মহালয়ায় জ্যোতির্ময়ী জগৎমাতার আগমন বার্তা -দেবাশীষ চৌধুরী

0
318

মহালয়ায় জ্যোতির্ময়ী জগৎমাতার আগমন বার্তা -দেবাশীষ চৌধুরী

বৈচিত্র্য আর পূর্ণতার ছন্দময় শরতে যখন নদীকূলে বা খাল-বিলের ধারে কাশবনে শুভ্রতার তরঙ্গায়িত নাচন, শিশিরকণার সাথে কমলা বৃন্তের শ্বেত শিউলি আর তুলতুলে সবুজ ঘাসের অপূর্ব মিতালি, আকাশের নীলিমায় আদুরে নরম তুলোর পেঁজার মতো শুভ্র মেঘদলের উচ্ছ্বল ছোটাছুটি, দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ কচি ধানগাছের ক্ষেতে সস্নেহে পরিচর্যায় ফলন সম্ভাবনার হাতছানিতে কৃষকপল্লীতে আশা জাগানিয়া আনন্দ-গুঞ্জরণ, রঙ-বেরঙের পুষ্পরাজি মাধবী, মল্লিকা, কামিনী, বকুল, শাপলা, গোলাপ, পদ্মের প্রাচুর্যতা আর পত্রপল্লবে সবুজের সমারোহ, দোয়েল-শ্যামা-পাপিয়ার কলকাকলি ও রৌদ্র আর মেঘপুঞ্জের অনিন্দ্য-সুন্দর লুকোচুরিতে আলোছায়ার মতো মনমাতানো দৃশ্যপটের মুখোমুখি হই, তখন সূচনা হয় ‘মহালয়া তিথি’র। ‘মহালয়া’ মানে পিতৃপক্ষের শেষ দিন ও দেবীপক্ষের শুভারম্ভ। মহালয়ার মধ্য দিয়ে মর্ত্যলোকে দেবী দুর্গার আবাহন।

৯০ বছর ধরে মহালয়ার ভোর শুরু হয় কিংবদন্তিতুল্য প্রবাদপ্রতিম পুরুষ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের (১৯০৫-১৯৯১) মন মোহিত করা মায়াবী কণ্ঠের ‘আশ্বিনের শারদ প্রাতে/বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জরী/ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা/প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত/ জ্যোতির্ময়ী জগৎমাতার আগমন বার্তা…..’ দিয়ে। আজও তাঁর স্থলাভিষিক্ত কেউ হতে পারল না। আকাশবাণী কোলকাতা বেতারের সংগীতালেখ্য ’মহিষাসুরমর্দিনী’। চিত্রনাট্য লিখেছিলেন বাণীকুমার, সুরকার ছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক ও চণ্ডীপাঠ করেছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। অবশ্য ১৯৭৬ সালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে বাদ দিয়ে মহানায়ক উত্তমকুমারকে দিয়ে নতুন অনুষ্ঠান ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম্’ করানো হয়েছিল কিন্তু তা মানূষ মোটেও গ্রহণ করলো না। সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। এমনকি বিক্ষুদ্ধ জনতা বেতার অফিস ভাংচুর করেছিল। বিক্ষুদ্ধ মানুষকে সন্তুষ্ট করতে সেবছরই ষষ্ঠীপুজার দিন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ’মহিষাসুরমর্দিনী’ আবার সম্প্রচার করতে হয়েছিল। উল্লেখ্য, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ১৯৮০ সালে মহানায়ক উত্তমকুমারের মৃত্যুর দিনে শোকযাত্রার ধারাবিবরণী পাঠ করে শ্রোতাদের অঝোরে কাঁদিয়েছিলেন।

মহালয়া তিথির ধর্মীয় ও সামাজিক তাৎপর্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শাস্ত্রমতে, শুভ মহালয়ার দুটো দিক।প্রথম দিক হচ্ছে দেবী দুর্গা মায়ের আগমনী ধ্বনি। পবিত্র চণ্ডীপাঠ, মহালয়ার ঘট স্থাপন ও বিশেষ পূজার মধ্য দিয়ে ঢাক-শাঁখ-কাঁসা-উলুধ্বনিতে মর্ত্যলোকে মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গাকে আহ্বান করে শারদীয়া পুজোৎসবের প্রস্তুতি গ্রহণ। শারদীয় দুর্গোৎসব বাঙালির কাছে আবহমানকাল থেকে আনন্দবীণায় ঝংকৃত প্রাণের উৎসব। এই উৎসবের সাথে মিশে আছে বাঙালির অনুরাগ ও আবেগ। ধর্মীয় আবহের বাইরেও সামাজিক ঐক্য, অন্যায়ের প্রতিবাদী চেতনা আর সর্বজনীনতার ছকে অনন্য নন্দিত উৎসব শারদীয়া পুজোৎসব। সংগীত-নৃত্য-চিত্র- শিল্পকলারও যোগসূত্র আছে এই উৎসব উদযাপনের সাথে। ২০২০ সালে বিশ্বসংস্কৃতি বিভাগের সেরা উৎসবের তালিকায় নাম উঠানোর জন্য বাঙালির শারদোৎসব ইউনেষ্কোর স্বীকৃতি পেল। মহালয়া থেকে দুর্গাপূজার আগমন ধ্বনি শুনতে পাওয়া গেলেও আশ্বিন মাস মল (মলিন) মাস হওয়ার কারণে এবার দুর্গাপুজা শুরু হবে ২১ অক্টোবর থেকে।

দ্বিতীয় দিক হচ্ছে জলাশয়ে কোমর সমান জলে দাঁড়িয়ে তিল ও জল দিয়ে তর্পণ বা পার্বণ শ্রাদ্ধ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করা। শাস্ত্রীয়বিধি ও মন্ত্রোচ্চারণপূর্বক প্রথমে পূর্বপুরুষ তথা পিতৃ-মাতৃকুল ও পরবর্তীতে শ্বশুরকুল, গুরু, বন্ধু-বান্ধব, পুত্রক-অপুত্রক, পরিচিত- অপরিচিত সকলের উদ্দেশ্যে তর্পণ বা পার্বন শ্রাদ্ধ করে তাঁদের আত্মার তৃপ্তি সাধন করা।আবার পূর্বপুরুষের আত্মা তর্পণের মাধ্যমে সন্তুষ্ট হয়ে উত্তরপুরুষদের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য আশির্বাদ করেন। অর্থাৎ ‘আব্রহ্মস্তম্ব পর্যন্তং জগৎ তৃপ্যতু’ (সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা থেকে তৃণরাজি- এ জগতের সকলেই তৃপ্ত হও।)- এই মন্ত্র সকল তর্পণকারীকে উচ্চারণ করতে হয়। হিন্দু ধর্মের তর্পণের মন্ত্রে আপন-পরসহ সমগ্র ভেদাভেদের উর্ধ্বে উঠে সাম্যবাদী ভাবসহ বিশ্বজনীনতার পরিচয় পাওয়া যায়। বিদেহী পূর্বপুরুষসহ সকলের আত্মার তুষ্টিসাধন ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের নামই তর্পণ। সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে পূর্বপুরুষের প্রতি উত্তরপুরুষের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের অনন্য এক প্রক্রিয়া এই মহালয়ার তর্পণ। উত্তরপুরুষ তার শেকড়ের সন্ধানে গিয়ে পূর্বপুরুষের সাথে আমৃত্যু যোগসূত্র স্থাপনেরও প্রক্রিয়া তর্পণ।

এই মুহূর্তে মর্ত্যকুলের বিশ্বমানব মহামারি করোনা আতংকের আবহে নিমজ্জিত। অনেক পরিবার প্রিয়জন হারানোর বেদনায় মূহ্যমান, অনেকে চাকুরি হারিয়ে উপার্জনশূন্য, অনেকে করোনায় আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী। অন্যদিকে কতিপয় অসুরসম মানুষের কাছে সাধারণ মানুষ জিম্মি হচ্ছে নিত্য। নারী ও পুরুষ নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন, চিরচেনা ও নিত্যনতুন বৈষম্যের যাঁতাকলে নিষ্পেষণ, বৃদ্ধ মাতা-পিতার প্রতি অবজ্ঞা ও বৃদ্ধাশ্রমে প্রেরণ, খুন, সন্ত্রাস, প্রতারণা, ভেজালের কালো উৎসব, মুনাফালোভীদের অপতৎপরতা, উঁচু থেকে নিচুস্তরে দূর্নীতির করাল গ্রাস, মাদকের ভয়াল থাবা ইত্যাদি অগণন সমস্যা ও দুর্গতির অতল গহ্বরে সাধারণ মানুষের বসতি। মানবজাতির উপর কৃপাদৃষ্টিপূর্বক দুষ্টের দমন করে দুর্গতিমোচন ও কল্যাণ সাধন করার জন্য জগৎমাতা দেবী দুর্গার কাছে আমাদের একান্ত প্রার্থনা।

শুভ মহালয়া। জয় মা দুর্গতিনাশিনী।

দেবাশীষ চৌধুরী
১৭/০৯/২০২০খ্রিস্টাব্দ

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধআয়না – কাজী সোহেল এর কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধএসো রোদে মেলে দিই -কবি সুজিত চট্টোপাধ্যায়‘এর কবিতা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে