“মরীচিকা” -শাপলা জাকিয়া‘এর ভৌতিক গল্প -পর্ব-০৪

0
450
Shapla-Zakia

“মরীচিকা ”ভৌতিক গল্প
পর্ব-০৪
-শাপলা জাকিয়া

সে আর আমি খুব ভালো মিডিয়াম!
এই কথা দিয়ে চশমা পরা ছেলেটি কি বুঝাতে চাইছে বুঝতে না পেরে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলাম। প্রশ্নটা মুখে করা হলো না কারণ আমার মস্তিষ্ক শব্দ ঠিকঠাক গুছাতে পারছে না। যতোবার অস্বাভাবিক কিছুর মুখোমুখি হই, ততোবারই যেন পরবর্তী কিছু সময়ের জন্য মাথা হ্যাং হয়ে যায়!

আমার অবস্থা বুঝতে পেরেই রুনা ভাবি বলে উঠলেন,
-বেচারি এমনিতেই ভয় পাচ্ছে, এর মধ্যে তুই ওকে আর বিভ্রান্ত করিস না তো দীপু!
দীপু স্মিত হেসে আমার সামনে চেয়ার টেনে বসে বললো,

-উনি এখনই বিভ্রান্তির মধ্যে আছেন, আমি বরং সত্যটা জানতে ও মেনে নিতে সাহায্য করতে পারি। তুমি এক কাজ করো রুনা আপা, ওনাকে এক গ্লাস গরম দুধ খাওয়াতে পারো কিনা দেখো।
আমি তড়িঘড়ি মাথা নেড়ে রুনা ভাবিকে বুঝালাম দুধের কোন প্রয়োজন নেই।

দীপু সেটা ধরতে পেরে বললো,
-না করবেন না। মৃত ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগের সময় জীবিত মানুষদের প্রচুর শক্তিক্ষয় হয়। আপনার এখনকার শরীরের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। এক গ্লাস দুধ আপনার জন্য খুব জরুরী।
রুনা ভাবি বয়সে আমার বড়। টিয়া ও পাখি নামে দুই জমজ মেয়ের মা। মেয়েরা স্কুলে পড়ে। কিছু মানুষের স্নেহ

-ভালোবাসার মজুদ অনেক বেশি থাকে। নিজের সন্তানদের স্নেহ বিলানোর পরও অন্যদের জন্যও তাদের ঝুলিতে অনেক স্নেহ-আদর থাকে।
সেই স্নেহ- আদর ছোট বড় নির্বিশেষে সকলকে তারা বিলি করতে পারে। যে নারী এরকম সে স্বামীকেও সন্তানের মতো যত্ন করে, তাদের মধ্যে প্রেমিকা ভাবের চেয়ে মাতৃভাব প্রবল হয়। এরা প্রেমিকা, স্ত্রী, বোন, বন্ধু বা প্রতিবেশী

-সব সম্পর্কের মধ্যে মা সুলভ মধুর যত্ন মিশিয়ে দেয়। দ্রুত আপনি সম্বোধন থেকে তুমি বা তুই তে চলে আসতে পারে। মাত্র অল্প কিছুদিন রুনা ভাবিকে চিনি, কিন্তু আমার ধারনা তিনি ওরকম মানুষ।
ধারনা আরেকবার সত্য প্রমাণ করে রুনা ভাবি আমার জন্য শুধু দুধ আনলেন না। দুধের ওপর বাদাম আর চকলেট কুচি ছড়িয়ে তবে আনলেন। খাওয়ার পর আমি অনেকটা ধাতস্থ হলাম।

দীপু বললো,
– এখন নিশ্চয় বেটার ফিল করছেন, এবার বলুন তো ঠিক কি দেখেছেন?
রুনা ভাবি আমার হাত ধরে পাশের সোফায় বসে বললো,

-দীপুকে বলতে পারো মেঘলা। ও আমার বড় মামার ছেলে। আমেরিকায় থাকে। একমাস হলো বাংলাদেশে এসেছে বেড়াতে। আর আমার বাড়িতে দীপু এসেছে গতকাল রাতে। এসে পর্যন্ত কয়েকবার বলেছে, এই বাড়িতে নাকি অশরীরী আত্মার বাস। আমি ভেবেছি মজা করছে, আমরা তো কখনও ভয় টয় পাইনি। কিন্তু তারপর মনে পড়লো তোমার কথা। পাশের ফ্ল্যাটে নতুন আসার পর তুমি কী ভয়টাই না পেয়েছিলে, অজ্ঞান-টজ্ঞান হয়ে একাকার।

– আপনি কিভাবে জানলেন, এই বাড়িতে অশরীরী আত্মার বাস?
প্রশ্নটা আমি করলাম দীপুকে। অপরিচিত একজন মানুষকে নিজের ভয়-ভীতির কথা বলাটা কতোটা যুক্তিযুক্ত হবে ভাবছি। কিন্তু সেই সাথে দীপুর মুখের দিকে তাকালে একধরনের ভরসা পাচ্ছি। মনে হচ্ছে, দীপুর মুখে একটা প্রদীপ জ্বলছে, তাতে আশেপাশের অস্পষ্ট ধোঁয়াটে ভাবটা চলে যাচ্ছে।

অবশ্য চারপাশ ধোঁয়াটে লাগার কোন কারণ নেই, রুনা ভাবির এই ফ্ল্যাটে অনেক আলো। আমার এরকম হয়, কোন মানুষকে প্রথম দেখলে তাকে ঘিরে নানান তুলনা মনে জমাট বেঁধে ওঠে, এটা প্রবালকে কয়েকবার বলেছি। প্রবালের ধারনা আমি খুব কল্পনাপ্রবণ মানুষ বলেই এভাবে নিজের অজান্তে কল্পনা করতে শুরু করি। ডাক্তারও তাই বলেছেন, আমি খুব বেশি কল্পনাপ্রবণ। ধূসর শাড়ীর মেয়েটি আমার কল্পনা মাত্র।
দীপু যেন আমার চিন্তা আন্দাজ করতে পেরেই বলে উঠলো,

-ভাবছেন তো, আমাকে কেন বলবেন? আমি একজন মিডিয়াম। সহজ করে বললে বলতে হয়, আমি খুব ভালো রিসিভার, যে আত্মার জগত থেকে পাঠানো বার্তা রিসিভ করতে পারে।
আমি এবার বেশ চমকে উঠলাম কারণ এই ছেলে আমাকেও ভালো মিডিয়াম বলেছে। আমি তড়িঘড়ি বললাম,
-আমি আত্মাদের কথা রিসিভ করতে পারি না।
-সত্যি বলছেন? আপনার মুখ দেখে কিন্তু সেটা মনে হচ্ছে না।
-আমার মুখ দেখেই আপনি বুঝে ফেললেন?
-জীবিত মানুষদের মানসিক অবস্থা ও ক্ষমতাও আমি আন্দাজ করতে পারি। আপনি পারেন না?
-না তো।
-পারেন। মনে করে দেখুন তো, কারও সাথে প্রথম আলাপে তাকে আপনার যা মনে হয়, শেষ পর্যন্ত দেখা যায় সে, সেরকমই। ধরুন খুব ভালো একটা মানুষকে আপনার শয়তান মনে হচ্ছে, তারপর ঘটনাচক্রে দেখা গেলো সে সত্যিই মহা শয়তান, হয় না এরকম?
-তা হয়।
-আপনার স্বপ্ন প্রায়ই সত্য হয়?
-হয়।
-আপনি বুদ্ধিমতী, শিক্ষিত, যুক্তিবাদী মানুষ হয়েও অনেক সময় এটা ভেবে ভয় পেতে থাকেন যে আপনার আশেপাশে কেউ অবস্থান করছে, যাকে চোখে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু আপনি অনুভব করতে পারছেন।
-আমি খুব কল্পনাপ্রবণ বলে হয়তো এরকম হয়।

-না, আপনি খুব ভালো রিসিভার বলে এরকম হয়। আমাদের এই দৃশ্যমান জগতের আড়ালেও আরো একাধিক জগত রয়েছে। আমাদের চোখের দেখার ক্ষমতা সীমিত বলে আমরা দেখতে পাইনা। কিন্তু কোন কোন মানুষের ব্রেন সেই অদৃশ্য জগত আর সেই জগতের বাসিন্দাদের পাঠানো সিগন্যাল রিসিভ করতে পারে।

এইসব মানুষ শুরুতে বোঝে না কেন অদ্ভুত অনুভূতি তাদের হয়, তাই তারা ভয় পেতে থাকে। এসব মানুষদেরকে তাদের আশেপাশের মানুষজন ভীতু মানুষ বলে ভাবে। কারণ যারা অন্য জগতের তথ্য রিসিভ করতে পারে না, তারা অদ্ভুত অনুভূতির মুখোমুখি হয় না, তাই ভয়ও পায় না। এরা সারারাত অন্ধকার গোরস্থানে বসে থাকলেও ভয় পাবে না বা অস্বাভাবিক কিছু দেখবে না।

কিন্তু আপনি বা আমি যদি কয়েক ঘন্টা একা অন্ধকার গোরস্থানে বসে থাকি, আমাদের খবর হয়ে যাবে! বলতে পারেন আমরা হলাম স্মার্ট টিভি যেখানে ওয়াইফাই কানেকশন সেট করা আছে বলে গুগল,ইউটিউব,ফেসবুক সব ধরা পড়ে। আর যারা অশরীরী আত্মার জগতকে বিশ্বাস করে না তারা হলো সাধারণ টিভির মতো যে টিভি হাসতে হাসতে বলে, ইউটিউব আবার কি? জীবনেও তো দেখলাম না। ইউটিউব বা গুগল বলে আসলে কিছু নেই, সব কল্পনা।

দীপু কথাগুলি বলে হাসলো। আমি হাসতে পারলাম না। আতংকিত হয়ে বললাম,
-আপনি বলতে চাইছেন, ধূসর শাড়ি পরা মেয়েটা সত্যি আছে?
-ধূসর শাড়ি পরা মেয়ে কে?
-যাকে শুধু আমি দেখি, প্রবাল দেখতে পায় না।
-একটু আগে ঐ মেয়েটাকে দেখেই আপনি এখানে ওভাবে ছুটে এসেছেন?
-জ্বী।
দীপু বললো,
-শুরু থেকে আমাকে সব খুলে বলুন প্লিজ। কোন খুঁটিনাটি বাদ দেবেন না।
আমি যতোটা সম্ভব বিস্তারিত বললাম।
সব শুনে দীপু বললো,
এই ফ্ল্যাটে আসার আগে আপনি কখনো মেয়েটিকে কোথাও দেখেছেন?
আমি বললাম,
-না।
-ছোটবেলায় অস্বাভাবিক কোন কিছু দেখে কখনও ভয় পেয়েছেন?
-স্পষ্টভাবে কিছু দেখিনি কিন্তু ছোটবেলা থেকেই আমি খুব ভীতু। আমাদের দাদা বাড়িতে যখন থাকতাম তখন চুল খুলে ঘুমাতে পারতাম না, মনে হতো খাটের নিচে কেউ আছে, আমি ঘুমিয়ে পড়লেই কেউ আমার চুল ধরে টানাটানি করবে।
আমার শেষের কথা শুনে রুনা ভাবি হেসে ফেললেন।
দীপু বললো,
-হেসো না রুনা আপা। বিশ্বাস করো এরা আসলেই অনেক সময় খাটের নিচে, অন্ধকার জায়গায় ঘাপটি মেরে থাকে। তবে সব খাটের নিচে না।
আমি বললাম,
-এরকম অনুভূতি আমার শুধু দাদা বাড়ির খাটে শুলেই হতো, পরে ঐ বাড়ি বিক্রি করে অন্য বাড়ি কেনা হয়। নতুন বাড়িতে আর কখনও এরকম ভয় পাইনি।
দীপু এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে বললো,
-চলুন, আপনাদের ফ্ল্যাটটা একবার দেখে আসি।
আমি বললাম,
-আপনি যা শোনালেন, আমি আর জীবনেও ফ্ল্যাটে ঢুকবো না। প্রবাল আসলে কোন একটা হোটেলে উঠে যাবো তারপর অন্য কোন বাসা খুঁজে বের করবো, নইলে আমি রাজশাহী মায়ের কাছে চলে যাবো।
দীপু হাত উল্টে বললো,

– লাভ নাই। আপনাকে ভয় দেখাতে চাই না কিন্তু সত্যটা বলা জরুরী। সত্য হচ্ছে আপনি যেখানে যাবেন সেও যাবে। কারণ মেয়েটি আপনার শরীর চিনে গেছে। আপনার শরীরে প্রবেশ করেছে সে একবার, একবার প্রবেশ করতে পারলে বারবার প্রবেশ করার ক্ষমতা পেয়ে যায়।

তাই পালিয়ে লাভ নেই। বাঁচতে হলে ঐ অতৃপ্ত আত্মার মুখোমুখি হয়ে আপনাকে সমস্যার সমাধান করতে হবে।
আমি ভয়াবহ হতাশা নিয়ে প্রশ্ন করলাম,
-সে কবে আমার শরীরে প্রবেশ করলো?

দীপু বললো,
-আপনি বলেছেন, একদিন ঝড়ের মতো বাতাস আপনার নাক আর কান দিয়ে ভিতরে ঢুকেছিল, সেইদিন।
রুনা ভাবি দীপুকে বললো,
– তুই যদি ঐ ফ্লাটে যাস তবে তো তোকেও ধরবে, কারণ তুই ভালো মিডিয়াম!
-আমি প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মিডিয়াম। বিখ্যাত আমেরিকান মিডিয়াম রিচার্ডের কাছ থেকে অনেক শেখা আছে আমার। চলুন মেঘলা, যাওয়া যাক। তবে তার আগে আমার কিছু জিনিস যোগাড় করতে হবে।
আমি মরীয়া হয়ে বললাম,
-আপনি একা যান, আমি যেতে পারবো না।
দীপু বললো,
-আমি একা গেলে হবেনা।
-তবে প্রবাল আসুক, ও আসলে যাবো।
-আপনার হাজবেন্ডকে তবে তাড়াতাড়ি আসতে বলুন, সন্ধ্যার আগে। সন্ধ্যা হলে ওদের ক্ষমতা বেড়ে যায়। আর হ্যাঁ, আসার সময় আপনার হাজবেন্ডকে মনে করে কিছু ফিটকিরি আর মোমবাতি নিয়ে আসতে বলবেন।

চলবে….

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধ“একাকী এক জনম”- কাজী আতীকের কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধ“মরীচিকা” শাপলা জাকিয়া‘এর ভৌতিক গল্প -পর্ব-০৫

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে