‘শশীকণা’ থেকে ‘গৌরীকুঞ্জ’ এবং “জামির করাতির বউ ও বিভূতিভূষণের ‘আহ্বান’ গল্প”-অমিতকুমার বিশ্বাস

0
389
Amit

ll ‘শশীকণা’ থেকে ‘গৌরীকুঞ্জ’ ll

শরতের শেষ দিনগুলিতে ঘাটশিলার ডাহিগড়ায় ছিলাম এবার। কাছেপিঠেই বিভূতিভূষণের ‘গৌরীকুঞ্জ’। আর ‘গৌরীকুঞ্জ’ থেকে দু-তিন মিনিট হাঁটলেই খড়-কাশের ঝোপের আড়ালে সুবর্ণরেখা। সূর্যাস্তের নীচে হেঁটেছিলাম একা এবং কয়েকজন। লালমাটির মালভূমির উপর খড়, হঠাৎ মাঝে ছাত-খোলা গুহাপথ, কিঞ্চিৎ আঁকাবাঁকা, তারই নীচে মৃদু জল, যেন এখানের দাবদাহে তৃষ্ণা মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয় ওইটুকু। আকাশটা ক্রমশ জল-চায়ের মতো, নদীটা ঝোলাগুড়! আর আমরা অশরীরীর মতো, একা এবং কয়েকজন। পেছনে আদিবাসীপাড়া। নদী আর পাড়ার মাঝে শালবন ছিল নাকি একদিন। এখন নেই। আছে খড়ের মাঝে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা শ্মশানের ছাই। নিদৃষ্ট কোথাও নয়, বরং উঁচুনিচু লালমাটির পাথুরে-প্রান্তর, খড়-শন ঝাড়ের ভিতর মৃতেরা পুড়েছে। খাটিয়া পড়ে আছে তার, ভাঙ্গা ঘট পড়ে আছে, মালসাও। বাসী ফুল-পাতার গন্ধ দেদার।

খাদের নীচে নদী, ঝোলাগুড় নিয়ে বুকে সূর্যাস্তের নীচে শুয়ে, পাশে একা এবং কয়েকজন।

এইখানেই বিভূতিভূষণ-নুটুবিহারীর দেহাংশ মিশে আছে কোথাও—– মাটি হয়ে, ধুলো হয়ে, গাছপাতা হয়ে। এখানের নির্জনতা ভাঙছে পেছনের দৈত্যযন্ত্র। এক মহিলা আসছেন এদিকেই। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে বলেন, এখানে বাঁধ হবে।

বাঁধ? নারী ও নদীতে বাঁধ দিয়ে পুরুষ সভ্যতা চেয়েছে এক। ইচ্ছেমতো জল চেয়েছে। পেয়েছে। কিন্তু এদিক পেয়েছে, তো ওদিক শুকিয়েছে আড়ালে! ইচ্ছেয় বাঁধ দিয়ে কবে বাঁধা গেছে তাঁকে? হৃদয়ে?

ডাহিগড়ায় আদিম নির্জনতার শবদেহ নিয়ে বসে আছি, একা এবং কয়েকজন।

১৯৩৪-৩৫ নাগাদ অশোক গুপ্ত ডাহিগড়ায় মাটকোঠাওয়ালা একটা বাড়ি সস্তায় পেয়েও বিকিয়ে দেন বিভূতিভূষণের কাছে, মাত্র ৫০০টাকায়, যদিও বিভূতিভুষণ শ্রীগুপ্তকে টাকাটা ওখানে আশ্রম বানাতে দিয়েছিলেন। ভদ্রলোক বিভূতিকে পুরো বাড়িটা বেঁচে দিয়ে ঋণশোধ করে শিশুদের জন্য আশ্রম-চিন্তা বাদ দিয়েই ‘শশীকণা’ থেকে পালালেন এভাবে। ‘শশীকণা’য় নাকি ভূতপ্রেত থাকে। শ্মশান থেকে উঠে আসে মাঝারাতে। কোনও মানুষজনকে পছন্দ করে না তারা এইবাড়িতে——-স্থানীয় আদিবাসীরা বলল তাঁকে। তাই তো অশোকবাবু প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়েছেন! বিভূতি হো হো হাসলেন। বললেন, ওসব ফোতোদের কথা! এদিকে তিনিও কিন্তু প্রেতচর্চা করেন। প্ল্যানচেটে মৃতদের সঙ্গে কথা বলেন নিয়মিত। প্রেতাত্মার কথায় রোমাঞ্চিত হলেন? জানি না। তবে বাড়িটা ছাড়লেন না তিনি। বরং ‘শশীকণা’-র পরিবর্তে নাম রাখলেন ‘গৌরীকুঞ্জ’।

এই ঘাটশিলাতেই এক সন্ধেরাতে বিভূতির অকাল প্রয়াণ ঘটে। তারিখটা ছিল ১ নভেম্বর ১৯৫০। ঠিক তার সাত দিন পর ঘটে তাঁর ভাইয়ের অপমৃত্যু! এই প্রতিটা মৃত্যুর পরপরই ‘গৌরীকুঞ্জ’-এ পাকুড় থেকে এসে পড়ে জনৈক বৈদ্যনাথ চট্টোপাধ্যায়ের দুটি চিঠি: পালিয়ে যান, নইলে আরও বিপদ!

লোকটাকে কেউ চেনে না। ঘাটশিলা পুলিও তার টিঁকি খুঁজে পায়নি কখন। কে সে?

সেই সন্ধেটা টপকে-টপকে রামকৃষ্ণ মঠের ঘরে এসেই শরীর ভেঙে পড়ল আমার। অশরীরীদের প্রভাব?
#
পরদিন সন্ধে থেকে ধুম জ্বর।
পরদিন ওখানে আবার যাবার কথা ছিল। ঢের কাজ ফেলে এসেছিলাম। হল না যাওয়া আর। ‘গৌরীকুঞ্জ’-এর ভিতর ‘শশীকণা’ জেগে উঠেছিল কি আবার? ওরা কি চায়নি আমি যাই?
জানি না। জানি না কিছুই।
ঘাটশিলা থেকে ফিরলাম এক-গা- ভর্তি-জ্বর নিয়ে।
একা এবং কয়েকজন।

ll জামির করাতির বউ ও বিভূতিভূষণের ‘আহ্বান’ গল্প ll

ll কল্যাণীকে ঘাটশিলায় দেখতে না-গিয়ে গাঁয়ের টানে বিভূতিভূষণ সোজা চলে এলেন শ্রীপল্লি-বারাকপুরে। সূর্যাস্তের নীচে ঘরে ফেরার সময় দাড়িঘাটা ব্রিজ ( দরিয়াঘাট ) পেরোতেই জামির করাতির বউয়ের সঙ্গে আচমকা দেখা।
একেবারে ভিখারিনি-দশা যে তার!
মানুষের দশ দশা—– কখনও হাতি, আর কখনও-বা মশা!
“ছাগল খোঁজাখুঁজি করচো নাকি, ও করাতির বউ?”
জিগালেন—–এক-দুই-তিন…
কত-কত বার…।
করাতি-বউ শুনলই না।
বিভূতির অভিমান হল খুব। গাঁয়ের সবাই বুঝি একে-একে ভুলে যাচ্ছে তাঁকে!
সেই রাতেই অভিমান উগড়ে দিলেন ইন্দু-কে!
“কোন করাতি-বউ? জামির করাতির?”
“হুম!”
“আরে ধুস, সে তো আজ দুপুরেই মারা গেচে। আর তারে ওই বিরিজির পাশেই কবর দিয়া হইচে!”
এসব শুনে বিভূতি ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন না মাটিতে পড়ে যাবেন?

কবরের মাটি তো বিভূতির দেওয়ার কথা ছিল। গ্রামতুতো মা যে।
সেইসব দিনগুলিতে কত গভীর ছিল গ্রামতুতো সম্পর্কগুলো! সই-মা, ধর্ম-মা, খুড়ি-মা। আহা, গ্রামবাংলা ভরা ছিল বুঝি চিরশ্যামল বাংলা মায়ে।

পরদিন সকালেই কবরে মাটি দিতে ছুটলেন বিভূতিভূষণ।
তবে কি করাতি-বউই তাঁকে এখানে নিয়ে এসেছে?
ভাবতে থাকলেন বিভূতিভূষণ।
ভাবতে-ভাবতে লিখে ফেললেন ‘আহ্বান’ গল্পটি ll

ll নীচের ছবিটা গতমাসের। ১৯৯৪ সালে প্রথম এই সেতু উপর প্রথম আসি। সে-পুরোনো সেতু আর নেই এখন। তখন এখানে সূর্যাস্তের পর একটা গা-ছমছমে ভাব নেমে আসত আমাদের নীরব শরীরে ।l

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধ“নারী “- জান্নাত লাবণ্য’র কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধ“দত্তপাড়ার আকাশ ০২”- নাজমুল হাসানের কবিতা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে