নাটোরের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন আর নেই

0
332
বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন

নাটোর কন্ঠ : আজ ২৫শে জুলাই সোমবার বিকেল আনুমানিক ৫ ঘটিকার সময় বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন নাটোর পৌরসভার ২ নং ওয়ার্ডের উলুপুর গ্রামের তার নিজ বাসভবনে, বার্ধক্য জনিত কারণে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।(ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭২ বছর। মরহুমের জানাজার নামাজ আগামীকাল সকাল ৯ টায় ফুলবাগান হেলিপ্যাড মাঠে অনুষ্ঠিত হবে। যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ মো. আবুল হোসেন। নাটোর সদর সাবেক উপজেলা কমান্ডার ছিলেন।

১৯৫০ সালে কৃষক পরিবারে তাঁর জন্ম। ১৯৬৯ সালে আনছার বাহিনীতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। মাতৃভুমি রক্ষায় একজন সাহসী সৈনিক। তার মৃত্যুতে নাটোর জেলার সুশীল সমাজের নাগরিক, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড, জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড, উপজেলা প্রশাসন ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শোকবার্তা জানানো হয়।

দেশের এই বীর কৃতি সন্তানের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে নাটোরকণ্ঠ পরিবারের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে, ২০১২ সালে প্রকাশিত তাঁর জীবনের উপর লেখা একটি প্রতিবেদন হুবহু তুলে ধরা হলো। বাংলাদেশের বিজয়ের দিনে তিনি জানিয়েছিলেন তাঁর মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা।

‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে ৭মার্চের ভাষনের প্রেক্ষিতে অনুপ্রাণিত হয়ে ঘোড়াগাছা গ্রামে, মহল্লা সংগ্রাম কমিটির সভাপতির দায়িত্বভার গ্রহন করি। ধীরেধীরে আন্দোলনের সাথে একাত্ম হয়ে পড়ি। শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ।

এক পর্যায়ে ওয়ালিয়া ইউনিয়নের ময়না গ্রামে যুদ্ধ শেষে লেঙ্গুড়িয়ার নজির প্রামানিকের ছেলে সাধন প্রাং শহীদ হন। ভিতর ভাগ যুদ্ধে শহীদ হন বালিয়া ডাঙ্গার গ্রামের হাজী ওমর আলী। ১২ই এপ্রিল মহকুমা প্রশাসকের কন্ট্রোলরুম থেকে পাক বাহিনী নগরবাড়ী হতে রওনা দেওয়ার খবর পাওয়ায়।

তৎকালীন আওয়ামীলীগের সভাপতি বাবু শংকর গোবিন্দ চৌধুরী নির্দেশে আমরা নগরবাড়ী ঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা দিই। পাক বাহিনীর ভারি ভারি অস্ত্রের মুখে টিকতে না পেরে আমরা আহমদপুর ব্রিজ ভাঙ্গার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। চতুর্দিক থেকে তাক করে থাকি। পাক বাহিনীর গাড়ি যেতে থাকলে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু গোলাগুলি চলে।

ঘটনাস্থলে শহীদ হন মেকু সরদার। তাদের কামান গোলার মুখে টিকতে না পেরে ব্যাপকভাবে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য ক্রোলিং অবস্থায় ফিরে আসি। হানাদার পাক বাহিনীর সদস্যরা নাটোর শহরে ঢুকে পড়ে অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, লুটতরাজ শুরু করে মুহুর্তের মধ্যে গোটা নাটোর তাদের দখলে চলে যায়।

রাজাকার, আল-সামস ও আলবদর তৈরি হতে লাগল। রথবাড়ি রাজাপুরের সিদ্দিক খাঁ রাজাকারের নেতৃত্ব পেল। সারা জেলায় দায়িত্বগ্রহন করল কসাই অবাঙালি হাফেজ মো. আ. রহমান। তারা মুক্তিবাহিনী ও আওয়ামীলীগের লোকদের খোঁজাখুঁজি শুরু করল। তারা আমার বাড়িতে আমার খোঁজ নিতে শুরু করে।

এই খবর পাওয়ার পর কয়েকজন আনসারের সাথে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আমার সঙ্গী ছিলেন মসলেম উদ্দিন ইপিআর, মহসিন আনছার। আমরা ছদ্মবেশে ভারতের মুর্শিদাবাদে জলঙ্গী ক্যাম্পে উপস্থিত হই।

সেখানে যাদের সাথে দেখা হয় তারা হলো সিংড়ার আশরাফ, গুরুদাসপুরের সালাম ভাই, নাটোরের এম.পি. সাইফুল ভাই, সৈয়দ মোতাহার হোসেন, আনিছুর রহমানসহ আরও অনেকে। জলঙ্গী ক্যাম্পে লাঠি ট্রেনিং দেওয়া হয়। তারা বলেন তোমরা সবাই আনছার, তোমাদের প্রশিক্ষনের দরকার নেই।

তোমরা এখান থেকে শেখ পাড়া (ভারত) অপারেশন ক্যাম্পে যাও। গুরুদাসপুরের ক্যাম্প ইনচার্জ সালাম সাহেব পত্র লিখে দেন। সে পত্র নিয়ে আমরা অপারেশন ক্যাম্পে যোগদান করি। ছোট ছোট যুদ্ধে অংশগ্রহন করি। ১৮ই নভেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনী মিলিতভাবে যৌথ বাহিনী তৈরি হয়।

রাজশাহী জেলার বোয়ালিয়া থানার বাবলা তলা গ্রামে যুদ্ধে আমরা যোগদান করি, ১৮ নভেম্বর থেকে ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত একটানা ৭দিন সেখানে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলে। সেই যুদ্ধে আমার পাশের বাংকারে মহসিন আলী আনসারের মাথায় গুলি বিদ্ধ হয়ে মাথার খুলি উড়ে যায়, সঙ্গে সঙ্গে বাংকারের মধ্যে তিনি শহীদ হন।

তার লাশ দাফন করা সম্ভব হয়নি। মিত্রবাহিনী ভারি ট্যাংক,কামান, ভারি অস্ত্র ও গোলা বারুদ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছিল।রাজশাহী শহর মিত্র ও মুক্তি বাহিনীর দখলে চলে আসে এবং পাক হানাদার মুক্ত হয়। সেখান থেকে আমরা ফিরে আসতে থাকি।

বানেশ্বর, পুঠিয়া নাটোর ইয়াছিনপুর ব্রীজে ট্রেন চলাচল বন্ধ করার জন্য কৈগাড়ী কৃষ্টপুর আবীরের বাড়িতে দুই রাত্রি অবস্থান করি। পরবর্তীতে আমার নিজ এলাকা ঘোড়াগাছা আমহাটির বাড়িতে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, পিতা মাতার সংগে দেখা সাক্ষাতের জন্য আসি।

তাদের সাথে সাক্ষাত করি এবং বাড়িতে খানা খেতে বসি এমন সময় আঃ রব গাজী খবর নিয়ে আসে আমার সহযোদ্ধা কোকন মোললার পুত্র মসলেম উদ্দিনকে হানাদার বাহিনীর ডিভিশনাল ক্যাম্প, ফুলবাগানে ধরে নিয়ে গেছে। আমি ক্যাম্পের পশ্চিম পার্শ্বে আখ ক্ষেত হতে ষ্ট্রেইন গান দিয়ে ফায়ার করি।

তখন পাক বাহিনীর সদস্যরা বৃষ্টির মত গুলি চালাতে থাকে। তাদের গুলিতে আমার শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুলি লাগে। বাম কোমরে গুলি লাগাতে আমি পড়ে যাই। আমার সহযোদ্ধারা আমাকে বাড়িতে নিয়ে যায় এবং গ্রাম্য ডাক্তার দ্বারা আমার শরীর থেকে গুলি বের করা হয়। আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি।

ঐদিন ছিল ৭ ডিসেম্বর। আনুমানিক রাত ৩.৩০ মিনিটে পাক বাহিনী আমার বাড়ির চারদিকে ঘিরে ফেলে এবং ভোরে আমাকে, আমার সংগে রাখা একটি ষ্ট্রেনগান ও একটি রাইফেল, আমার পিতা, পিতার বড় ভাই, ভগ্নিপতি ইউনুস সরকার, তার ভাই সিরাজ সরকার ও ছাত্তার সরকারকে ধরে ফুলবাগান ক্যাম্পে নিয়ে আসে।

আমাদের উপরে চলতে থাকে অমানুষিক নির্যাতন, বৈদ্যুতিক শর্ট দেয়। তারা বলতে থাকে যে, আমার কাছে পাওয়া অস্ত্র দিয়ে আমাদের দু’জন সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে।ত মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প কোথায় আছে, তা জানার জন্যে তারা চেষ্টা চালায়। কিন্তু ব্যর্থ হয়।

পরে সেখান থেকে আমার পিতা, বড় আব্বা এবং ইউনুস সরকার এই তিন জনকে আমাদের শ্রদ্ধেয় চাচা মতি ভ‚ইয়ার সুপারিশে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু আমাকে কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে নাটোর কেন্দ্রীয় কারাগারের সেলে রাখা হয়। প্রতিদিন অস্বাভাবিকভাবে নির্যাতন চালানো হয়।

৭ই ডিসেম্বর হতে ১৯শে ডিসেম্বর পর্যন্ত চলতে থাকে নানা প্রশ্ন ও নির্যাতন। ১৯শে ডিসেম্বর পাক বাহিনীর সদস্যরা পালিয়ে গেলে আমরা যারা বন্দি ছিলাম তারা জেলের তালা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসি। পরের দিন ২০শে ডিসেম্বর হানাদার পাক বাহিনী বিভিন্ন ক্যাম্প হতে আত্মসমর্পনের জন্য দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি বর্তমানে উত্তরা গণভবনে জড়ো হয়।

গণভবনে এক চুক্তিনামায় মিত্রবাহিনীর পক্ষে স্বাক্ষর করেন ভানু সিং, পাক হানাদার বাহিনীর পক্ষে স্বাক্ষর করেন লে. কর্নেল রাজা হোসেন খান, মেজর বজলুর রহমান খান, মেজর শের ওয়ালী খানসহ নাম না জানা আরও অনেকে। ঐদিনই তারা অস্ত্র জমা দিয়ে নাটোর শহর ছেড়ে চলে যেতে থাকে। ২১শে ডিসেম্বর নাটোর পাক হানাদার মুক্ত হয়।

পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে স্বর্গীয় শংকর গোবিন্দ চৌধুরী এম.পি. তাঁহার আন্তরিক সহযোগিতায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে একখানা সনদপত্র ও ৩০০০ হাজার টাকার একটি চেক প্রদান করেন। আমি চাই মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা গণহত্যা, অগ্নি সংযোগ, নারী নির্যাতন, লুট, খুন করছে তাদের দ্রুত সঠিক তদন্ত করে বিচারের দাবী জানাচ্ছি।

এতে কোন বিনা অপরাধীর যেন কোন প্রকার হয়রানি না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখার জন্য মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের কাছে দাবী জানাই। সেই সাথে জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের জন্য মুক্তিকামী জনতাকে ঐক্যবদ্ধ থাকার অনুরোধ জানাই।’

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধনাটেরের অসহায় রুহুল আমিনের কবুতর খামার ?
পরবর্তী নিবন্ধলালপুরে রাস্তা এইচবিবিকরন কাজের উদ্বোধন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে