নাটোরের প্রমথনাথ বিশী

0
281
nATORE KANTHO

নাটোরের সাহিত্য অঙ্গনের কথা বলতে যাঁদের নামগুলো সর্বাগ্রে উচ্চারিত হয় তাঁদের মধ্যে নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায়। এছাড়াও পরবর্তীতে শফিউদ্দিন সরদার, সমর পাল, জাকির তালুকদার নাটোরের সাহিত্য অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করছেন।

কিন্তু আজ এমন একজন সাহিত্যিক এর আলোচনা করব যিনি নাটোরের গর্ব অথচ তিনি ভাঁট, আকন্দ পুষ্পের মত অকাতরে তাঁর গন্ধসুধা ছড়িয়েছেন নিভৃতে এবং অনেকটা প্রচার বিমুখ ছিলেন। তিনি হলেন নাটোরের গর্ব প্রমথনাথ বিশী।

প্র.না.বি নামে সমধিক খ্যাত কবি সাহিত্য সমালোচক নাট্যকার ও রম্য রচয়িতা প্রমথনাথ বিশীর জন্ম ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের ১১ জুন অবিভক্ত বাংলার তৎকালীন রাজশাহী বর্তমান নাটোর জেলার জোয়াড়ি গ্রামে। তার পিতার নাম নলিনীনাথ বিশী ও মাতা সরোজ বাসিনী দেবী।

তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থার তীর্থস্থান বলতে কলকাতাকে বুঝানো হতো। তাই প্রমথনাথ বিশীর শৈশব ও কৈশর কাটে শান্তি নিকেতনের রবীন্দ্র সান্নিধ্যে। তিনি ১৭ বছর শান্তি নিকেতনের ব্রহ্ম বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন। এরপর ১৯২৭ সালে আইন এবং ১৯২৯ সালে ইংরেজীতে অনার্স সহ বি.এ পাশ করেন রাজশাহী কলেজ থেকে।

১৯৩২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম.এ করেন। ১৯৩৬ সাল থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত কলকাতার রিপন কলেজে বাংলায় অধ্যাপনা করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্র অধ্যাপক এবং বাংলা বিভাগের প্রধানের পদ অলংকৃত করেন।

১৯৩১ সালে তিনি শান্তি নিকেতন পত্রিকা সম্পাদনার কাজে নিযুক্ত হন। এই অভিজ্ঞতা উত্তর জীবনে তাঁর প্রভ‚ত কাজে লাগে। ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৯ পর্যন্ত তিনি আনন্দ বাজার পত্রিকার সহ সম্পাদক হিসাবে কাজ করেন। আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে তিনি রিপন কলেজে অধ্যাপনা পেশায় যোগ দেন।

এ সময় তাঁকে দুটি পেশার পার্থক্য বিচার করতে বলা হলে তিনি একটি মাত্র বাক্য বলেছিলেন “ শিক্ষকতা হচ্ছে পন্ডিতের মূর্খতা আর সাংবাদিকতা মূর্খের পান্ডিত্য। ১৯৬২ থেকে ১৯৬৮ সাল অবধি তিনি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্য হিসাবে তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেন।

এরপর ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত রাজ্য সভার সদস্য মনোনীত হয়ে দিল্লী বাস করেন। লালকেল্লা তাঁর এ সময়ের অভিজ্ঞতার ফসল। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, সমালোচনা, রম্যরচনা প্রভৃতি সাহিত্যের সব ক্ষেত্রেই তিনি প্রতিভার সাক্ষর রাখেন।

প্রমথনাথ ১৯৬০ সালে কেরী সাহেবের মুন্সী উপন্যাসের জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করেন। এরপর ১৯৬১ সালে “প্রফুল্ল কুমার স্মৃতি পুরস্কার”। ১৯৮১ সালে “শরৎ পুরস্কার ”, ১৯৮২ সালে “ বিদ্যাসাগর স্মৃতি পুরস্কার ” এবং ১৯৮৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সম্মান “জগত্তারিনী ” স্বর্ণ পদকে ভ‚ষিত হন।

এছাড়া ১৯৭১ সালে ভারত সরকার তাঁকে “ পদ্মশ্রী ” উপাধিতে ভ‚ষিত করেন।তাঁর বহুল পঠিত উপন্যাসের মধ্যে জোড়াদীঘির চৌধুরী পরিবার, অশ্বত্থের অভিশাপ, কেরী সাহেবের মুন্সী, লালকেল্লা, বঙ্গভঙ্গ উল্লেখযোগ্য। গল্পগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে শ্রীকান্তের পঞ্চম পর্ব, ষষ্ঠ পর্ব, অশরীরী, গল্পের গালি ও গল্প, ধরে পাতা, ব্রহ্মার হাঁসি ইত্যাদি।

নাটকের মধ্যে ঋনং কৃত্যা ঘৃতং প্রিবেৎ, মৌচাকে ঢিল প্রভৃতি। তাঁর কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে দেয়ালী, বিদ্যাসুন্দর, বসন্ত সেনা, যুক্তবেণী, হংসমিথুন উত্তর মেঘ প্রভৃতি তাঁর রচনা সম্ভার বিপুল এবং বিচিত্র।নিজের সাহিত্যিক সত্তা সম্বন্ধে প্রমথনাথের একটি স্পষ্ট দৃঢ় মূল মতামত ছিল।

একবার শ্রী শঙ্করী প্রসাদ বাবুর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন- “বাপু হে! আমার ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে যা চাইবে সব পাবে। তোমরা যাকে “অল রাউন্ডার” বল আর কি? আরে সেটাই তো সমালোচক আর সাহিত্যিকদের রাগের কারন।

আমার গায়ে কোন লেবেল লাগাতে পারে না। কি বলবে আমাকে কবি ঔপন্যাসিক গল্পলেখক, সমালোচক, হাস্যরসিক? তোমাকে চুপিচুপি বলি অনেক রকম লিখি বলে- যেসব সাহিত্যিক একটার বেশী ধরনে লিখতে পারে না তারা আমার উপর বেজায় চটা।”

প্রমথনাথ বিশী অত্যন্ত প্রচার বিমুখ ছিলেন- তাইতো নিজের সম্পর্কে তিনি তাঁর সন্তানদের বলেছিলেন যে কোন সাহিত্যিকের মৃত্যু হইলে সেই সাহিত্যিকের নামের ফলক কিংবা রাস্তার নাম মৃত সাহিত্যিকের নামে রাখার জন্য আবেদন পাহাড় পড়িয়া যায় তোমরা এই ধরনের দীনতা প্রকাশ করিবে না।

প্রমথনাথ ছিলেন অত্যন্ত রসিক হাস্যোজ্জ্বল একজন ব্যক্তি; পরস্পরকে বই উৎসর্গ করা কিংবা দান করা আমাদের সাহিত্যিক মহলের একটা রেওয়াজ। যাঁরা দেন তারাও জানেন যে সময় অভাবে হয়তো এই বইয়ের রস আস্বাদন সম্ভব হবে না। একবার শ্রী ভবতোষ দত্তকে একটি বই উপহার দিয়ে প্রমথনাথ লিখেছিলেন-

“ দানে পাওয়া বই পড়ে না কেহই
তবু দিই সেটা স্বভাব দোষ।
নাইকো নালিশ হবে তো বালিশ
দয়া করে নিন শ্রী ভবতোষ। ”

১৯৮৫ সালের ১০ মে প্রমথ নাথ বিশী ইহলোক ত্যাগ করেন। পরিশেষে বলতে চাই আমাদের নাটোর এ জন্ম নেওয়া প্রমথ নাথ বিশী ছিলেন নাটোরের অহংকার নাটোরের সম্পদ। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হলেও প্রচার ও প্রসারের অভাবে তাঁর সম্পর্কে আমরা খুব কমই জানি।

তাই আমরা যদি তাঁর বিচিত্র লেখনীগুলো সংগ্রহ করে ঐগুলির ভাবার্থ বিশ্লেষণ করে আত্মস্থ করতে পারি তবেই সমৃদ্ধ হবে বাংলা সাহিত্যের ভান্ডার এমন একজন সু সাহিত্যিক প্রতিবাধর মানুষ নাটোরে জন্মেছিলেন বলে আমরা নাটোরবাসী আজ সত্যই গর্বিত।

এ্যাডঃ চিন্ময় সরকার
লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক ও নিবন্ধকার।

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধনাটোর পৌরসভার মেয়র বরাবর খোলা চিঠি
পরবর্তী নিবন্ধনাটোরে পুকুরে ডুবে যুবকের মৃত্যু

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে