকিয়ে রেখেছেন। তিনি আরও জানান, সত্তর-আশির দশকের দিকে ওইসব ধানের গোলা কৃষক ও সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় ছিলো।

আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে মানুষের পারিবারিক ব্যবহার্য উপকরণে। কৃষি ফসল সংরক্ষন উপকরনগুলো সহজলভ্য ও টেকসই হওয়ার কারণে সাধারন মানুষ এটাকে সাদরে গ্রহন করছে। ফলে প্রযুক্তির দৌড়ে টিকতে না পেরে গোলা এখন বিলুপ্তির পথে। তবে দেশের বিলুপ্তপ্রায় গোলা ঘর টিকিয়ে রাখতে কৃষি বিভাগের এগিয়ে আসা উচিৎ।’

গুরুদাসপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ হারুনর রশিদ বলেন, ‘বর্তমান সময়ে কৃষকদের আবাদি ও বসবাসের জমির পরিমান কমে যাওয়া, গোলা তৈরিতে জায়গা বেশি লাগা, গোলাকে বায়ুরোধী রাখতে না পারা, গোলা নির্মাণ ও সংরক্ষন খরচ বেশি, পোকা ও রোগের আক্রমণের সম্ভবনা থাকার কারণে ধানের গোলা এখন গুদাম ঘরে পরিণত হয়েছে।

সময়ের কাছে ঐতিহ্য হারাতে বসা কৃষকের গোলার স্থান দখলে নিয়েছে আধুনিক গুদাম ঘর। সেখানে কৃষকের উৎপাদিত শত শত মন ফসল সংরক্ষন করা সম্ভব হচ্ছে। তার পরেও ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষদের উৎপাদিত ফসল সংক্ষনের সহজলভ্য মাধ্যম বাঁশের চাটায়ের তৈরী ডোল বা ঘেড়।’

গোলা, নাঙ্গল, জোয়াল, মইসহ কৃষি কাজে ব্যবহৃত অনেক যন্ত্রপাতি হয়তো মিউজিয়ামেই শোভা পাবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো ছবি দেখেই চিনবে এই কৃষিকাজের উপকরণগুলো। প্রবীণরা শুধু স্মৃতির জানালায় উঁকি দিয়ে দেখবে সেই সমস্ত হারিয়ে যাওয়া দিন।

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধনাটোরের লালপুরে বালু মহাল দ্বন্দ্ব : আ’লীগ নেতার বাড়িতে গুলি : গৃহবধু আহত !
পরবর্তী নিবন্ধনাটোরে বড়াল নদীর ১১৭৮ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের উদ্যোগ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে