লুবনা কাহিনি ও শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস- তন্ময় ইমরান

0
269
তন্ময়

লুবনা কাহিনি ও শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস- তন্ময় ইমরান

খ্রিস্ট্রিয় ৯৬৫ সালের কোনও এক দুপুর। দামেস্ক থেকে ভূমধ্যসাগর দিয়ে জাহাজে ফিরছিলো লুবনা। জাহাজের যাত্রা তার পোষায় না। সারা রাস্তা অসুস্থ কেটেছে। বমি করতে করতে জান শেষ, সী সিকনেস।

তার হয়ে এসব দীর্ঘযাত্রার কাজগুলো ফাতিমাই করে। ফাতিমাকে কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করলো। ফাতিমা বাজে ধরনের জ্বরে পড়ায়, এবার তার না গিয়ে উপায় ছিলো না। প্রাচীন ভারতীয় বিজ্ঞানী ও গণিতজ্ঞ আর্যভট্টের একটা বইয়ের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিলো।

ভারতীয়দের বই পাওয়াটা খুব কঠিন। লুবনা যে বইটি বণিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে গিয়েছিলো তার নাম ‘আর্যভট্টীয়’- গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক বই। ভারতীয় গণিতবিদ আর্যভট্ট নাকি মাত্র ২৩ বছর আগে এটি লিখেছেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো লুবনা।

নিজে সে আন্দালুসিয়ার সবচেয়ে সফলতম নারীর উদাহরণ। তার বয়স ২৭ হতে চললো, অথচ এরকম কোনও কিছু তো এখনো সৃষ্টি করতে পারলো না। ভারতীয় পণ্ডিত আর্যভট্টের এই বইটি যে করেই হোক যেন জোগাড় করা যায়, সে জন্য আরবীয় বণিকদের আগেই বলে রেখেছিলো ফাতিমা।

এক চীনা দার্শনিকের বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে প্রথম আর্যভট্টের নাম জানতে পারে লুবনা আর ফাতিমা।

খলীফা তৃতীয় আব্দুর রাহমানের সহযোগিতায় ইতিমধ্যে গড়ে তোলা আন্দালুসিয়ার লাইব্রেরি ছিলো পৃথিবীশ্রেষ্ঠ। ৫ লাখের উপর বই আছে। পৃথিবীর তাবৎ জ্ঞান-বিজ্ঞান জড়ো করা হয়েছে। লুবনা সেই লাইব্রেরির প্রধান কর্ণধার, ফাতিমা তার সহযোগী।

আজ থেকে ঠিক ১৩ বছর আগে খলীফার চোখে পড়ে ফাতিমা। ফাতিমাকে খলীফার কাছে পেশ করেছিলো হেরেমের প্রধান। লাজুক ফাতিমার সাথে সে রাতে খলীফা কেবলই গল্প করেছিলেন। অদ্ভুত হলেও সত্যি, অন্তর্মুখী ফাতিমা নাকি সারারাত খলিফাকে কবিতার পঙতি শুনিয়েছিলো। যৌনতায় নিজের অপারদর্শীতার কথা খলীফাকে খুলে বলেছিলো। খলীফা আব্দুর রহমানও বিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সারারাত ফাতিমার কাছে জেনানামহলের গল্প আর ফাঁকে ফাঁকে কবিতা শুনেছেন।

তারপর ভোরের দিকে ফাতিমাকে বলেছিলেন- সেদিন রাতের মতো আর কোনও রাত কাটেনি তার। তবে এভাবে তো সব রাত চলবে না। শারীরিক চাহিদা তো রয়েছে।

ফাতিমা হেসে বলেছিলো- আমার ছোটোবেলার সখি লুবনা রয়েছে। সে হতে পারে দাসীর কন্যা, তবে আপনার যোগ্য সহচরী হবে। তবে তাকে আপনার বিয়ে করতে হবে!

খলীফা বলেছিলো- সেটি সম্ভব নয়। কেননা, আমি তো ইতোমধ্যে ইসরামের বিধান অনুযায়ী চার বিয়ে করে ফেলেছি!

ফাতিমা বলেছিলো- আপনি তো বিধান ভঙ্গ করবেন না, দাসীর মেয়ে তো দাসীই; আপনার তার সাথে মিলিত হওয়ার অধিকার ইসলাম দিয়েছে তো!

আব্দুর রহমান অসন্তোষে মাথা নেড়েছিলেন। বলেছিলেন- আমাকে কী তেমন খলীফা মনে হয়? দাসী হলেও আমি তাদেরকে সেভাবে কখনো দেখিনা। আমি তাদেরকে পূর্ণ মানবীয় মর্যাদা দিতে চাই। আমার খিলাফতে এমন হবে না..!

ফাতিমা হেসে বলেছিলো- আপনি তাকে মুতাহ-আল নিকাহ এর মাধ্যমে পেতে পারেন জনাব!

খলিফা রাজি হয়েছিলেন। হয়তো লুবনার প্রশংসা শুনে তার কৌতুহলবশত, কিংবা ফাতিমার সাথে ব্যতিক্রমী সে রাত কাটানোর পর তিনি কিছুটা মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েছিলেন।

ফাতিমার কাছে প্রথম প্রথম খলিফার সাথে মুতাহ-আল নিকাহ এর কথা শুনে লুবনার বিশ্বাস হচ্ছিলো না। তার মা ছিলো একজন দাসী। তার মতো এবং তার চেয়ে হাজার গুণ সুন্দরী এমন কয়েক হাজার মেয়ে আছে হারেমে!

কিন্তু হ্যা তাদের সাথে তার ও ফাতিমার সাথে খলীফার হারেমে থাকা মেয়েদের একটা বিশাল পার্থক্য রয়েছে। আর তা হলো খলীফার হারেমের মেয়েরা- আর সবকিছুতে পারদর্শী হলেও, তারা কেউই পড়াশোনায় আর বিদ্যা অর্জনে তেমন আগ্রহী ছিলো না।

ফাতিমার সাথে লুবনার পরিচয়ও হয়েছিলো হারেমের লাইব্রেরিতে। সেদিন ফাতিমা একটা গণিতের বই পড়ছিলো, হারেমের অন্য মেয়েদের মতো আরব্য রজনীর বই নিয়ে পড়ে ছিলো না। আর এটা দেখেই সে নিজ থেকে এগিয়ে গিয়ে তার সাথে পরিচিত হয়েছিলো।

তবে ফাতিমার সাথে লুবনার পার্থক্য ছিলো দু’তিনটি মৌলিক বিষয়ে। অসম্ভব রূপবতী হওয়া সত্ত্বেও ফাতিমা ছিলো অন্তর্মুখী, আড়ষ্ট। আর লুবনা ছিলো তার ঠিক বিপরীত। এর একটি কারণ হতে পারে ফাতিমা মুসলিম পরিবারেই বেড়ে উঠেছে। তার মা ছিলো হারেমের আরেক সুলতানার দাসী। আর লুবনার পরিবার ছিলো খ্রিস্টান। লুবনার ঠিক মনে নেই, কিন্তু সে শুনেছে তার বাবা খ্রিস্টান ভূস্বামী ছিলেন।

লুবনা যৌনবিদ্যা আর কূটবিদ্যায় সম্ভবত জন্মগতভাবে ফাতিমার থেকে আলাদা ছিলো। সাথে যোগ হয়েছিলো নেতৃত্ব দেওয়ার দারুণ ক্ষমতা।

খলীফার সাথে অতি অনাড়ম্বর এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নিকাহ আল মুতায় আবদ্ধ হওয়ার পর লুবনা আর ফাতিমা মিলে হাত দেয় লাইব্রেরি গড়ে তোলার কাজে। এখন পাঁচশ’রও বেশি মানুষ কাজ করে এ লাইব্রেরিতে। ১০ বছরে লুবনা আর ফাতিমা মিলে আন্দালুসে তৈরি করেছে ১৭০ জন শিক্ষিত নারী। যাদের অনেকেই এখন লাইব্রেরির জন্য বই কপি করছে!

আর ফাতিমা…

ঠিক এসময়েই লুবনার চিন্তায় ছেদ পড়লো। জাহাজের অধিনায়ক আলী আজহার কক্ষের দরজা ধাক্কিয়ে সালাম দিলো। তারপর বললো- আল-আজহারা দেখা যাচ্ছে মুহতারামা। প্রস্তুত হোন।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাঠের বাক্সটার দিকে তাকালো লুবনা। যেখানে রাখা আছে চার অধ্যায়ে রচিত ভূর্জপাতায় লেখা ‘আর্যভট্টীয়’ বইটির পাণ্ডুলিপি। ফাতিমা নিশ্চয়ই এতোদিনে ঠিক করে রেখেছে কে অনুবাদ করবে এ মহান বই।

***

আন্দালুসিয়ার রাজধানী মাদিনাত আল-আজাহারার তীরে জাহাজ ভিড়েছে ঘন্টাখানেক। জাহাজ থেকে নামার পরই মনে করেছিলো ফাতিমা তাকে উষ্ণ আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরবে। কিন্তু লুবনা অবাক হলো। দাঁড়িয়ে আছেন খোদ খলিফা দ্বিতীয় আল হাকাম।

চার বছর আগে খলীফা আবদুর রহমানে মৃত্যুর পর তিনিই আন্দালুসিয়ার খলীফা হয়েছেন। বাবার মতোই জ্ঞান-বিজ্ঞান পিপাসু, উদারমনষ্ক দ্বিতীয় আল হাকাম।

স্পেন ও ইউরোপজুড়ে মুসলিম সভ্যতা ফুলে ফেঁপে উঠছে প্রয়াত খলীফা আবদুর রহমানের আমলেই। মেয়েরা পেয়েছে দারুণ স্বাধীনতা। আল হাকামও সেই পথেই আছেন। কিন্তু এমনটা থাকবে তো! ইতিহাস পড়ে লুবনা বুঝেছে, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চাকারী শাসকদের মানুষ মনে রাখে! তার আর ফাতিমার গড়ে তোলা লাইব্রেরির কারণেই হয়তো দুই খলিফার নাম ইতিহাসে স্মরণ হবে বারেবার!

আন্দালুসিয়ার এ লাইব্রেরির সাথে সাথে লুবনা আর ফাতিমার কথাও কী লোকে মনে রাখবে? ইতিহাসে কি বলা হবে- ফাতিমা কথায় কথায় কোয়ানাহ বা ছোট পদ্য তৈরি করতে পারতো, তারা কী জানবে লুবনা কতো রাত বই পড়ার ইচ্ছা ত্যাগ করে খলীফার সাথে কাটিয়েছে… স্রেফ লাইব্রেরির জন্য আরও কিছু অনুদান পেতে, আরেকটু বড়ো করতে সবকিছু।

ইতিহাসে মেয়েদের কথা কতোটুকু লেখা থাকে?

তীরে নামতেই খলীফা আল হাকাম সহচরদের নিয়ে এগিয়ে এলেন। সালাম দিলেন। খোদ খলীফার এখানে থাকার কথা নয়। কিন্তু তিনি এসেছেন। ঠিক এসময়ে লুবনা আসল ঘটনাটি বুঝতে পারলো। ফাতিমা মারা গেছে; খলীফা আল হাকামের মুখে আড়ষ্ট হাসি, ফাতিমার মৃত্যু সংবাদই লুকানোর চেষ্টা করছে!

খুব অদ্ভুত হলেও সত্যি মুসলমানদের এই সেরা নিদর্শন লুবনা ও ফাতিমার গড়া লাইব্রেরির সমস্ত বই মুসলমান মৌলবাদীরাই পুড়িয়ে দিছিলো। আর তখনই পতন ঘটতে শুরু করে স্পেনে উমাইয়া খেলাফতের…।

***
আমার লেখা ‘মেয়েটি জিহাদে গিয়েছিল’ উপন্যাসে ব্যবহার করা গোটা দশেকের বেশি ইসলামি মিথ এর ফ্যান্টাসি রূপের একটি এটি।

বুদ্ধিজীবী দিবসের প্রাক্কালে আজ মনে হচ্ছে- লাইব্রেরির মানবিক রূপই তো একজন বুদ্ধিজীবী। মুসলিম পরিচয় দানকারী দুর্বৃত্ততাই আরেক মুসলিম দেশের সম্পদ নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করেছিল।

হ্যা বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়েছে। আরো প্রগাঢ় অন্ধকার আসবে হয়তো। ফিরতি পথ তবু ধরতে পারবে বলে আশা রাখি।

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধগল্প -দাম্পত্য – রত্না চক্রবর্তী
পরবর্তী নিবন্ধনাটোরের পৌর মেয়রের পক্ষে শীতার্তদের মাঝে কম্বল বিতরণ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে