সাংবাদিক কি সবার প্রতিপক্ষ? – আমীন আল রশীদ

0
244
amin

সাংবাদিক কি সবার প্রতিপক্ষ? – আমীন আল রশীদ

সম্ভবত ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছেন দেশের সাংবাদিকরা, তথা পুরো গণমাধ্যম। সমালোচনার তীর বিদ্ধ করছে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে পরিচিত এই খাতকে। যে সাংবাদিকদের বলা হয় জাতির বিবেক, তাদের বিবেক নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। যে গণমাধ্যমকর্মীরা রাষ্ট্রের নানা শ্রেণিপেশার মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের অন্যায় ও অনিয়ম অনুসন্ধান করে বের করে আনেন, তাদের কর্মকাণ্ডই এখন প্রশ্নের মুখে। সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখলে মনে হবে, রাষ্ট্রের সব অংশের মানুষই বুঝি এখন সাংবাদিকদের প্রতিপক্ষ। আসলে কি তাই? সাংবাদিকরা কি সবার প্রতিপক্ষ?
নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও গণমাধ্যম সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদটিই পরিবেশন করবে, মানুষের এটিই প্রত্যাশা। কিন্তু গণমাধ্যম সব সময়ে সেটি পারে না। আবার সব সংবাদেরই যেহেতু পক্ষ-বিপক্ষ আছে, ফলে একটি খবর যখন কারো পক্ষে যায়, সেটি কারো বিপক্ষেও যেতে পারে। যখনই কারো বিপক্ষে যায়, তখনই তিনি গণমাধ্যমকে শত্রু বিবেচনা করেন। সাংবাদিকদের সাথে খুব ঘনিষ্ঠ কোনো ব্যক্তিও মুহূর্তেই গণমাধ্যমকে শত্রু ভাবা শুরু করতে পারেন, যদি তার স্বার্থের বিরুদ্ধে কোনো সংবাদ পরিবেশিত হয়।
যে সাংবাদিকরা সব অন্যায়ের বিচারের কথা লেখেন, সেই সাংবাদিকদের নিহত হওয়া বা তাদের অধিকার ক্ষুণ্ন হলেও তাদের পাশে কেউ থাকে না। বরং সুযোগ পেলেই গালাগালি আর বিষোদ্গারের ডালি খুলে বসে। যে সাংবাদিকরা পোশাক ও পরিবহন শ্রমিকসহ নানা পেশার মানুষের বেতন বৈষম্য ও মানবাধিকারের কথা লেখেন, প্রচার করেন, সেই সাংবাদিকদের নিজেদের বেতনের দাবিতেই রাজপথে দাঁড়াতে হয়। তাদের পাশে অন্য পেশার মানুষ এসে দাঁড়ায় না। যার সবশেষ উদাহরণ দৈনিক জনকণ্ঠ। নিয়মিত বিরতিতে বড় বড় প্রতিষ্ঠান থেকেও সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুত করা হয়। সবশেষ মাসের বেতনও অনেকে পান না। কিন্তু এইসব বঞ্চনার গল্পগুলো আড়ালেই থেকে যায়।
কারা সাংবাদিকদের প্রতিপক্ষ বা শত্রু ভাবে? উত্তর সহজ, যারা নিজেদের অন্যায় আড়াল করতে চায়, যারা অপরাধী- তারাই সাংবাদিককে ভয় পায় বা প্রতিপক্ষ ভাবে। কারণ একজন সরকারি কর্মকর্তা, একজন পুলিশ, একজন ঠিকাদার, একজন অন্য যেকোনো পেশার মানুষ যখন অন্যায় করেন, সেই অন্যায়টি একজন অন্য পেশার মানুষ দেখে ফেললে বা জেনে গেলে সেটি যত না ঝুঁকি তৈরি করে, একজন সৎ সাংবাদিক জেনে গেলে সেই ঝুঁকির মাত্রা বেড়ে যায়। কারণ একজন সৎ সাংবাদিককে টাকা দিয়ে কেনা যায় না। ফলে তিনি অন্যায়টি প্রকাশ ও প্রচার করবেন। অপরাধীদের ভয় এখানেই।
তবে মুদ্রার অন্যপিঠও আছে। সাংবাদিকতার নামে ব্ল্যাকমেইলিং, চাঁদাবাজি, চাঁদাবাজি করতে গিয়ে গণধোলাইয়ের শিকার হওয়া, করপোরেট স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, ভুইফোঁড় অনলাইন নিউজ পোর্টাল, আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা, কথিত অনলিইন টিভি ইত্যাদি প্লাটফর্ম ব্যবহার করে সাংবাদিকতার নামে নানারকম ধান্দাবাজির কারণে পুরো গণমাধ্যমই এখন প্রশ্নের মুখে। যে কারণে যখনই গণমাধ্যমের নেতিবাচক কোনো খবর গণমাধ্যমে আসে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে যায়, মানুষের রাগ ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়। যে গণমাধ্যম তাদের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ, তাদের বিষোদ্গার শুরু হয়। অনেকে সাংবাদিকদের প্রতি অতীতের কোনো ঘটনায় ক্ষুব্ধ বা ঈর্ষান্বিত থাকলে তিনিও সেই বিষোদ্গার ও গালাগালির মিছিলে শামিল হন।
বাংলাদেশের গণমাধ্যম কতটুকু স্বাধীন ও নিরপেক্ষ, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এ কথা বোধ হয় কেউই অস্বীকার করবেন না যে, এই সীমিত স্বাধীনতা ও নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও গণমাধ্যমই দেশকে টিকিয়ে রেখেছে। কারণ চারপাশে এত বেশি খারাপ লোকের আধিপত্য যে, তারা কেবল ক্যামেরাগুলোকেই ভয় পায়। না হলে বহু আগেই সবকিছু পেটের ভেতরে নিয়ে যেতো। যেহেতু সবকিছু পেটের ভেতরে নিয়ে হজম করার পথে প্রধান অন্তরায় গণমাধ্যম, অতএব তারাই শত্রু, তারাই প্রতিপক্ষ।
রাষ্ট্রও জানে তার সব কার্যক্রমে নজর রাখে গণমাধ্যম। ফলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের মতো গণমাধ্যমকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে পিটিয়ে বা মামলা দিয়ে শায়েস্তা করা না গেলেও রাষ্ট্র এমন পরিস্থিতি তৈরি করে রাখতে চায়, যাতে গণমাধ্যম নিজেই নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সংকটে পড়ে এবং সেই অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই করতে গিয়ে অন্য দিকে নজর দেয়ার সুযোগ না পায়।
Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধনলডাঙ্গায় পানিতে ডুবে দেড় বছরের শিশুর মৃত্যু
পরবর্তী নিবন্ধনলডাঙ্গার ব্রক্ষপুরে প্রধানমন্ত্রীর মানবিক সহায়তা ৫০০ জনের মাঝে বিতরণ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে