ll ভালোবাসা, নাম রেখো তুমি একটি বিভূতিগাছ ll বনশিমতলার ঘাট ll-অমিতকুমার বিশ্বাস

0
584
Amit

ll ভালোবাসা, নাম রেখো তুমি একটি বিভূতিগাছ ll বনশিমতলার ঘাট ll-অমিতকুমার বিশ্বাস

বারাকপুর ও মাধবপুরের মাঝে ইছামতী। ২০০০ সালে এই গ্রামদুটি জুড়ে যায় বিভূতিভূষণ সেতুতে। সেইসব দিনে জল ও কুয়াশার ভিতর সূর্যোদয় দেখব বলে খুব শীতভোরে সাইকেল ছুটিয়ে সেতুর উপর স্থির হয়েছি কত না একা একা। সেতুর পাশেই সরকারি উদ্যোগে নবনির্মিত কংক্রিটের বিভূতিঘাট। ঘাট-সংলগ্ন দোতলা বাংলো। বাংলোর উঠোনে উদ্যান। তখন এটাকে ঘিরে ঝিকিমিকি ভাব তৈরি হয় সেখানে। এমন চটকে গভীরতা থাকে না কখনও, মাইক আর মাতব্বুরি থাকে খুব। এদিকে বিভূতিভূষণের পৈতৃকবাড়ি আজও ধ্বংসস্তূপের নীচে পড়ে আছে। সেই যে মৃণালিনী দেবী হরিনাভী-রাজপুরে (‘হরিনাভি’ না কি ‘হরিণাভী’?) নিভাননী দেবীর ( বিভূতিভূষণের প্রথম গল্প ‘,উপেক্ষিতা’ এই নিভাননী দেবীকে নিয়েই লেখা, যে-জন্য হরিনাভির বিদ্যালয়ে বিভূতিভূষণের শিক্ষকতা-জীবনে ঘোর সংকট নেমে আসে, এবং পরে তাঁকে সেই চাকরি ছেড়ে চলেও আসতে হয়) অনুরোধে মাটির উনুনে কড়াই চাপা দিয়ে বড়ছেলের কাছে গেলেন, এলেন না আর কখনও। সেটা সেপ্টেম্বর ১৯২১। সেই শেষ। প্রায় শতবর্ষ সময়ের শম্বুক-হাঁটাহাঁটি। বর্তমানে যেটাকে বিভূতভূষণের বাড়ি বলে মনে করি, তাও বেশ অযত্নে পড়ে আছে দীর্ঘকাল। এটা ১৯৩৮ সালে সইমার কাছ থেকে কিনে নেওয়া ভিটে। এখন সেটাকে দেখার আর কেউ নেই। এক শীতের দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখি পেছনে ক্যাটারিং সংস্থা জমিয়ে ব্যবসা খুলে বসেছে!

এত খরচ করে যে জায়গাটাতে বিভূতিঘাট বানানো হয়েছে, সেখানে আদৌ বিভূতিভূষণ স্নান করতেন না। করতেন আরও উত্তর-পশ্চিম দিকে, বনশিমতলার ঘাটে। এক-দেড়শো মিটার হেঁটে গেলে জায়গাটা চোখে পড়ে। তমাল-ই (তমাল বন্দোপাধ্যায় আমাকে প্রথম ভুলটা ধরিয়ে দেয়। তমাল শ্রীপল্লি-বাঁওড়পাড়ে বেড়ে উঠেছে। বিভূতিভূষণের প্রতিবেশী হরিপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাতি অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও এ-বিষয়ে কথা বলে জেনেছি ঢের। একদিন কনক-কে কনক মন্ডল নিয়ে নৌকোয় বেরিয়ে পড়েছি বনশিমতলা ঘাটের খোঁজে। আশি ছুঁই-ছুঁই সুবল হালদার নৌকটার মাঝি। নৌকো বনশিমতলার ঘাটের কাছে এল। জায়গাটা এখন ভূতুড়ে। কচুরিপানার দাম আর জলশ্যাওলায় ভরা। বাঁশের ঝাড় থেকে বুড়িপান ও তেলাকুচা লতা ঝুলে পড়েছে নদীর বুকে। এ-গাঁয়ের প্রাচীন ইতিহাসের অনেকটাই বুকে নিয়ে আজও বেঁচে আছেন সুবলমাঝি। ঢের ঢের গল্প বলে চলেন একাত্তরের। রাজাকারেরা কীভাবে ঢুকে পড়ল বারাকপুরের কাছে এক আমবাগানে, মুক্তিফৌজদের ট্রেনিং সেন্টারে। কীভাবে ধরা পড়ল। কীভাবে তাঁর বাবার সঙ্গে মুক্তিফৌজদের সীমান্ত পার করে ফিরে আসতেন গভীর রাতে। সেদিন জনজীবনের এক গভীর ইতিহাসে ঢুকে পড়ছিলাম আমরা দুজন। নদীর সে-জোর আর নেই এখন। সুবলমাঝিও বেশ দুর্বল। সময় হয়েছে পার। ইতিহাসের ছায়ামায়া থেকে গেছে চড়ের পটলমাচার নীচে, বুনো ঝোপঝাড়ের নীচে। প্রতিবেশী কিশোরী প্রেমিকা খুকুর সঙ্গে এ-ঘাট থেকে নদী-পারাপারের কত গল্প শুনেছি তাঁর পাতায়-পাতায়। মা মৃণালিনী, প্রথমা স্ত্রী গৌরী, বোন জাফরী (জাহ্নবী), দ্বিতীয় স্ত্রী রমা সাঁতার দিয়েছে কত সেখানে। পিতামহ তারিণীচরণ কিংবা পিতা মহানন্দের পদচিহ্ন এইঘাটেই বিলীন। আমরা পারিনি সেই স্মৃতিঘাট ধরে রাখতে।

এতই হতভাগা——– আমি, আমার বোধ, আমার আধুনিকতা, আমার ইতিহাস-চিন্তাহীনতা। গৌরীও এক শরতে এই বনশিমতলার ঘাট থেকেই বিদায় নিয়েছিল পানিতরের উদ্দেশে। মৃণালিনী বারণ করেছিলেন ঢের। বড়লোক শ্বশুরের প্রতি অভিমানে সম্মতি দিয়েছিলেন বিভূতি। কিন্তু মন কি সায় দেয় তাতে! টলটলে চোখে তাকিয়েছিলেন গৌরীর দিকে। গৌরীর মুখটা চেনা থেকে ক্রমশ অচেনা অস্পষ্ট থমথমে হয়ে যাচ্ছে যেন! বাধ্যকন্যা গৌরীও গলুই থেকে উঠে পড়তে পারেননি সেবার। বনশিমতলার ঘাট থেকে পানিতরের উদ্দেশে চলতে শুরু করে নৌকো। দুটি মুখ দুজনের কাছে ক্রমশ অস্পষ্ট হতে হতে শূন্য হয়ে আসে। এর কিছুদিন পর পুজোয় অভিমানী বিভূতি পানিতরে গেলে দুজনের দেখা হয় ঠিকই, কিন্তু গৌরীকে আসতে দেওয়া হয় না। ব্যথা আর অভিমান নিয়ে ফিরে আসেন বিভূতি।

না, আর দেখা হয়নি তাঁদের। অগ্রহায়ণে যখন ফের গৌরীকে আনতে গেলেন পানিতরে, তখন গৌরীর মাঝি নৌকো ছেড়ে দিয়েছে চিরতরে!

এইসব হৃদয়ব্যথা স্পর্শ করতে পারেনি বলেই বানানো গল্পের মতো তৈরি হয়ে যায় ঝকঝকে কংক্রিটঘাট!
কংক্রিট আছে, ঘাট আছে, ভিড় আছে, মাইক ও মাতব্বর আছে, কিন্তু প্রাণ নেই, ইতিহাস নেই, অনুভব নেই কোনও!

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধ“স্বার্থ”- ফেরদৌস রহমানের কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধ“আদৃতা” -আগমণী ধরের কবিতা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে