“মরীচিকা” -শাপলা জাকিয়া‘র ভৌতিক গল্প – পর্ব-০১

0
933
Shapla Zakia

শাপলা জাকিয়া : আমাদের নতুন ফ্ল্যাটে মাঝরাতে খুটখুট শব্দ হয়। খুব মৃদু শব্দ। অনেকটা চুপচাপ ঘরে ঘড়ির টিকটিক শব্দের মতো। ফ্যান ছাড়লে অার শব্দটা শোনা যায় না। কিম্তু সমস্যা হচ্ছে ফেব্রুয়ারীর দিকে ফ্যান অন করলে শীত লাগে, আর না করলে গরম। রাতে বারবার উঠে ফ্যান অন- অফ করি।

পাশে শুয়ে থাকা আমার স্বামী প্রবাল মুখে কিছু বলে না কিন্তু আমার কর্মকান্ডে তার ঘুম ভাঙ্গে, তার ঘুম অল্পতেই ভাঙ্গে, সে হতাশ চোখে তাকায়। আমার ইদানীংকার ঘুম না হওয়ার বিষয়টা আমি তাকে অনেকবার বলেছি। আজও বললাম,

-সরি তোমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলাম। ঘুম আসছিল না, গরম লাগছিল। তোমার গরম লাগছে না? ফ্যানটা তাই ছেড়ে দিলাম। এবার এই মান্ধাতার আমলের খাটটার মায়া ছাড়ো প্লিজ, নড়াচড়া করলেই কড়মড় শব্দ হয়, তোমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। তোমার কী শীত করছে? গায়ের ওপর চাদরটা দিয়ে দেই?

প্রবাল উত্তর দিল না, পাশ ফিরে শুয়ে আবার ঘুমের হাতে নিজেকে সঁপে দেয়ার চেষ্টা করলো। আমি যেমন বেশি কথা বলি, ও তেমনি কম কথা বলে। আমার ধারনা স্রষ্টা স্বামী – স্ত্রী দুজনকে মিলিয়ে একটা প্যাকেজ তৈরি করেন। প্যাকেজের বৈশিষ্ট্যগুলি নির্দিষ্ট মাপে থাকে।

ধরা যাক আমাদের প্যাকেজে যতোটুকু বকবক করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তার বেশিরভাগ পড়েছে আমার ওপর, বেচারা প্রবাল পেয়েছে অল্প, তাই সে বাধ্য হয়ে কম কথা বলে। আবার প্রবাল ধৈর্যের সাইডটাতে লাকি। সে ধৈর্য পেয়েছে অনেক, তাই আমার ভাগে ধৈর্য কমে গেছে।

আমি প্রবালের গায়ে চাদর টেনে দিলাম, তবে গলা পর্যন্ত না দিয়ে কোমড় পর্যন্ত দিলাম। কারণ তার শীত লাগছে, না গরম লাগছে তা সে বলেনি। কোমড় পর্যন্ত ঢাকা মানে হচ্ছে ফিফটি ফিফটি ব্যবস্থা। গরমের জন্য অর্ধেক খোলা আর শীতের জন্য অর্ধেক ঢাকা।

আমি ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু ঘুম আসে না। চোখ বন্ধ করলেই একটা অচেনা মুখ ভাসে চোখে। কেমন যেন নার্ভটা টানটান হয়ে ওঠে। মোবাইলে দেখলাম তিনটা বাজে। একটু শীত শীত করছে। ফ্যানটা তবে বন্ধ করি। সাবধানে বিছানা থেকে নামলাম যাতে শব্দ না হয় কিন্তু লাভ হলো না,

খাটটা কড়মড় করলোই দাঁত কিড়মিড় করার মতো, যেন সেও ঘুমাচ্ছিল, আমি তার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিয়েছি! ফ্যান বন্ধ করে বিছানায় আসতেই আবার কানে এলো খুটখুট শব্দ, যেন কেউ টাইপ করছে কম্পিউটারের কী বোর্ডে, মৃদু শব্দ। আমি নিজের অজান্তেই প্রবালের গায়ে হাত দিয়ে বললাম,

– শুনতে পাচ্ছো? ঐ যে আবার শব্দ শোনা যাচ্ছে। প্রবাল ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে চাইলো। আমি অন্ধকার ঘরে ঘুমাতে পারিনা বলে ঘরে একটা মৃদু আলো জ্বলে সবসময়, সেই আলোয় প্রবালের চোখটা একইসাথে বিরক্ত ও করুন লাগলো।

আমি কাঁচুমাচু গলায় বললাম,
– সরি, আবার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিয়েছি।
প্রবাল বললো,
– মেঘলা, সরি বলার মানে হচ্ছে ভুল কাজটা তুমি আর করবে না তার একটা আশ্বাস। সরি বলা মানে ভুল কাজ বার বার করে সেটা ম্যানেজ করা না।
আমি আবার বললাম,
– সরি, আসলে শব্দটা হচ্ছে, শুনতে পাচ্ছো না?
– পাচ্ছি না, ওপরতলার হবে। তুমি ঘুমাও তো।
আমি বললাম,
– আমার ভয় করছে, তুমি আমার দিকে ফিরে শোও, আমার ভয় করছে।

প্রবাল তাই করলো, বাড়তি যোগ করলো আমাকে ছুঁয়ে থাকাটা। তার হাত গায়ের ওপর থাকায় কেমন ভরসা পেলাম। নতুন ফ্ল্যাটে আসার পর আমার ভয় খুব বেড়েছে। অবশ্য আমি চিরকালের ভীতু। কিশোরী বেলায় খাটে লম্বা চুল ঝুলিয়ে ঘুমাতে পারতাম না, মনে হতো খাটের নিচ থেকে কোন অশরীরী আত্মা আমার চুল ধরে টানাটানি করবে। এই সাতাশ বছর বয়সে অতোটা ভীতু নই, তবু খুব সাহসী হয়েও উঠতে পারিনি।

প্রবাল বলেছে, শব্দটা অতিপ্রাকৃত কিছু না, ওপরতলা থেকে আসছে, ও হয়তো ঠিকই বলেছে, এরকম ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
কতোক্ষণ ঘুমিয়েছি জানিনা, হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গলো কারও ডাকে। তাকিয়ে দেখি আমার মা বিছানার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, বলছেন,
-এসো! তোমার সাথে কথা আছে।
আমার মা আমাকে ডাকতেই পারেন, হয়তো বেডরুমের দরজা খোলা ছিল। কিন্তু কি যেন একটা অস্বাভাবিক লাগছে।

আমি খাট থেকে নামলাম। প্রবাল ওপাশ ফিরে ঘুমাচ্ছে। এবার আর ওর ঘুম ভাঙ্গলো না। আমি মাকে অনুসরণ করলাম। মা লম্বা করিডোর পার হয়ে ডাইনিং এ এলেন কিন্তু থামলেন না। শুধু ঘাড় ঘুরিয়ে রহস্যময় এক হাসি দিয়ে গেস্ট রুমের দিকে রওয়ানা হলেন। কি বলবেন মা?

ডাইনিংএ সারারাত একটা আলো জ্বলে। রাতে কোনকিছু দরকার হলে যাতে আমার অন্ধকারে এসে আলো জ্বালতে না হয়, তাই। আমি অন্ধকার ভয় পাই।
কিন্তু গেস্ট রুমে কোন আলো জ্বলছে না, সেটা অন্ধকার। মা সেখানে ঢুকলেন বলে আমি সাহস করে ঢুকলাম। আর ঢোকার সাথে সাথে মনে পড়লো মা তো আমার সাথে থাকেন না। তিনি থাকেন রাজশাহীতে বড় ভাইয়ার কাছে।

প্রচন্ড একটা ভয়ের অনুভূতি আমার শিরদাঁড়া দিয়ে নেমে গেলো, সেটা ক্রমশ আমার সারা শরীরকে গ্রাস করার আগে আমি দ্রুত হাতে পাশের দেয়ালের সুইচবোর্ড দুই হাতে চেপে ধরলাম। একসাথে লাইট, ফ্যান সব চালু হলো। সেই আলো- বাতাসে দেখলাম, ঘরে আমি ছাড়া কেউ নেই।

দৌড়ে চলে যেতে পারছি না প্রবালের কাছে। পা দুইটা অসম্ভব ভারি। প্রবাল বলে চিৎকার করতে গিয়েও পারলাম না। কিন্তু ঘাড়ের কাছে কে যেন কি চেপে ধরলো। সব অন্ধকার হয়ে আসছে…
চোখ খুললাম কারো স্পর্শে, দেখলাম প্রবাল আমাকে ঝাঁকাচ্ছে দুই হাতে, বলছে,
– এই মেঘলা! তোমার কি হয়েছে? গেস্টরুমের ফ্লোরে শুয়ে আছো কেনো?
চলবে….

 

 

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধ“হে সময়… বেহুলা হও” কবি গৌতম চট্টোপাধ্যায‘এর কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধ“আমি তোমার নই” কবি শাহিনা খাতুন‘এর কবিতা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে