শ্রীচৈতন্যদেবের অন্তর্ধান প্রসঙ্গ – রেজাউল করিম খান (২ ও শেষ পর্ব)

0
800
Chaytonno

শ্রীচৈতন্যদেবের অন্তর্ধান প্রসঙ্গ – রেজাউল করিম খান

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর পিতৃদেব জগন্নাথ মিশ্র শ্রীহট্টের ঢাকা দক্ষিণ গ্রাম থেকে আসেন নবদ্বীপে। নবদ্বীপ তখন নব্যন্যায়ের নতুন তীর্থক্ষেত্র। বাসুদেব সার্বভৌম মিথিলার মহাপন্ডিত পক্ষধর মিশ্রের কাছ থেকে নব্যন্যায় শিক্ষা লাভের মাধ্যমে নবদ্বীপে তার চর্চা শুরু করেন। জগন্নাথ মিশ্রের পুত্র নিমাইও মহাপন্ডিত হলেন, তবে ব্যাকরণে। ব্যাকরণ মূলত যুক্তিনিষ্ঠ, খানিকটা বিজ্ঞান অনুসারী। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের জীবনের প্রতিটি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে এক অভিজ্ঞ বৈয়াকরণিকের ছাপ সুস্পষ্ট। গয়াতে বিষ্ণুপাদপদ্ম দর্শনের পরে নিমাই পন্ডিতের মনের আমূল পরিবর্তন হয়। মহাপন্ডিত, সাহসী, তার্কিক, গৃহস্থ একজন সম্পন্ন মানুষ সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর ব্রত গ্রহণ করেন। সেই সময় সমাজকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজন ছিল ত্যাগী সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের।

এবিষয়ে পরবর্তী জীবনে ছোটো হরিদাসের প্রতি গৌরাঙ্গের কঠোরতা লক্ষণীয়। ছোটো হরিদাস ভিক্ষা করতে গিয়ে গৃহস্থ মহিলার সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলেছিলেন মাত্র, ভালো চাল ভিক্ষা নিয়েছিলেন। মহাপ্রভু তাকে ভর্ৎসনা করেন। হরিদাস মনঃকষ্টে আত্মহত্যা করেন। মহাপ্রভু তাঁর শেষদর্শনও করেন নি। বড় হরিদাস অর্থাৎ যবন হরিদাস প্রসঙ্গে পরে আসছি। তো এমন এক সুশৃঙ্খল সন্ন্যাসী বাহিনী সমাজ আর রাষ্ট্র রক্ষা করবে-এমনই স্বপ্ন। নিজের জীবনেও তিনি মা শচীকে দুপুরের খাবার দেওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন, কিন্তু স্ত্রী বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে সন্ন্যাস আশ্রমে কখনো দেখা করেন নি। এই রেজিমেন্টালাইজেশন (সৈন্যদল সংক্রান্ত) বঙ্গদেশে তারই আবিষ্কার। দ্বিতীয় আবিষ্কার নগর সংকীর্তন আর হরিনাম প্রচারযজ্ঞ। ঐসময় ওাড়িশায় রাজায় রাজায় যুদ্ধের কথা পূর্বেই বলেছি। প্রশ্ন হচ্ছে, শ্রীচৈতন্যদেব কি রাজদন্ড হাতে নিতে চেয়েছিলেন?

এমনটি কি হতে পারে যে, নাটমন্দিরের অভ্যন্তরে মহাপ্রভুর মৃত্যু হয়েছিল আর তাঁর দেহ দেখতে পেয়েছিল রাজা প্রতাপরুদ্রর শক্তিশালী কোনও প্রতিপক্ষ, যে বা যারা সিংহাসন দখল করার ইচ্ছাপোষণ করত প্রতাপরুদ্রকে সরিয়ে, রাজনৈতিক ক্ষমতালাভের জন্য খুনও করতে পারত। এমনকি রাজার শত্রু পক্ষের সঙ্গে হাত মেলাতে ইতস্তত করত না? এরকম ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের পক্ষে যুদ্ধে পরাজয় এবং জাতির সামরিক মর্যাদাহানির জন্য রাজা প্রতাপরুদ্রের বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলা অথবা সমস্ত কিছুর জন্য রাজা ও শ্রীচৈতন্যকে দায়ী করা কি সেকালে সত্যিই অসম্ভব ছিল? শ্রীচৈতন্যের কয়েকশো বছর আগে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের প্রবক্তা শ্রীরামানুজ বৈষ্ণবধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে এসেছিলেন পুরীতে। তাঁকেও যে বিষম পরিণতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাঁর প্রমাণ আছে ‘প্রপন্নামৃত’ সংস্কৃত গ্রন্থে। এতে বলা হয়েছে, ‘শ্রীজগন্নাথদেব শ্রীরামানুজস্বামীকে এক রাত্রে পুরুষোত্তম থেকে কর্মতীর্থে টেনে ফেলে দিয়েছিলেন’। এই কিংবদন্তীর তাৎপর্য সম্ভবত এই যে, জগন্নাথক্ষেত্রে রামানুজ ধর্ম প্রচার করতে এলে তাঁর সঙ্গে বিরোধ বেধেছিল জগন্নাথসেবকদের সঙ্গে। ‘টেনে ফেলে দেওয়া’ কথাটির মধ্যে সেই বিরোধ ও বর্জনের ইঙ্গিত সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ওড়িশাবাসিদের উপর রামানুজের তুলনায় চৈতন্যের প্রভাব ছিল নিঃসন্দেহে অনেক বেশি। জনগণের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার কথা মনে রেখে তাই ষড়যন্ত্রকারীদের অনেক চিন্তা-ভাবনা ও মাথা খাটিয়ে কাজ করতে হয়েছে গোপনে। আষাঢ় মাসের শুক্লা সপ্তমী তিথি অন্তর্ধানের সময় হলে বুঝতে হবে, রথযাত্রা উৎসবে যখন দেশের মানুষ অত্যন্ত ব্যস্ত তখন তাদের সেই ব্যস্ততারই সুযোগ নিতে চেয়েছে ষড়যন্ত্রকারীরা। তৎকালীন সাহিত্য, সমাজ ও রাজনীনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বলা যায়, তা আদৌ অসম্ভব ছিল না।

জয়ানন্দ চৈতন্যের দেহাবসানের একটি বিবরণ দিয়ে শ্রীকৃঞ্চের মৃত্যুর সঙ্গে শ্রীচৈতন্যের মৃত্যুর তুলনা করেছেন। শ্রীকৃষ্ণের বাঁ পায়ে জরাব্যাধের শরাঘাত এবং চৈতন্যের বাঁ পায়ে ইটের আঘাত, এতে কৃষ্ণ-চৈতন্য সমীরণের তত্ত্বটিকেই বড় করে তুলে ধরা হয়েছে। লোচনদাস বলেছেন, চৈতন্য নিজ-জনদের বাইরে রেখে মন্দিরে প্রবেশ করা মাত্র দরজা বন্ধ হয়ে যায়। ঈশান নাগর তাঁর ‘অদ্বৈত প্রকাশ’ গ্রন্থে লিখেছেন,
‘প্রবেশ মাত্রেতে দ্বার স্বয়ং রুদ্ধ হৈল।
ভক্তগণ মনে বহু আশঙ্কা জন্মিল।।’
ভক্তদের কাছ থেকে তাকে এইভাবে কি বিচ্ছিন্ন করে নেওয়া হয়েছিল? এরপর মন্দিরের ভেতর থেকে একজন ‘পড়িছা’ বা পুরোহিত ঘোষণা করল জগন্নাথঅঙ্গে চৈতন্য বিলীন হয়ে গেছেন। তখন ভক্তবৃন্দ, রাজগুরু কাশী মিশ্র এবং অন্যান্য অনেকে বিলাপ করতে লাগলেন। রাজা স্বয়ং এ সংবাদ শুনে মূর্ছিত হয়ে পড়লেন, কিন্তু চৈতন্যের পার্থিবদেহ সম্পর্কে কেউ অনুসন্ধান করলেন না। জগন্নাথঅঙ্গে বিলীন হওয়ার সংবাদটি ছড়িয়ে দেওয়ার পিছনে কূটকৌশলী কোনও চক্রের চতুর পরিকল্পনার অস্তিত্ব কি অসম্ভব? জগন্নাথের ‘সচল বিগ্রহ’কে জগন্নাথ আত্মসাৎ করেছেন, সচল বিগ্রহবাদী ভক্তরা একথা অস্বীকার করতে পারবেন না এবং জগন্নাথঅঙ্গে বিলীন হওয়ার পর মায়া শরীরের খোঁজখবর করা নিতান্ত অশাস্ত্রীয় ও অধার্মিক ব্যাপার হবে, সম্ভবত এই ছিল চতুর চক্রের চিন্তাধারা।

শ্রী চৈতন্যদেব কি সত্যিই পুরীর সমুদ্রে অথবা জগন্নাথের দারু অঙ্গেই লীন হয়ে গিয়েছিলেন? নাকি তিনি খুন হয়েছিলেন? দৈনিক হান্ট পত্রিকা লিখছে, ২০০০ সালে পুরীর বিখ্যাত শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের সংস্কারের সময় হঠাৎই গর্ভগৃহ থেকে উদ্ধার হয় একটি আস্ত নরকঙ্কাল! যার দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ছয় ফুট দুই ইঞ্চির কাছাকাছি। গর্ভগৃহে কঙ্কাল! চারিদিকে হৈ-চৈ পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু কার দেহাস্থি এটি? মাসাধিককাল ধরে চলে প্রবল বিতর্ক। পরীক্ষা করে জানা যায় মৃত ব্যক্তি ছিলেন অত্যন্ত দীর্ঘাঙ্গী এবং যার মৃত্যু হয়েছিল প্রায় পাঁচশো বছর পূর্বে। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বিচার করে বেশিরভাগ অস্থি বিশেষজ্ঞ, অধ্যাপক, সাংবাদিক তখন এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হলেন যে, কঙ্কালটি এই বাংলার ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব, স্বয়ং শ্রীচৈতন্য দেবের! একই সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা শ্রীচৈতন্যের সমুদ্রে লীন হবার তত্ত¡টি খারিজ হয়ে যায়। পাশাপাশি পুরীর মন্দিরে তাঁকে হত্যা করবার বিষয়টি আবারও জনসমক্ষে প্রতিষ্ঠিত হয়। জগন্নাথ মন্দিরের মধ্যে শ্রীচৈতন্যকে ‘গুমখুন’ করা হয়েছিল, এই অভিমত সর্বপ্রথম প্রচার করেন, ঐতিহাসিক ড. নীহাররঞ্জন রায়। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ৫ আগস্ট তারিখে পুরীর আনন্দময়ী আশ্রমের ড. জয়দেব মুখোপাধ্যায়কে লেখা একটি চিঠিতে ড. রায় লেখেন, ‘মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবকে গুমখুন করা হয়েছিল পুরীতেই এবং চৈতন্যদেবের দেহের কোনও অবশেষের চিহ্নও রাখা হয় নি কোথাও। আর তা হয় নি বলেই তিনটি কিংবদন্তী প্রচারের প্রয়োজন হয়েছিল। ওই গুমখুনের সমস্ত ব্যাপারটাই একটা বহুদিনের চিন্তিত, জনসমর্থিত চক্রান্তের ফল। কে বা কারা ওই চক্রান্ত করেছিলেন, সে সম্পর্কে আমার একটা অনুমান আছে, কিন্তু তা বলতে পারব না।’ (চলবে)

শ্রীচৈতন্যের অন্তর্ধান প্রসঙ্গে-৩

দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর ‘চৈতন্য অ্যান্ড হিজ এজ’ গ্রন্থে লিখেছেন, “শ্রীচৈতন্য বিকেল ৪টার সময় মন্দিরের মধ্যে দেহত্যাগ করেন, ওই দিন রাত ১১টা পর্যন্ত মন্দিরের দরজা খোলেনি। এই সময়টা লেগেছিল তাঁর দেহ (মন্দিরের মধ্যে) পুঁতে ফেলে মন্দিরের মেঝে আবার আগের মত করতে। রাত ১১টায় দরজা খুলে বলা হয়, শ্রীজগন্নাথের দেহে চৈতন্য লীন হয়ে গেছে।” শুধু ড. রায় বা ড. সেনই না, খগেন্দ্রনাথ মিত্র, গিরিজাশঙ্কর রায়চৌধুরি, ড. অমূল্যচন্দ্র সেন, মালী বুড়ো, ড. জয়দেব মুখোপাধ্যায়, ঔপন্যাসিক সমরেশ বসু-এঁদের সবার ধারণা, চৈতন্যদেবকে গুমখুন করা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, চৈতন্যদেবের মৃত্যুরহস্য উদঘাটন করতে গেলে আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে খুনের হুমকি দেওয়া হয়েছিল। খগেন্দ্রনাথ মিত্র ও ড. দীনেশ সেন নিন্দিত হয়েছিলেন। ড. অমূল্য সেনের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়েছিল। তবুও শত বিপদ ও মৃত্যুভয়ের মাঝেও ওঁরা চৈতন্যের মৃত্যুর ঘটনাটিকে ‘হোমিসাইড’ বলেছিলেন। ড. দীনেশচন্দ্র সেনের ধারণা ছিল, জগন্নাথ মন্দিরের পান্ডারা চৈতন্যকে পিটিয়ে মেরেছে। কিন্তু কেন? কী এমন মৃত্যুদন্ডযোগ্য অপরাধ তিনি করেছিলেন?

সাড়ে চারশো বছর পরে সেই রহস্যই ভেদ করতে গিয়েছিলেন “কঁহা গেলে তোমা পাই” নামক চৈতন্য অনুসন্ধানী গ্রন্থের লেখক জয়দেব মুখোপাধ্যায়। ১৯৯৫ সালের ১৭ এপ্রিল তিনি অস্বাভাবিকভাবে মারা যান। পুলিশের তদন্তে বলা হয়েছে, জয়দেব মুখোপাধ্যায়কেও খুন করা হয়েছে। একটি পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় ‘চৈতন্য খুনের কিনারা করতে গিয়ে খুন’ শীর্ষক বিশেষ নিবন্ধ লিখেছিলেন অরূপ বসু। লেখক প্রশ্ন তোলেন, জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের অস্বাভাবিক মৃত্যু কেন আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হলো?
‘কঁহা গেলে তোমা পাই’ গ্রন্থটির প্রথম খন্ড বের হলেও দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশের আগেই মারা যান জয়দেববাবু। যদিও দ্বিতীয় খন্ডের রসদ জোগাড় হয়ে গিয়েছিল তাঁর। এমতাকস্থায় তিনি কি আত্মহত্যা করতে পারেন?

চৈতন্য মহাপ্রভু যখন প্রবল হরিনাম আন্দোলন শুরু করেন, তখন কিছু গোঁড়া ব্রাহ্মণ ধর্ম ভয়ে ভীত হয়ে নবদ্বীপের শাসক চাঁদ কাজীর কাছে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। কাজী নাম-সংকীর্তনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। শ্রীচৈতন্য সেই নির্দেশ অমান্য করে সংকীর্তন চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প ব্যক্ত করেন এবং কাজীবাড়ি ঘেরাওয়ের কর্মসূচি দেন। ভারতে সম্ভবত এটিই প্রথম আইন অমান্য আন্দোলন। কাজীর আইন অমান্য করে লক্ষ ভক্ত সহযোগে বিশাল শোভাযাত্রা শ্রীচৈতন্যের নেতৃত্বে নবদ্বীপের রাজপথে হরিনাম সংকীর্তন করতে করতে কাজীর বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। নবদ্বীপের মুসলিম কাজীর হুকুমে যখন কীর্তন গান নিষিদ্ধ হল ও বৈষ্ণবদের ওপর বিষম অত্যাচার আরম্ভ হল তখন অনেক বৈষ্ণব ভয় পেয়ে অন্যত্র যাওয়ার প্রস্তাব করলেন। কিন্তু চৈতন্য বললেন:
“ভাঙ্গিব কাজীর ঘর কাজীর দুয়ারে।
কীর্তন করিব দেখি কোন কর্ম করে।।
তিলার্ধেকও ভয় কেহ না করিও মনে।”
চৈতন্যের আদেশে তার অনুচরেরা যে কাজীর ঘর ও ফুলের বাগান ধ্বংস করেছিল বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত গ্রন্থে তার বিস্তৃত বিবরণ আছে। বৈষ্ণবদের প্রেমসুলভ মনোভাবের সাথে চৈতন্যের এই উদ্ধত ও হিংসাত্মক আচরণ সুসঙ্গত হয় না, সম্ভবত এই কারণে এবং কিছুটা মুসলিম রাজা ও রাজকর্মচারীর ভয়ে তারা এই ঐতিহাসিক ঘটনাটিকে স্বীকৃতি দেন নি এবং বিকৃত করেছেন। বৃন্দাবন দাস ছিলেন গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী, কাউকে ভয় পেতেন না। কিন্তু আরেক চৈতন্য চরিতকার মুরারি গুপ্ত ছিলেন গৃহী।

তিনি সুলতান হোসেন শাহের ছেলে নসরত শাহের আমলে চৈতন্যের জীবনী লেখেন। কাজীর ব্যাপার ঘটেছিল তার বাবার আমলে। সুতরাং যদিও বৃন্দাবন দাস লিখেছেন যে কাজীর ঘর ভাঙ্গার ব্যাপারে মুরারি গুপ্ত সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেছিলেন কিন্তু মুরারি গুপ্ত এই ঘটনার বিন্দুমাত্র উল্লেখ করেন নি। সমসাময়িক অন্যান্য চৈতন্য জীবনিকারেরাও এই ঘটনা হয় এড়িয়ে গেছেন, নয়ত কোনমতে দায়সারাভাবে উল্লেখ করেছেন। ঘটনার প্রায় একশ বছর পরে বৃদ্ধ কৃষ্ণদাস কবিরাজ তার বিখ্যাত গ্রন্থ “চৈতন্যচরিতামৃত” রচনা করেন। তখন আকবরের রাজ্য কেবল শেষ হয়েছে। সুতরাং মুসলিম সরকারের ভয় কম। এই কারণে তিনি কাজীর ঘটনা, তার ঘর, বাগান ধ্বংসের ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তিনি লিখেছেন এই হিংসাত্মক ব্যাপারে চৈতন্যের কোন হাত ছিল না বরং এটা কয়েকজন উদ্ধতপ্রকৃতি লোকের কাজ। তার মতে চৈতন্য নাকি খুব ভদ্রভাবে কাজীকে অনুরোধ করেছিলেন যাতে কীর্তন বন্ধ না করা হয়। কিন্তু বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবতে স্পষ্ট আছে:
“ক্রোধে বলে প্রভু আরে কাজী বেটা কোথা।
ঝাঁট আন ধরিয়া কাটিয়া ফেলো মাথা।।
প্রাণ লয়া কোথা কাজী গেল দিয়া দ্বার।
ঘর ভাঙ্গ ভাঙ্গ প্রভু বলে বার বার।।”
ভাঙ্গিলেক যত সব বাহিরের ঘর।
প্রভু বলে অগ্নি দেহ বাড়ির ভিতর।
পুড়িয়া মরুক সব গণের সহিতে।
সর্ব বাড়ি বেড়ি অগ্নি দেহ চারি ভিতে।।”
শ্রীচৈতন্য আরও বলেছিলেন,“নির্যবন করো আজি সকল ভুবন।”-বাংলা দেশের ইতিহাস(মধ্য যুগ),পঞ্চম সংস্করণ, পৃষ্ঠা ২৬২।
প্রেমধর্মের প্রচারক শ্রীচৈতন্য চেয়েছিলেন পৃথিবীকে মুসলমানশূন্য করতে! কৃষ্ণদাসের চৈতন্যচরিতামৃতে কাজীর সম্পর্কে নানা অলৌকিক ও আজগুবি কাহিনী আছে যেমন চৈতন্যের কাজীর সাথে দেখা করা, তার কাছে কীর্তন করার অনুমতি চাওয়া, কাজীর অদ্ভুত স্বপ্ন দেখা ও সে কারণে কীর্তনের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা, কাজীর বৈষ্ণবধর্মে ভক্তি ইত্যাদি। কিন্তু সমসাময়িক বৃন্দাবনদাসের গ্রন্থে এসব অস্বাভাবিক ও অসঙ্গতিপূর্ণ কাহিনীর কিছুই নেই। শ্রীচৈতন্য যা করেছেন তা মূলত সমাজসংস্কার ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম। জাতিভেদের কড়াকড়ি ও জাতি নষ্টের কারণে বহু হিন্দু ধর্মান্তরিত হচ্ছিল। এতে হিন্দু সমাজ আস্তে আস্তে সংখ্যালঘু হয়ে পড়ছিল। এটা ঠেকানোর জন্যই চৈতন্যের বৈষ্ণব আন্দোলন হাজির হয়েছিলো। এর মধ্যে কোন উদার, বৈশ্বিক মানবতাবাদ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

ভক্তরা তাদের গুরুকে দেখতে চান শুধুই ভাল গুণের সমাহার হিসেবে। তাই তাদের প্রচারণায় ধর্মগুরুদের অন্ধকার দিকগুলি প্রায়ই ঢাকা পড়ে যায়। কিন্তু প্রগতির অন্যতম শর্ত হল সবকিছুর নির্মোহ বিশ্লেষণ ও সত্যানুসন্ধান। ভাল মন্দকে পাশাপাশি দেখলেই তো বোঝা যাবে কোনটা কতটুকু গ্রহণযোগ্য আর কোনটা বর্জনযোগ্য। ভাল দিকগুলি দেখে আমরা শিখবো ও উৎসাহ পাবো আর খারাপ দিকগুলিকে এড়িয়ে চলবো। এটাই সভ্যতার বিকাশের পথ। শেষ করছি হুমায়ুন আজাদের একটি উক্তি দিয়ে-“অনুরাগী আমি অনেকেরই তবে ভক্ত কারো হতে পারিনি।” (শেষ)

সহায়ক গ্রন্থ, পত্রিকা, প্রবন্ধ ও খবর: দীনেশচন্দ্র সেন-‘চৈতন্য এন্ড হিজ এজ’, ড. নীহার রঞ্জন রায়, ঈশান নাগর- ‘অদ্বৈত প্রকাশ’, ইন্দ্রনীল শুক্লা, আনন্দবাজার পত্রিকা, অভিজিৎ রায়, স্থাপত্য- Arunava Saniyal, MAY, 19, 2017, Sibsankar Bharati March 1, 2018. Daily Hunt. Biswa Bangla Sangbad. BAARTA TODAY NEWS AND VIEWS : BENGALI OR BANGLA.সহায়ক গ্রন্থ, পত্রিকা, প্রবন্ধ ও খবর: দীনেশচন্দ্র সেন-‘চৈতন্য এন্ড হিজ এজ’, ড. নীহার রঞ্জন রায়, ঈশান নাগর- ‘অদ্বৈত প্রকাশ’, ইন্দ্রনীল শুক্লা, আনন্দবাজার পত্রিকা, অভিজিৎ রায়, স্থাপত্য- ¨- Arunava Saniyal, MAY, 19, 2017, Sibsankar Bharati March 1, 2018. Daily Hunt. Biswa Bangla Sangbad. BAARTA TODAY
NEWS AND VIEWS : BENGALI OR BANGLA.

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধনাটোরে অপহরনের ৪ মাসেও স্বপ্নার খোঁজ মিলাতে পারেনি পুলিশ ॥ অন্তরালে কি ?
পরবর্তী নিবন্ধনাটোরে করোনা প্রতিরোধ পক্ষের বিশেষ ভ্রাম্যমান আদালত, ১৩ জনের জরিমনা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে