রাজকবি: সেকাল একাল- জাকির তালুকদার

0
242
জাকির-এনকে

রাজকবি: সেকাল একাল- জাকির তালুকদার

হোমারকে অন্ধ করে দিয়েছিল তার নগরীর পরিচালকরা।
হোমার ছিলেন চারণকবি। গ্রিক নগররাষ্ট্রগুলিতে ঘুরে বেড়াতেন আর মানুষকে ইলিয়াড-ওডেসির গল্প কবিতা গান শোনাতেন। একাধিক নগরের শাসকরা দাবি করতেন যে হোমার তার নগরের কবি। এথেন্সের পরিচালকরা হোমারকে অন্ধ করে দিয়েছিল যাতে তিনি এথেন্স ত্যাগ করে অন্য কোনো শহরে যেতে না পারেন। কারণ হোমারকে নিয়ে গর্বিত ছিল এথেন্স। হোমার তাদের শহরের সন্তান– একথা জেনে গর্বিত হবার কথা যে কোনো শহরেরই। অর্থাৎ কবির গর্বে গর্বিত হতো তখনকার মানুষ এবং শাসকরা।

এই যে যত রাজা-বাদশাহর গল্প আমরা শুনি, যারা বিভিন্ন কবি-শিল্পী এবং গুণীদের স্থান দিতেন তাদের দরবারে, তারা কিন্তু এমনি এমনি করতেন না এই কাজ। করতেন নিজেদের সম্মানের জন্য। কোন রাজার দরবারে কতজন গুণী মানুষ আছেন, তার ওপর নির্ভর করত সেই বাদশাহ বা রাজার সুনাম। ‘আল মুকাদ্দিমা’ রচয়িতা ইবনে খালদুনের সময়টি ছিল ঝঞ্ঝাময়। বার বার বদল হয়েছে শাসনকর্তা। একজন ছিলেন অন্যজনের বিরোধী। কেউ কেউ ছিলেন ঘাতকও। কিন্তু সবাই চেয়েছেন যে ইবনে খালদুন তার দরবারে থাকুন। কারণ সেই সময় তাঁর মতো বিদ্বান এবং যুগপৎভাবে বিখ্যাত পণ্ডিত আর কেউ ছিলেন না।
খলিফা আল মামুন শুধু তার সাম্রাজ্যের গুণীদেরই দরবারে সম্মানের সাথে জায়গা করে দেননি, বরং তিনি গ্রিস এবং ভারতবর্ষ থেকেও গুণীদের নিয়ে গিয়েছিলেন বাগদাদে। আল মামুনের প্রতাপের যতটা সুনাম ছিল, তারচেয়ে বেশি ছিল তার দরবারে গুণীজনের সমাবেশের সুনাম।
সম্রাট আকবরের রাজসভায় নবরত্নের সমাহার তাকে পৃথিবীর সর্বকালের সেরা বাদশাহদের তালিকায় স্থান করে দিয়েছে।
তাই বলতে হয়, সেকালে রাজকবিরা রাজা-বাদশাহর পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন তাদের গুণের জন্য, একই সাথে রাজার সুনাম-স্বার্থের জন্য।
ব্রিটিশ আমলে দেশীয় রাজ্য ছিল হাজার হাজার। কিন্তু তাদের সবার মধ্যে নদীয়ার মহারাজার নামটিই কেবলমাত্র উচ্চারিত হয় তার রাজসভায় সেই আমলের নবরত্নের কারণেই। কাজেই রাজা-বাদশাহরা যে গুণীদের কদর করতেন, কবিদের রাজসভায় জায়গা করে দিতেন, তা তাদের নিজেদের জন্য সুনাম বয়ে আনত বলেই।
উদাহরণ আরো অনেক দেওয়া যায়। গজনীর সুলতান মাহমুদ, বাংলার সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ, বা আরাকান রাজসভার উদাহরণ তো প্রায় সকলেরই জানা।

কিন্তু সেই সময়ের সাথে তো বর্তমানের বাংলাদেশের রাজদরবারকে মেলানো যাবে না। রাজদরবার উঠে গেছে। রাজা-সম্রাটরা এখন অন্য নামে বিরাজ করেন পৃথিবীতে। বাংলাদেশেও। সেই বদলের সাথে সাথে বদলে গেছে রাজশক্তির কাছে বা রাষ্ট্রশক্তির কাছে কবি-শিল্পী-জ্ঞানীদের অবস্থানও। এখন এখানে কবি-শিল্পীরা সম্মানীত নন, অনুগ্রহভাজন। কবিদের মধ্যে কে রাষ্ট্রশক্তির প্রতি বেশি অনুগত, কে রাষ্ট্রের দ্বিচারিতা দেখেও মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন, তা দিয়েই নির্ধারিত হয় রাষ্ট্রের কাছ থেকে কে অনুগ্রহ লাভ করবেন। নির্ধারিত হয় কে জাতিসংঘে রাষ্ট্রপ্রধানের সফরসঙ্গী হবেন বা কে বিদেশে বাংলাদেশের সাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব করবেন।
আর একটি বিষয় লক্ষণীয়। এই বর্ষিয়ান লেখক-কবিরা তাদের শ্রেষ্ঠ গল্প-উপন্যাস-কবিতাগুলো কিন্তু রচনা করেছিলেন তাদের যৌবনে রাষ্ট্রশক্তির বিরোধী অবস্থানে থেকেই। বাংলাদেশে যেহেতু ষাটের দশক থেকেই প্রবল হয়ে উঠেছিল বামপন্থা, এবং সমৃদ্ধ পাঠক মানেই ছিল বামপন্থী, তাই তখন কবিরাও নিজেদের শরীরে একটি বাম আবরণ লাগিয়ে রাখতেন। বামপন্থী পত্রিকা এবং প্রকাশকরা জায়গা দিতেন এই কবিদের, বামপন্থী ছাত্রসমাজ ছিল তাদের পাঠক, পৃষ্ঠপোষক, সম্মানদাতা। বামদলগুলো তখন তাদের সফরে পাঠাত চীন-রাশিয়া-পূর্ব ইউরোপে-ভিয়েতনামে। সেই সময়েই আজকের নামী লেখক-কবিরা পরিচিতি পেয়েছেন। তারা তখন লিখেছেনও প্রধানত মানবতাবাদী প্রগতিশীল রচনা। আশির দশক পর্যন্ত অব্যাহত ছিল সেই প্রবণতা। সেগুলি ভাঙিয়েই তারা খাচ্ছেন আজও। গত দুই দশকে তাদের রচনার দিকে তাকালে দেখা যাবে সবই চর্বিত চর্বন।
কেউ গেছেন আগের আমলের রাজসভায়, কেউ এই আমলের।

সেকালের রাজকবিরা ছিলেন সম্মানীত। একালের রাজকবিরা অনুগৃহীত।

[সংবিধিবদ্ধ অবহিতকরণ: যে কোনো ব্যক্তির যে কোনো দলে যোগ দেবার পূর্ণ অধিকার রয়েছে।]

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধবাল্যবিয়ে দেয়ার অপরধে বর-কনের পিতাকে জরিমানা
পরবর্তী নিবন্ধনাটোরে নতুন ট্রেন ‘বাংলাবান্ধা এক্সপ্রেস’, ভ্রমণ পিপাসুদের সহজ হবে দার্জিলিং ভ্রমণ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে