বিদ্যাসাগরের জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি – দীপক মিত্র 

0
331

বিদ্যাসাগরের জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি – দীপক মিত্র

বাংলা ও বাঙালির নবজাগরণে যে কতিপয় মানুষ আত্মনিয়ােগ করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁদের মধ্যে অগ্রণী। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বাঙালির আসনে তাঁকে অষ্টম স্থানে বসানাে হয়েছে। বাংলা গদ্যের জনক না হলেও বাংলাভাষাকে দাঁড়ি-কমা চিহ্ন দ্বারা সুষমামণ্ডিত সুখপাঠ্য করে তােলার প্রথম প্রয়াস তাঁরই। তিনিই প্রথম বাংলা লিপি সংস্কার করে সহজবােধ্য করে তুলতে চেয়েছিলেন। প্রথম সার্থক গদ্যকার তাে তিনিই। ১৮৫৫ সালে বাংলা নববর্ষের দিনে প্রথম বর্ণপরিচয় প্রকাশ করে তিনি বাঙালির হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তাঁর দু’বছর আগে নিজগ্রামে অবৈতনিক বিদ্যালয় গড়ে সবার নজর কেড়ে নিয়েছিলেন। আজ থেকে দুশাে এক বছর আগে মেদিনীপুরের এক অখ্যাত গ্রাম থেকে কলকাতা শহরে এসে শুধু নিজে শিক্ষিত হননি, গােটা সমাজে শিক্ষার আলাে জ্বালিয়ে দিতে তাঁর চেষ্টার অন্ত ছিল না তার। তাঁর হাত ধরেই নারী শিক্ষার এক প্রবল ঝড় বয়ে গেছিল সেই সময়ে। তাঁর উদ্যোগেই ১৮৫৭-৫৮ সালে এক বছরে সমগ্র দক্ষিণ বঙ্গে প্রায় ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল।আজকের বেথুন কলেজিয়েট স্কুল থেকে বিদ্যাসাগর কলেজের গােড়াপত্তন তাঁর অক্লান্ত প্রয়াসে। পাশে পেয়েছিলেন সে সময়ের আরও বহু শিক্ষানুরাগী মানুষদের। তাঁরাও কম স্মরণীয় নন। এক কথায়, সমাজ সংস্কারক, বিধবা বিবাহ ও স্ত্রী শিক্ষার প্রচলনে বিদ্যাসাগর ছিলেন অগ্রণীর ভূমিকায়।সামগ্রিকভাবে বাংলার নবজাগরণের পুরােধাপুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তাঁর মেধা, পাণ্ডিত্য এবং দরিদ্র-আর্ত মানুষের প্রতি সহানুভূতি থেকে একদিকে বিদ্যাসাগর’ অন্যদিকে দয়ার সাগর’ উপাধিতে ভূষিত করেছে। ১৮৩৯ সালে হিন্দু ল’ কমিটির যে পরীক্ষা হয়েছিল তাতে তাঁর পারদর্শিতা দেখে কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি দিয়েছিলেন।তাঁর আগে সে সময়ের অলংকার পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন তিনি। সেই পরীক্ষায় প্রথম হবার সুবাদে পুরস্কার স্বরূপ পেয়েছিলেন রঘুবংশ’, ‘উত্তর রামচরিত’, ‘মালতীমাধব’ প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য সংস্কৃত বই। যে বইগুলি তিনি সহজপাঠ্য অনুবাদ করে বাঙালির হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তারই ফল স্বরূপ একে-একে আমরা পেয়েছিলাম আখ্যানমঞ্জরী, কথামালা, সীতার বনবাস, কাদম্বরী, মেঘদূতম, হর্ষচরিত,কিরাতাজ্জ্জুনীয়, বাল্মীকি রামায়ণ প্রভৃতি অনূদিত সাহিত্য সম্ভার, পেয়েছি শেক্সপিয়রের কমেডি অব এররস এর রূপান্তরে ভ্রান্তিবিলাস। পেয়েছি অসংখ্য উচ্চমানের পাঠ্যপুস্তক ও, সংস্কৃত-বাংলা ভাষা শিক্ষা সহজ করার জন্য সমগ্র ব্যাকরণ কৌমুদী।

বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত
কিনা, বাল্য বিবাহ রােধ, যেমন প্রশ্ন তুলেছেন তেমনি তাঁর অন্যতম কৃতিত্ব শিক্ষা সংস্কার, সমাজ সংস্কার।
বহু বিবাহ ও বাল্য বিবাহের মত সামাজিক অভিশাপ দূরীকরণে যে অক্লান্ত সংগ্রাম তাঁকে চালাতে হয়েছিল আজকের দুনিয়ায় তা অনুমান করা কঠিন। ১৮৪১ সালে কর্মজীবন শুরু। একুশ বছর বয়সে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের বাংলার প্রধান পণ্ডিতের পদ। তারপরের ইতিহাস বিস্তৃত। সংস্কৃত কলেজ, বেথুন সোসাইটি, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোনো-না কোনাে ভাবে যুক্ত ছিলেন। নিজ উদ্যোগে সংস্কৃত ডিপােজিটরি প্রেস খুলে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সঙ্গে অনেক সাড়া জাগানাে পুস্তক প্রকাশ করেছিলেন।সেই প্রেস থেকে প্রকাশিত প্রথম বই বেতাল পঞ্চবিংশতি।আর এই বইতে প্রথম বিরাম চিহ্নের ব্যবহার করেছিলেন। তার উদ্যোগে ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকা দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত প্রথম পত্রিকা। ১৮৫৯ সালের ১ এপ্রিল পাইকপাড়া রাজার সহায়তায় মুর্শিদাবাদের কান্দিতে প্রতিষ্ঠা করেন প্রথম ইংরেজি-বাংলা মাধ্যম স্কুল। ১৮৭৩ সালে কলকাতায় গড়ে ওঠা মেট্রোপলিটান কলেজ আজকের বিদ্যাসাগর কলেজ। মেদিনীপুরে তাঁর নামে গড়ে উঠেছে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়। তাঁর নামাঙ্কিত বিদ্যাসাগর সেতু, রাস্তার
নামের মধ্য দিয়ে তিনি আজও বাংলা বাঙালির মানসে উজ্জ্বল। ১৮৬৪ সালের ৪ জুলাই তাঁকে ইংল্যান্ডের রয়াল এশিয়াটিক সােসাইটি সদস্য করে নেয়, খুব কম ভারতীয়ই এই সম্মানের অধিকারী। জন্ম ২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০, প্রয়াণ ২৯ জুলাই ১৮৯১।
এখন যে সমাজ চলছে সেই সমাজে এক দলের সঙ্গে আরেক দলের লড়াই। আর সেদিন দুশাে এক বছর আগে জন্মানাে এই মানুষটি একাই লড়াই করছিলেন একটা গােটা সমাজের বিরুদ্ধে। যখন যে কাজে হাত দিয়েছেন হাজারাে প্রতিবাদেও তিনি নিজের ধ্যানধারণা ও বিশ্বাস থেকে চ্যুত হননি। বরং বাধাদানকারীরাই সময়ে নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে লজ্জিত হয়েছেন।এমনই ছিল তাঁর কাজের প্রতি গভীরতা, একাগ্রতা ও সত্যনিষ্ঠা।আজকের এই আধুনিক সময়ে দাঁড়িয়েও জাতি-ধর্ম-বর্ণের যে অবক্ষয়িত নগ্ন চেহারা সমাজের নানা দিকে দৃষ্ট হচ্ছে এমন দুঃসময়ে তাঁর মতাে আদর্শ সত্যনিষ্ঠ আলোকবর্তিকা পুরুষের বড়ই অভাব অনুভূত হয়। যে শিক্ষার জন্য তিনি প্রাণপাত করেছিলেন সেই শিক্ষাঙ্গনেই আজ তিনি লুণ্ঠিত। আজও নারীর অবমূল্যায়ন-অবমাননা, বাল্যবিবাহ সমাজ থেকে নির্মূল করা যায়নি। জাতের নামে বজ্জাতি বেড়েছে বৈ কমেনি। সমাজের এই দিকগুলি নির্মূল করা হবে তাঁর প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা জানানাে। অনেক বেশি কাজের ও প্রয়ােজনীয় হবে স্কুলছুটদের স্কুলে টেনে আনা ও বিদ্যায়তনগুলিতে প্রকৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা। এমন এক সময় আমরা এই মানুষ দুশো এক বছর সমহিমায় পালন করছি যখন বাংলা ভাষা এবং বাঙালির আত্মমর্যাদাবােধ নিয়ে বাঙালির বাঙালিত্ব নিয়ে সব মহলে সংশয়বিদ্ধ আলােচনা বিদ্যমান। বাংলা ভাষার স্কুলগুলির পড়ুয়ার সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান। এই সংশয় ও উৎকণ্ঠার মধ্যে দিয়ে বিদ্যাসাগরের দুশো এক বছরের জন্মদিন।

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধএখন ঘুমোতে যাবার কথা ছিলো না- মোর্শেদ লিখন এর কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধআদিবাসীদের জমি শেষ হওয়ার পর কমিশন দিয়ে কি হবে? -রবীন্দ্রনাথ সরেন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে