হোজ্জার গাধা ও টাইম মেশিন- তন্ময় ইমরান
এক.
একবার হোজ্জা নাসিরুদ্দিন গাধার পিঠে করে যাচ্ছিল বাজারে গাধাটাকে বেঁঁচবে বলে; স্ত্রীর অসুখ। কিছু টাকা পয়সা দরকার। পথে সে বাধার মুখে পড়লো। রাজার বাহিনী আসবে বলে পথের একপাশে তাকে সরিয়ে দেওয়া হলো। এমনিতে হোজ্জার বাধা পাওয়ার কথা নয়। তাকে সবাই চেনে। কিন্তু রাজার প্রাণনাশের জন্য কিছুদিন আগেই হামলা হয়েছে। কাজেই সেনাবাহিনী কঠিন নিরাপত্তা প্রটোকল মেনে চলছে।
হোজ্জা গাধা নিয়ে আর সব আমজনতার মধ্যে অপেক্ষা করতে লাগলো। ওদিকে রাজা একটা সুন্দর আরবি ঘোড়ায় চেপে টগবগ করতে করতে এলেন। ঘোড়াটা ঠিক হোজ্জার সামনে এসেই পাগলা আচরণ শুরু করলো। সামনের দুই পা তুলে ভিড়ের মধ্যে চিহিহিহিহি করে ডাকতে লাগলো। কেউ একজন রাজাকে হত্যা করতে তীর ছুঁড়েছে। তীরটা লেগেছে রাজার ঘোড়ার গলায়। এতেও কার্যসিদ্ধি হতো। ঘোড়ার থেকে পড়ে রাজা অক্কা পেত। কিন্তু রাজা ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ার আগ মুহূর্তে হোজ্জার গাধা কিভাবে যেন (সম্ভবত ভয় পেয়ে) একটু সরে গিয়েছিল, আর রাজা পড়লেন ঠিক গাধার উপর। এমন একটা দৃশ্য ঘটে গেল কয়েক মুহূর্তে। মনে হলো যেন গাধাটা রাজাকে উদ্ধার করতেই সেখানে ছুটে গেছে।
নিজের জান বাঁচানোয় গাধার তৎপরতায় মুগ্ধ হয়ে রাজা হোজ্জার গাধার নামে বিশাল এক পরগণার জমিদারি লিখে দিলেন। হোজ্জা যেহেতু গাধার মালিক কাজেই সে গাধার পক্ষে জমিদারিরও দেখভাল করবে।
এর কিছুদিন পর নয়া জমিদারির জায়গায় হোজ্জা নাসিরুদ্দিন স্ত্রী ও গাধা সমেত উপস্থিত হলো। এখানে সে পেল বিশাল বাংলো, চাকরবাকর, আরো কতো কি। নতুন জায়গায় এসে গাধার নামেই হোজ্জাকে যাবতীয় আদেশ-নির্দেশ দিতে হত, কেননা জমিদারি তো আসলে গাধার!
সে যাহোক, প্রতি রাতে হোজ্জা তার গাধাকে নিয়ে হাঁটতে বের হত। এখন তো আর গাধার পিঠে চড়তে পারে না, গাধা তো জমিদার৷ ওদিকে গাধার মতো ভারবাহী ও পরিশ্রমী একটা প্রাণী যদি বসে বসে খায় তাহলে দ্রুতই মারা যেতে পারে বলে হোজ্জার আশংকা ছিল। তাহলে হোজ্জা ও তার স্ত্রী পড়বে বিপদে! কাজেই নৈশ হাঁটার এ কর্মসূচি ছিল মূলত গাধার স্বাস্থ্য ভালো রাখার একটা প্রক্রিয়া।
হাঁটতে হাঁটতে হোজ্জা জঙ্গলের পাশে এলে তার খুব প্রস্রাবের বেগ আসলো। সে দ্রুত গাধাকে ছেড়ে জঙ্গলের ভিতরে গিয়ে হাল্কা হলো। ফিরে এসে দেখে গাধা নাই! সর্বনাশ কারবার। গাধা নাই মানে জমিদারি নাই। কেননা জমিদারি আদেশ দিতে অফিসে হোজ্জার সাথে গাধা থাকা লাগে। হোজ্জা গাধার পক্ষে জিম্মাদার হয়ে বিভিন্ন আদেশ দেয়।
হোজ্জা গাধা খুঁজতে লাগলো। তার ভাগ্য ভালো দুপুরে বেশ বৃষ্টি হওয়াতে রাতেও গাধার পায়ের ছাপ পাওয়া গেল। সেটা ধরে ধরে হোজ্জা জঙ্গলের একটু ভিতরে ঢুকে দেখলো একটা গোল মতো ঘর। সে ঘর চাঁদের আলোয় চকচক করছে। গাধার পায়ের ছাপ ওই ঘরটার খোলা দরজায় ঢুকে গেছে। হোজ্জা একবার ভাবলো এই ঘরটা এখানে এলো কী করে! তারপর জমিদারি ছুটে যাওয়ার চিন্তা তাকে দ্রুত ঘরের ভেতর থেকে গাধাকে বের করে নিয়ে আসার তাগিদ দিল। সে দ্রুত ঘরের ভেতর ঢুকলো। বের হলো সম্পূর্ণ নতুন এক জায়গায়। চারপাশে সব অদ্ভুত পোশাকের মানুষ। বড় বড় অদ্ভুত আকারের বাড়ি। গাড়ি। এ কীভাবে সম্ভব! এ তো সম্পূর্ণ আলাদা জায়গা।
হোজ্জা বিস্মিত হয়ে চারপাশ দেখতে লাগলো। তারপর খেয়াল করলো সে একটা দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। এই বাড়িটাও অনেক উঁচু ও লম্বা। আশেপাশের বাড়ির তুলনায় এটাকে মলিন ও পুরনো দেখাচ্ছে। হোজ্জাকে দেখে লোকেরা অবাক ও কৌতুহলের দৃষ্টিতে তাকালো। তবে কেউ কিছু বললো না।
হোজ্জা বাড়িটাকে চিনে রেখে গাধাকে খোঁজা শুরু করলো। এই দুনিয়া তার কাছে খুব আজব লাগলো। তবু নিজের কৌতুহল মেটানোর চেয়ে গাধা খোঁজা জরুরি। নইলে আয়েশের জমিদারি ছুটে যাবে যে!
কিছুক্ষণ খুঁজে হোজ্জা আবার সেই বাড়িটার দরজার কাছে চলে এলো। তারপর দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই আবার সেই জঙ্গলের গোল ঘরটায় পৌঁছালো।
রাতে বাড়ি ফিরে হোজ্জার ঘুম হলো না। বুদ্ধি আঁটলো। ভোর হওয়ার আগেই সে আগের গাধার মতো আরেকটা গাধা জোগাড় করলো বটে, তবে মনে মনে এই ভয়টাও পেল যে- আসল গাধা খুঁজে না পেলে ধরা সে আজ হোক, কাল হোক খাবেই।
ধরা খাওয়ার শঙ্কা জেঁকে বসলো পরদিন দরবার চালানোর শুরুতেই। পেয়াদাদের প্রধান বললো- গাধা জমিদার মহাশয়ের চেহারা এমন শুকনো লাগছে কেন! তিনি কি অসুস্থ!
হোজ্জা প্রমাদ গুণলো। গাধাকে অসুস্থ বানানো যাবে না। তাতে কবিরাজের ডাক পড়বে। কবিরাজ বুঝে ফেলবে গাধা অসুস্থ নয়। তখন আর লোকের বুঝতে বাকি থাকবে না গাধা পরিবর্তন হয়েছে।
তাই হোজ্জা গলায় দুঃখ এনে বললো- না উনার প্রথম স্ত্রী গাধী মারা গেছেন। আমাদের সাথে তিনি এখানে আসেননি। খবর পেয়ে গাধা মহাশয়ের মন খারাপ। এমতাবস্থায় তার মন ভালো হওয়ার জন্য আমরা সাতদিন অপেক্ষা করতে পারি।
সাতদিন দরবার স্থগিত করা হলো। ওদিকে হোজ্জা ঠিক করলো সাতদিনের মধ্যে অচিন দেশে গিয়ে গাধা খুঁজে বের করবে।
দুই.
পাগড়ি পরা হোজ্জার ভাষা অচিন দেশের কেউ বোঝে না। কী খুঁজছে তাও কেউ বোঝে না। অবশেষে এক লোক হোজ্জাকে একটা কার্ড দিল। হোজ্জা বুঝলো লোকটি ইশারা ইঙ্গিতে তাকে বোঝাতে চাইছে- কাগজের এই টুকরো হাতে হাজির হলে তার সমস্যার সমাধান হবে।
হোজ্জা তৃতীয় দিনে সেই কার্ডের ঠিকানায় অনেক ঘাম ঝরিয়ে পৌঁছাতে পারলো।
হোজ্জা সেখানে পৌঁছাতেই খুব চমৎকার এক সুপুরুষ স্বাগত জানালো হোজ্জার ভাষাতেই। পরবর্তী আধঘণ্টায় সবকিছু হোজ্জাকে বুঝিয়ে বললো সে। আসলে হোজ্জা চলে এসেছে ভবিষ্যতের এক পৃথিবীতে। জঙ্গলের মধ্যে থাকা গোলঘর মূলত এক টাইম মেশিন। ওটাতে ঢোকার পর কে কোথা হতে অতীত থেকে এই সময়ের পৃথিবীতে আসবে কেউ আন্দাজ করতে পারে না। তবে সবাই এক সময়েই এসে হাজির হচ্ছে।
তারপর লোকটা হোজ্জাকে বললো- সে আসলে মানুষ নয়, মানুষেরই তৈরি একটা যন্ত্র যাকে রোবট বলে। তার ভেতরে হাজার বছরের পুরনো ভাষা জমা আছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও আছে, যার কারণে সে হোজ্জার কথা বা ভাষা ধরতে পারছে।
অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর হোজ্জা বললো- সবই বুঝলাম, কিন্তু আমার গাধাটাকে কোথায় পাবো বলো তো!
রোবট বললো- তুমি বের হয়েছ পুরনো দালানের দরজা দিয়ে। এরকম আরো অনেক মানুষ টাইম মেশিনের বিভিন্ন দরজা দিয়ে বের হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। আমরা এখনো ঠিক ধরতে পারিনি কয়টা বের হওয়ার দরজার তৈরি হয়েছে। কিংবা তোমার সময়ে কয়টা ঢোকার রাস্তা তৈরি হয়েছে। আমাদের বিজ্ঞানীরা সেটা নিয়ে এখনো কাজ করে যাচ্ছে। তবে তোমার গাধা কোথা দিয়ে বের হয়েছে তা আমি বলতে পারি। এবং কোথায় আছে তাও বলতে পারি।
– কোথায় আছে সে!
– তোমার গাধা বের হয়েছে আমাদের প্রেসিডেন্টের বাসভবনে তৈরি টাইম মেশিনের দরজা দিয়ে। অত্যন্ত পবিত্র এই গাধাকে তুমি আর ফিরে পাবে না।
– কেন? আমার গাধাকে আমি ফিরে পাবো না কেন?
– দ্যাখো আমাদের এখানে নিয়ম কানুন একটু আলাদা। এখানে মানুষের সংখ্যা খুব বেশি; কিন্তু তুমি দেখবে অন্যান্য পশু পাখি নেই। এমনকি টাইম মেশিন যখন আমরা তৈরি করি তখন অতীত থেকে মানুষের বদলে পশু পাখি আনার চেষ্টাই করেছি। ব্যর্থ হয়েছি। কেননা তোমার মতো মানুষই এসেছে বরাবর। যখন আমরা খুব হতাশ হয়ে পড়েছিলাম- তখন তোমার গাধা প্রেসিডেন্টের বাসভবনে আসলো। এ এক বিরল ঘটনা। একটা মাত্র গাধা আমরা পেয়েছি, সেটাকে ছাড়ি কিভাবে! তাছাড়া সে এখন প্রেসিডেন্টের বন্ধু। তার সাথে খায়, ঘুমায়- আয়েশ করে। অনেক গাধা থাকলে আলাদা কথা ছিল।
হোজ্জা সব শুনে ঝিম মেরে বসে থাকলো। তারপরে বললো- তারমানে এখন তোমাদের দেশে মানুষের চেয়ে গাধার মূল্য বেশি!
রোবট বললো- অবশ্যই। যা নেই তার মূল্য সকল যুগেই সেই সময়ে বেশি ছিল।
হোজ্জা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার সময়ে ফিরে এলো। পরদিন সে বিশেষ দরবার ডেকে আগের দিনের নকল জমিদার গাধা সামনে রেখে একটা আদেশ জারি করলো- গাধা মহাশয়ের ইচ্ছা তার প্রয়াত স্ত্রীর স্মরণে এক বিশাল কবরখানা হবে জঙলে। সেখানে রাষ্ট্রের সব গাধা জড়ো করে উৎসর্গ করা হবে। যাতে এই গাধাগুলো পরকালে তার গাধীকে সাহচর্য দিতে পারে। প্রত্যেক গাধার মালিককে দ্বিগুণ দাম দেওয়া হবে।
মানুষের চেয়ে গাধার দাম বেশি যে সমাজে তা নিয়ে হোজ্জার মনে এক ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। সে মনে মনে একটা পরিকল্পনা করেছিল।
জমিদারের অর্থকোষ খালি করে একগাদা গাধা কেনা হলো। জঙ্গলের গোল ঘরটাকে বানানো হলো সমাধি ক্ষেত্র। তারপর একে একে গাধা হোজ্জা নিজ হাতে ওপারে পাঠানো শুরু করলো। হোজ্জার ইচ্ছা ভবিষ্যতের পৃথিবীর যে সময়ে তার গাধা আটকে আছে, সেখানে শত শত গাধা দিয়ে ভরিয়ে দিবে যাতে গাধার মূল্য কমে এবং তার গাধা ফিরে আসে৷
কয়েক হাজার গাধা পাঠানোর কয়েকদিনের মাথায় এক সকালে হোজ্জা আবিষ্কার করলেন গোলঘর দিয়ে তার গাধাটা ফিরে এসেছে। কিন্তু গাধা ফিরিয়ে আনতে আরো প্রচুর গাধা কেনাতে জমিদারি নিলামে উঠেছে। হোজ্জা আবার টাইম মেশিন দিয়ে সেই রোবটের কাছে জানতে গেল প্রকৃত ব্যাপার কী!
রোবট জানালো- তোমার গাধা আসার পর থেকে একের পর এক গাধা আসতে আসতে পুরো প্রেসিডেন্ট ভবন আর শহর ভরে গেছে। এখন এটাকে অশুভ লক্ষণ হিসেবে দেখা হচ্ছে, তাই তোমার গাধা ফেরত পাঠানো হয়েছে।
হোজ্জা অতীতে ফিরে গাট্টি-বোচকা বেঁধে তার স্ত্রীর সাথে আবার পুরান শহরে ফিরে এল, সাথে তার জমিদার গাধাটাও ছিল।