শ্রীচৈতন্যদেবের অন্তর্ধান প্রসঙ্গ – রেজাউল করিম খান

0
380
Chaytonno

শ্রীচৈতন্যদেবের অন্তর্ধান প্রসঙ্গ – রেজাউল করিম খান

আমি মাঝে মধ্যে ধর্ম সম্পর্কে দুইচার কথা লিখে ফেলি, অলস মস্তিষ্কের মরিচা ধরা তারে একটুখানি নাড়া দেয়ার উদ্ধেশ্যে। একেবারে ব্যর্থ হইনা। অনেকেই প্রশংসা করেন, পরামর্শ ও উপদেশও দেন। তবে দুইএকজন বিষয়বস্তু না বুঝেই অযথা ফাল পাড়েন। ইসলাম ও হিন্দু উভয় ধর্মের কয়েকটি বিষয়ে লিখেছি। এসবের সমালোচনা হতেই পারে। জবাবও দেয়ার চেষ্টা করি। গতকাল লিখেছিলাম রথযাত্রা সম্পর্কে। সেই লেখার মন্তব্যে Sankar Chakraborty লিখেছেন, “আপনি সদা সর্বদা সচেষ্ট থেকেছেন যাতে হিঁদুরা রেগে না যায়। ভালো কথা। এবার দয়া করে শ্রীচৈতন্যের জগন্নাথ মন্দিরে বিলীন হয়ে যাওয়া সম্পর্কে যদি কিছু বলেন।” -তিনি বিজ্ঞজন।

কিন্তু আমার মনে পড়ছে না, হিঁদুরা যাতে রেগে না যায়, তার জন্য সদা সর্বদা সচেষ্ট থেকেছি। যাই হোক, তিনি জানতে চেয়েছেন, শ্রীচৈতন্যের জগন্নাথ মন্দিরে বিলীন হয়ে যাওয়া সম্পর্কে। আমি যতটুকু পড়েটড়ে বুঝতে পেরেছি, তাই উপস্থাপন করলাম। স্থানাভাবে ঐ স্ট্যাটাসের সাথে না দিয়ে আলাদা করে দিলাম। আশা করি পড়বেন ও মন্তব্য করবেন। কল্পনা করুন, দাঁড়িয়ে আছেন নবদ্বীপের রাস্তায় । ঐ যে দেখা যায় কত মানুষ নগর সংকীর্তনে বেরিয়েছে; আর তাদের সামনে এগিয়ে আসছে এক দীর্ঘদেহী গৌরবর্ণ পুরুষ। তার পেছনে দুহাত তুলে ভাবের ঘোরে কৃষ্ণ নাম নিতে নিতে এগিয়ে আসছে শত সহ¯্র মানুষ ।

সমাজের চোখে তাদের কেউ চন্ডাল , কেউ মুচি আবার কেউ অচ্ছুত বা অস্পৃশ্য ! আজ থেকে কয়েক শতাব্দী পূর্বে চৈতন্য খুব বুদ্ধি করেই কীর্তনকে ব্যবহার করেছিলেন জাতিভেদের বিরুদ্ধে নিম্নবর্ণের মানুষকে একত্রিত করতে। মানুষ ভাবের ঘোরে কৃষ্ণ নামে পাগল হয়ে উঠেছিলেন। চৈতন্যদেব বলতে কি এই ছবিটাই মনে আসে? গায়ে গেরুয়া জড়ানো মুন্ডিত মস্তক এক যুবক দুইহাত তুলে হরির নামগানে নৃত্যরত। কিন্তু তিনি কি আদ্যোপান্তই এই রকম? সাধারণ পোশাকে, সাধারণ মানুষের চেহারায় দিন কাটাননি কখনও? বিয়ে করেননি? এ প্রশ্নটা শুনলে অবশ্য অনেকেই বলে উঠবেন ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তিনি তো বিয়ে করেছিলেন।

স্ত্রীর নাম বিষ্ণুপ্রিয়া।৷ তাঁকেই তো ঘরে রেখে মাঝরাতে গৃহত্যাগ করেন তিনি।’ সঙ্গে সঙ্গেই মনে পড়বে সেই গান, ‘তুমি থাকো ঘুমঘোরে, আমি চলে যাই…’। কিন্তু তারও আগে? চৈতন্যদেবের বিভিন্ন প্রামাণ্য জীবনীগ্রন্থ থেকে জানা যায়, বিষ্ণুপ্রিয়ার আগেও একজনকে বিয়ে করেছিলেন নিমাই, তাঁর নাম লক্ষীপ্রিয়া। শ্রীচৈতন্য ১৫১০ সালে এসেছিলেন পুরীতে। সেই সময় ওড়িশার রাজা ছিলেন প্রতাপরুদ্র। বিজয়নগরের রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের সঙ্গে ছিলেন যুদ্ধে লিপ্ত। কৃষ্ণদেব রায় ১৫০৯ সালে সিংহাসনে বসার সময় থেকেই উভয় রাজ্যের মধ্যে ছোটখাট যুদ্ধ বিগ্রহ চলছিল। এ কারণে ১৫০৯ সাল থেকেই প্রতাপরুদ্র ছিলেন দক্ষিণে। ১৫১০ সালের প্রথমদিকে শ্রীচৈতন্য তীর্থপর্যটনে বেরিয়ে মোটামুটি উপকূল ভাগ ধরে পুরী থেকে কন্যাকুমারী হয়ে পৌঁছেছিলেন দ্বারকায়। সেখান থেকে তিনি নর্মদার তীর বরাবর হয়ে পুরীতে ফিরে আসেন ১৫১২ সালে।

কলিঙ্গযুদ্ধে কৃষ্ণদেব রায় ১৫১৪ সালে দখল করেন উদয়গিরি। ১৫১৫ সালে গুন্তুর জেলার কোন্ডবীডু। এরপর তিনি রাজপুত্র বীরভদ্রকে বন্দি করে এগিয়ে যান সীমহাচলম্ পর্যন্ত। অপমানজনক শর্তে সন্ধি করতে বাধ্য হন প্রতাপরুদ্র। গোদাবরীর দক্ষিণে সমস্ত রাজ্য তাঁর হাতছাড়া হয়ে যায়। এইভাবে ওড়িশার রাজনৈতিক মর্যাদা হ্রাসের পেছনে চৈতন্য বা তাঁর ধর্ম দায়ী বলে অনেকে মনে করেন। ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ওড়িয়া জাতির সামরিক দক্ষতা হ্রাসের জন্য চৈতন্য প্রচারিত ধর্ম ও ঐ ধর্মের প্রতি রাজা প্রতাপরুদ্রের অনুরাগকে দায়ী করেছেন। সাম্প্রতিককালেও বিদ্বৎ সমাজের একাংশ ওড়িশার রাজনৈতিক স্বাধীনতালোপের জন্য দায়ী করেন চৈতন্যকে। এর কিছু পূর্বের ঘটনা শুনুন, জগন্নাথ মন্দিরের নথি ‘মাদলা পাঞ্জী’তে আছে, ১৫০৮-০৯ সালে আরাম্বাগ জেলার মন্দারণশিবির থেকে বেরিয়ে শাহ ইসমাইল গাজী বিদ্যুৎগতিতে যাজপুর-কটকে অভিযান চালিয়ে বহু হিন্দুমন্দির ধ্বংস করে পুরী পর্যন্ত এগিয়ে যান। এই যুদ্ধজয়ের স্মারকমুদ্রায় যাজনগর ওড়িশার উল্লেখ করা হয়। মুসলমান সেনাদলের এই আকস্মিক অভিযানের খবর পেয়ে প্রতাপরুদ্র তাঁর দক্ষিণ অভিযান থেকে ফিরে আসেন এবং মুসলিমবাহিনীর পিছু ধাওয়া করে আরামবাগের নিকট মন্দারণ পর্যন্ত চলে আসেন। ওড়িয়াবাহিনী মন্দারণ দুর্গ অবরোধ করে, কিন্তু উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী জনৈক গোবিন্দ বিদ্যাধরের বিশ্বাসঘাতকতায় শেষ পর্যন্ত দুর্গটি অধিকার করতে ব্যর্থ হয়।

অধ্যাপক প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের লিখেছেন, ‘গোবিন্দ কটক দুর্গের অধ্যক্ষ ছিল। উড়িষ্যার পতনের জন্য যে বিশ্বাসঘাতক গোষ্ঠী আংশিকভাবে দায়ী, তাদের প্রধান ঐ গোবিন্দ।’ এবার আসুন দেখি ‘শ্রীচৈতন্যের অন্তর্ধান রহস্য’ বিষয়ে ইতিহাসবিদ ও সাংবাদিকরা কী লিখেছেন।‘ভারতের সাধক’ তৃতীয় খন্ডে শঙ্করনাথ রায় শ্রীচৈতন্যের লোকান্তর প্রসঙ্গে লিখেছেন, ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে, আষাঢ় মাস। বেলা তখন প্রায় তৃতীয় প্রহর। কী এক দিব্য ভাবাবেশে আবিষ্ট হইয়া প্রভু স্তম্ভের নীচে প্রতিদিন গিয়া দাঁড়ান, যুক্ত করে ভাবতন্ময় অবস্থায় পুরষোত্তম বিগ্রহের চিন্ময় রূপসুধা পান করেন, নয়নজলের ধারায় সারা দেহ ভিজিয়া যায়। কিন্তু আজ কেন তিনি সরাসরি মূল বেদীকোঠায় ঢুকিয়া পড়িলেন? কেন এই অদ্ভুত ব্যতিক্রম? ভক্তগণ সবিস্ময়ে তাঁহার কান্ড লক্ষ্য করিতেছেন। হটাৎ এক সময়ে অন্তগৃহের দ্বার বন্ধ হইয়া গেল। সবাই বাহিরে, ভিতরে রহিলেন শুধু প্রভু আর তাঁহার শ্রীজগন্নাথ। (চলবে)

সহায়ক গ্রন্থ, পত্রিকা, প্রবন্ধ ও খবর: স্থাপত্য Arunava Saniyal, MAY, 19, 2017, Sibsankar Bharati March 1, 2018. Daily Hunt ১, ২০১৮. দীনেশচন্দ্র সেন – ‘চৈতন্য অ্যান্ড হিজ এজ’। ড. নীহার রঞ্জন রায়। ঈশান নাগর। ইন্দ্রনীল শুক্লা। Biswa Bangla Sangbad.

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধঅভিশপ্ত মধ্যবিত্ত -মনিমুল হক
পরবর্তী নিবন্ধনাটোর শহরের চৌধুরীপাড়ায় মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে