“মরীচিকা” শাপলা জাকিয়া‘এর ভৌতিক গল্প -পর্ব-০৫

0
448
Shapla-Zakia

“মরীচিকা ” ভৌতিক গল্প
পর্ব-০৫
-শাপলা জাকিয়া

আমি রুনা ভাবির ফোন চেয়ে নিলাম। একটু আড়ালে এসে প্রবালকে ফোন করে বললাম,
-এখন বাসায় আসতে পারবে?
-কাজ করছি । এক ঘন্টা পর অফিস ছুটি হবে, তখন আসি। নাম্বারটা কার? কোথা থেকে ফোন করছো?
আমি ওর প্রশ্নে ঘটনা বর্ণনার সুযোগ পেয়ে হড়বড় করে বললাম,
-প্রবাল! মেয়েটাকে আবার দেখেছি। আমাকে ফ্ল্যাট থেকে চলে যেতে বলছিল। ভয়ে আমি এক দৌড়ে রুনা ভাবির এখানে চলে এসেছি।

সেলফোন ফেলে আসায় তোমাকে ভাবির মোবাইল থেকে কল করতে হলো।
ফোনের অপর প্রান্তে প্রবালকে কিছুক্ষণ চুপচাপ শোনায়। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে প্রবাল বলে,
-ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে এসেছো?
-না, তাড়াহুড়োয় লক করা হয়নি, আর এখন আমি ঐ ফ্ল্যাটে ঢুকে চাবি নিয়ে তারপর লক করতেও পারবো না। তুমি এসো প্লিজ।
-সকালে তোমাকে ওষুধ খাইয়ে এসেছি, নিশ্চয় দুপুরের ওষুধটা খাওনি?
-আসলে খাবো ভেবেছিলাম কিন্তু দুপুরে খাওয়ার পর একটা বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তাই ওষুধ খাওয়া হয়নি।
– বইটা নিশ্চয় ভূতের গল্প?
-অই আর কি!

আমি আমতা আমতা করলাম। ডাক্তারের নিষেধ আছে ভূতের গল্প পড়া, ওষুধ খাওয়ার পর থেকে আর ভয় পেতাম না বলে বহুদিন পর আজই একটা ভৌতিক গল্প সাহস করে পড়ছিলাম। ভয় লাগেওনি, বরং ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। অথচ ঘুম ভাঙ্গাতে চলে এলো ভুতুড়ে মেয়েটা। যদি ডাক্তারের কথা সত্যি না হয়ে দীপুর কথা সত্যি হয় তবে মেয়েটি আমার কল্পনা নয়, কোন এক রহস্যময় জগতের বাসিন্দা।

ভাবনায় ছেদ পড়লো প্রবালের রাগ রাগ গলায়। সে রেগে গেছে। বললো,
– মেঘলা! তোমার নিজের সুস্থ হওয়ার কোন ইচ্ছা নেই। এটা তো কোন ছেলেখেলা না, ডাক্তারের নির্দেশ না মেনে চললে, তোমার অবস্থা দিন দিন আরো খারাপ হবে! তুমি কি শখ করে পাগল হতে চাও?
-শোন, ডাক্তার কিছু করতে পারবে না। এটা অন্য ব্যাপার।

ঐ মেয়েটার অস্তিত্ব আরেক জগতে, এই জগতে আমার সাথে কানেক্ট করতে পারছে,কারণ আমি মিডিয়াম হিসাবে ভালো।
– মিডিয়াম মানে?
-যারা প্রেতলোকের সাথে যোগাযোগ করতে পারে।
– এই তথ্য তোমাকে কে দিলো?
-দীপু ভাই দিয়েছে। রুনা ভাবির কাজিন। উনিও খুব ভালো মিডিয়াম। এসো, আলাপ হলে অনেক কিছু জানতে পারবে।
প্রবাল থমথমে গলায় বললো,
-আসছি।
আমি বললাম,
-আসার সময় ফিটকিরি আর মোমবাতি নিয়ে এসো।
-কেনো?
-লাগবে, দীপু ভাই চেয়েছে।
ফোনটা রুনা ভাবিকে ফেরত দিয়ে দীপুকে বললাম,
-প্রবাল বোধহয় মিডিয়াম ব্যাপারটা বিশ্বাস করবে না। ও ভূত -প্রেত বিশ্বাস করে না।
দীপু বললো,
– উনি যেহেতু তাদের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারেন না, সো বিশ্বাসও করেন না। ওনার দোষ নাই। আমি বুঝিয়ে বলবো।
কিন্তু দীপু প্রবালকে প্রভাবিত করতে পারলো না। প্রবাল মনোযোগ দিয়ে সব শুনে বললো,
– কিছু মনে করবেন না, আপনি যেটা করতে চাইছেন,মানে মেঘলাকে নিয়ে ঐ ফ্ল্যাটে বসে ভূতের সাথে বৈঠক, এটা মেঘলার মনের ওপর প্রচণ্ড চাপ ফেলবে। আমি রিস্ক নিতে চাইনা। তাছাড়া ভূত বলে কিছু আছে বলে বিশ্বাস করিনা।

প্রবাল এরপর ডাক্তারকে ফোন করলো, ডাক্তার ওষুধ আরেক ডোজ বাড়িয়ে দিলেন। কিন্তু আমি কিছুতেই আমাদের ফ্ল্যাটে ঢুকতে রাজি না হওয়ায় প্রবাল একাই গেলো। একটা ডাউস সুটকেসে জিনিসপত্র ভরে আমাকে নিয়ে একটি হোটেলে উঠলো। রাজশাহী মায়ের কাছে যেতে চাইলাম, রাজি হলো না, কারণ ওর ধারনা চোখের আড়াল হলেই আমি ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দেবো।

তাছাড়া প্রতি সপ্তাহে একবার আমাকে সাইকোলজিস্টের কাছে গিয়ে কাউন্সেলিং করাতে হবে, রাজশাহী গেলে সেটা কঠিন হয়ে পড়বে। এই অস্থির সময়ে মা কাছে থাকলে ভালো লাগতো, কিন্তু ঠাণ্ডা কাশিতে মা নিজেই এখন কাবু, বয়সও হয়েছে, তাকে জার্নি করে রাজশাহী থেকে ঢাকা আসতে বলা আর শাস্তি দেয়া একই কথা।
হোটেলে থেকে আমি যে খুব শান্তি পাই, তা না।

প্রবাল খুব ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসে, কিন্তু আমি অতোটা এনজয় করিনা। তার প্রধান কারণ হলো এই হোটেলে রাত কাটানোর ব্যাপারটা। আমাদের আগে কে থেকে গেছে কে জানে! তাছাড়া হোটেল রুমের সিলিং ফ্যানে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার ঘটনা তো পেপারে মাঝে মাঝে পড়ি। একটা আত্মহত্যা বা খুনের ঘটনা যদি কোন রুমে ঘটে তবে তো আর হোটেল কর্তৃপক্ষ ঐ রুমটা নিষিদ্ধ ঘোষনা করে না। সাময়িক বন্ধ থাকে। কেস মিটলে খুলে দেয়। তখন সেই রুমে আবার অন্য কেউ এসে থাকে।

বিয়ের পর প্রথমবারের মতো প্রবালের সাথে কক্সবাজার বেড়াতে গেছিলাম। বাস থেকে নেমে রিক্সাওয়ালাকে প্রবাল জানালো আগে থেকে বুকিং দিয়ে রাখা হোটেলের নাম, সেখানে নিয়ে যেতে বললো। রিক্সাওয়ালা চোখ কপালে তুলে বলেছিল,
-ঐ হোটেল? মাস ছয় আগে দূর্ঘটনা ঘটছিল একখান, আপনেরা জানেন না? জামাই- বউ শরীরে আগুন দিয়া আত্মহত্যা করছিল। তা মরার আগেও মাইনষের আক্কেল হয় না, অন্যের হোটেলে আইসে মরলে তার ব্যবসার ক্ষতি হয়ে যায় না ?
আমি প্রবালকে কনুই এর খোঁচা আর চোখের ইশারায় জানিয়েছিলাম, আত্মহত্যা করা হোটেলে যেতে চাই না।
প্রবাল কানের কাছে ফিসফিস করে বলেছিল,
-এসব রিকশাওয়ালাদের সাথে হোটেলগুলির আঁতাত থাকে। এক হোটেলের কাস্টমারকে এভাবে আরেক হোটেল টেনে নেয়। এই বেটার সব বানানো গল্প।
প্রবাল আমাকে নিয়ে সেই হোটেলেই উঠেছিল। আমার রুমে ঢুকেই মনে হয়েছিল, এটাই সেই সুইসাইড করা রুম। দরজা, জানালা সব নতুন মনে হচ্ছে, অথচ হোটেলটা অতো নতুন নয়। প্রবালকে বলায় ও রসিকতা করে বলেছিল,
-সুইসাইড করা জামাই বউ রাত দুপুরে দেখা করতে আসলে তো মুশকিল, আমরা নতুন বিয়ে করা কাপল, আমাদের তো প্রাইভেসি বলে একটা ব্যাপার আছে!

সেইরাতে ঘুমিয়ে পড়ার পর আমার ঘুম ভেঙ্গেছিল প্রচণ্ড শ্বাস কষ্টে। চোখ খুলে দেখেছিলাম ঘর ভর্তি ধোঁয়া, যেন আগুন লেগেছে! আমার ধাক্কাধাক্কিতে প্রবাল ঘুম থেকে উঠে অবাক হয়েছিল, সে কোন ধোঁয়া দেখতে পাইনি। ও ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছিল যে, রিকশাওয়ালার বানানো গল্প আমাকে প্রভাবিত করেছে।
এতোদিন পর আজ দীপুর কথাগুলি শুনে মনে হচ্ছে, সেরাতে কি রিকশাওয়ালার গল্প আমাকে প্রভাবিত করেছিল,না সুইসাইড করা জামাই বউ আমাকে তাদের দূর্ঘটনাটা জানাতে চেয়েছিল?

এবার প্রবাল আমাকে নিয়ে যে হোটেলটাতে উঠেছে তা ওর অফিসের অতি কাছে। জানালা দিয়ে দেখা যায়। আমরা যখন হোটেল রুমে ঢুকলাম তখন রাত সাড়ে নয়টার মতো বাজে। রুমেই খাবার অর্ডার করলো প্রবাল। আমার জন্য বেচারা মুশকিলে পড়েছে, আমি অপরাধবোধ থেকে কথা বলছি কম, প্রবাল একেবারেই বলছে না।
চুপচাপ খাওয়া-দাওয়া সেরে প্রবাল তার মোবাইল নিয়ে পড়লো।

অনলাইনে বাসা খুঁজছে।
বেশিক্ষণ চুপ থাকলে আমার দমবন্ধ লাগে তাই আর কথা না বলে পারলাম না,
-তুমি নতুন বাসা খুঁজছো, তারমানে বিশ্বাস করছো, ঐ ফ্ল্যাটে সমস্যা আছে।
-না বিশ্বাস করছি না, তোমার মানসিক শান্তির জন্য এটা করতে চাই।
-সরি।
-মুখে সরি বলবে না, কাজে সরি বলবে। ডাক্তারের কোন নির্দেশ অমান্য করতে পারবে না, যদি সেটা পারো তবে সেটাকে তোমার ‘সরি’ হিসাবে ধরে নেবো।
আমি বললাম,
-আচ্ছা।
প্রবাল বললো,
-তাহলে মেডিটেশনটা সেরে ফেলো। প্রতিরাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে তোমার মেডিটেশন করার কথা।
আমি মেডিটেশনের জন্য রেডি হলাম। প্রবাল ঘরের আলো কমিয়ে দিলো। বিছানার ওপর বসে চোখ বন্ধ করতেই ধূসর শাড়ির মেয়েটির মুখ সামনে চলে এলো আর সাথে সাথে মেয়েটির নাম মনে পড়ে গেলো, সে তার নাম বলেছিল রূপালী।
মেয়েটির মুখটি এতো জীবন্ত, স্পষ্ট মনে হলো যে আমি চোখ খুলে ফেললাম। পাশে বসে থাকা প্রবালকে আঁকড়ে ধরে বললাম,
-রূপালী!
-রূপালী কে?
-ঐ মেয়েটা, আমি মেডিটেশন করবো না, রূপালী চলে আসছে।
প্রবাল হতাশ গলায় বললো,
-আমি সিগারেট কিনতে যাচ্ছি, একা রুমে তো থাকতে পারবে না, সাথে যাবে?
অন্যসময় হলে আমি রাগ করতাম সিগারেট খেতে চাওয়ার জন্য আজ আর ওকে কিছু বললাম না। বেচারার ওপর ধকল যাচ্ছে।

রাত পৌনে বারোটা, চারদিকে লোকজন কমে এসেছে। বেশ ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছে, হয়তো বৃষ্টি হচ্ছে কাছেপিঠে। এরকম আবহাওয়ায় মন রোমান্টিক হয়ে ওঠে কিন্তু আজ হলো না। আতংকের দম বন্ধ অনুভূতি আমাকে সহজ, স্বাভাবিক হতে দিচ্ছে না।

একটা মেয়ে উগ্র সাজপোশাকে আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছিল। একটা লোক এসে তারসাথে কিছুক্ষণ কথা বললো, তারপর লোকটি আগে আগে আর মেয়েটি তার পিছন পিছন চলে গেলো। আমার মনে হলো, এই লোক মেয়েটিকে কোথাও নিয়ে গিয়ে খুন করবে। এরকম আমার আগেও মনে হতো, কিন্তু পাত্তা দিতাম না।

দীপুর সাথে কথা বলার পর আজ মনে হচ্ছে, এসব কথা যদি সিরিয়াসলি নেই, তাহলে কি হবে?
প্রবালের সিগারেট টানা শেষে আবার হোটেল রুমে ফিরে এলাম। প্রবাল আমাকে ওষুধ খাওয়ালো, ঘুমের ওষুধ দিয়েছে কিনা জানিনা, কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমে আমার চোখ বন্ধ হয়ে এলো।

ভোর তিনটার দিকে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। খুব গরম লাগছে। ঘামে চুপচুপে শরীর আমার। এসি কি কাজ করছে না? প্রবাল কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। ওর মাথায়, পিঠে হাত দিয়ে দেখিলাম, একটুও ঘামেনি। তারমানে শুধু আমারই গরম লাগছে। পানি খাবো বলে উঠে বসলাম। আর তখনই কি যেন আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো! মনে হলো একটা বিড়াল। আমি চিৎকার করে উঠলাম!

সেই চিৎকারে প্রবাল ঘুম থেকে উঠে পড়লো। বিড়ালের কথা শুনে রুমের বাকি সব লাইট জ্বালিয়ে খুঁজলো, ওয়াশরুম, বারান্দা সব দেখে বললো,
-কোথাও বিড়াল নেই।
কিন্তু আমার সামনে এসে চমকে উঠলো পর মুহূর্তেই!
-তোমার মুখে,গলায় এমন নখের আঁচড় কেনো?
আমি খসখসে গলায় বললাম,
-মহিম কোথায়?
বলে নিজেই চমকে উঠলাম, এই কন্ঠ তো আমার নয়, এই কন্ঠ রূপালীর!

চলবে….

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধ“মরীচিকা” -শাপলা জাকিয়া‘এর ভৌতিক গল্প -পর্ব-০৪
পরবর্তী নিবন্ধ“বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব”- ফাহমিদা ইয়াসমিনের কবিতা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে