“মরীচিকা”-শাপলা জাকিয়া‘র ভৌতিক গল্প -পর্ব-০৬

0
317
Shapla-Zakia

“মরীচিকা”

শাপলা জাকিয়া‘র ভৌতিক গল্প -পর্ব-০৬

শাপলা জাকিয়া : আমার কন্ঠস্বরের এই পরিবর্তন প্রবাল ধরতে পারলো। তাকে বিভ্রান্ত মনে হলো। চিন্তিত গলায় বললো,
-এরকম করে কথা বলছো কেনো? মহিম কে?
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে, দুই হাত নাড়িয়ে, গলা ছেড়ে চিৎকার করে আবার একই প্রশ্ন করলাম,
– মহিম…. কোথায়…?

প্রবাল চমকে দূরে সরে গেলো। তারপর টেবিলের ওপর রাখা ঢাউস সুটকেসটা খোলার চেষ্টা করলো কাঁপা হাতে । মনে হচ্ছে চেইন খুঁজে পাচ্ছে না। কয়েকবারের চেষ্টায় সুটকেসটা খুলে ওষুধ বের করলো ও। পুরোটা সময় বারবার আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। তাকে ভীত মনে হচ্ছে।

আমি ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছি ওর দিকে।
আমার মধ্যে কী দেখতে পেলো প্রবাল জানিনা, আমি তার চোখে তীব্র আতংক দেখতে পেলাম, ও পিছু হটছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়াতে ওকে থামতে হলো। আমি ওর কাছাকাছি পৌঁছানোর পর পানি ছাড়াই ওষুধগুলি আমার দিকে এগিয়ে দিলো।

আমি বাঁ হাতে ওর শার্টের কলার চেপে ধরে ওকে মাটি থেকে এক হাত শূণ্যে উঁচু করে ধরলাম। বিস্মিত, ভীত প্রবালের চোখ যেন কোটর থেকে বেড়িয়ে পড়বে! প্রবাল মুখ দিয়ে শব্দ করছে
-আ….আ..আ..!
আমি বললাম,
– মহিম কোথায় বলো!
-আ..মি জানিনা। আ..মি মহিমকে চিনিনা।
প্রবাল তোতলাচ্ছে, আমি ওর কলার ছেড়ে দিতেই, মাটিতে পড়ে গেলো। জোরে ওর গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলাম।

প্রবাল ব্যাথায় ওর গাল চেপে ধরলো!
প্রবালকে মারার জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। দুইহাতে ওকে জড়িয়ে ধরতে চাইলাম, লাল হয়ে যাওয়া মুখটায় হাত বুলিয়ে আদর করতে চাইলাম, কিন্তু কিছুই করতে পারলাম না। শরীর আমার ইচ্ছাগুলিকে পাত্তা দিচ্ছে না, সে অন্য কারও নির্দেশ শুনছে যেন।

এক অদ্ভুত অসহায়ত্ববোধ আমাকে কাবু করে ফেললো।
সেইসাথে অনুভব করলাম মহিম নামের কারও জন্য আমার বুকের ভিতর আকুলি বিকুলি করা কষ্টেরা সাপের মতো হিসহিস করে জেগে উঠছে! সিংহের মতো গজড়াচ্ছে! এক পশুসুলভ হীংস্রতায় হাতের কাছে যা ছিল ছুঁড়ে ফেলতে শুরু করলাম। বালিশ, কম্বল, চাদর, প্রবালের চার্জে দেয়া মোবাইল সব ছুঁড়ে ফেললাম।মোবাইলটা গিয়ে লাগলো প্রবালের মাথায়!

ব্যাথায় প্রবাল কাতর শব্দ করে, সেই শব্দে ওর কাছে ছুটে যেতে ইচ্ছা করে আমার কিন্তু ছুটে যেতে পারিনা। আমি বরং মহিম মহিম বলে কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে গড়াগড়ি খাই।
প্রবাল ফোনে কারও সাথে কথা বলছে টের পাই, সেইসাথে কানে ভেসে আসে ফজরের আজান।

আমার খুব কাহিল লাগতে শুরু করে। প্রচণ্ড ঘুম পায়, আমি চোখ বন্ধ করে ফ্লোরে শুয়ে পড়ি।
চোখ বন্ধ করার সাথে সাথেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করি বোধহয়, কারণ যা দেখছি তার সবই অপরিচিত। আগে কখনও দেখিনি। জেগে জেগে এমন স্বপ্নও কখনও দেখিনি।

দেখতে পাচ্ছি একটা মধ্যবিত্ত বাড়ির ড্রইং রুম, সেখানে দামি কিছু তেমন নেই, সাধারণ আসবাব, কমন ফুল ফুল ছাপা পর্দা। পেটমোটা টিভি আর ঘটাং ঘটাং শব্দ করা সিলিং ফ্যান। শুধু আলাদা করার মতো একটা ব্যাপারই আছে, সেটা হলো ঘর ভর্তি পেইন্টিং। ছবিগুলি আমার আঁকা।

কিন্তু আমি তো ছবি আঁকতে পারিনা!
অথচ কি স্পষ্ট মনে করতে পারছি, ছবি আঁকার সময় আমার অনুভূতিগুলির কথা। এক- একটা ছবির সামনে দাঁড়াচ্ছি, আর সন্তানস্নেহে হাত বুলাচ্ছি। আমার লম্বা লম্বা চিকন আঙুল দেখে অবাক হলাম।

আমার আঙুলের মাথা এতো তীক্ষ্ণ ছিল না তো! জ্যোতিষ শাস্ত্রে এরকম আঙুল থাকলে তাদের শিল্পী হাত বলে। আমার হাত এরকম ছিল না, আমার হলো কর্মী হাত, কিছুটা চৌকোনা।

জ্যোতিষ শাস্ত্রে একসময় খুব আগ্রহ ছিল, রাত দিন এসব বই পড়তাম। আমার শিল্পী হাত ছিল না বলে মন খারাপ ছিল। শিল্পী হাত দেখতে খুবই সুন্দর হয়। কিন্তু একটা বই এ যখন পড়লাম শিল্পী হাতের মানুষ খুব হুটহাট প্রেমে পড়ে যায়, তখন মনে হয়েছিল, আমার কর্মী হাতই ভালো।

অতো রোমান্টিক হয়ে কাজ নেই। শিল্পী হাতের আমার এক বান্ধবী একইসাথে একাধিক প্রেম করতো। একজন প্রেমিক আরেকজনের অস্তিত্ব জানতো না। বহু প্রেম করে যারা এদের কি চালাকি বুদ্ধিও বেশি হয়?

আমি ছবিগুলির সামনে থেকে সরে এলাম। সেন্টার টেবিলের ওপর সুতী কাপড়ের গোলাপি টেবিলক্লথ, ফুলতোলা। এরকম টেবিলক্লথ আজকাল শহুরে বাড়িগুলিতে চোখে পড়ে না, মফস্বলের বাড়িগুলিতে দেখা যায়।
গোলাপী টেবিলক্লথের চারদিক উড়ছে, সে বোধহয় বাতাসের সহযোগীতায় ফ্লোরেই নেমে পড়তো, কিন্তু তার বুকের ওপর একটা মোবাইল রাখা আছে বলে পারছে না।

আমি মোবাইলটা হাতে তুলে নিলাম। আর সাথে সাথে সুযোগ পেয়ে টেবিল ক্লথটা ফ্লোরে কুন্ডুলি পাকিয়ে পড়ে গেলো।
আমি খিলখিল করে হেসে বললাম,
-ফ্লোরটা কী তোর মহিম রে? খালি তার কাছে যেতে চাস? যা! তুই তোর মহিমের কাছে যা, আমি আমার মহিমের কাছে যাই।

কথাটা বলে মোবাইলটা মুখের সামনে এনে সেলফি তুললাম পটাপট। সেলফিগুলি দেখে অবাক হলাম। মুখটা আমার নয়, রূপালীর! আমি মেঘলা কিভাবে যেন রূপালীর চিন্তায়, শরীরে ঢুকে গেছি!
আমি এখন রূপালী, আমার মেঘলা পরিচয়টার কথা ভাবতে ইচ্ছা করছে না। আমি সেলফিগুলি দেখে খুশি হলাম, ভালো দেখাচ্ছে! ফটাফট সেগুলিকে মহিমের ইনবক্সে পাঠিয়ে দিতে ইচ্ছা করলো।

মানুষটা কী সুন্দর করেই না প্রশংসা করতে জানে! কিন্তু কেমন লজ্জা করছে। আমি লিখলাম,
-‘ কি করো?’
মহিম লিখলো,
-‘ তুমি! আজ দেখি মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি! ‘
-‘আমি বৃষ্টি?’
-‘তোমাকে ডাকলে পাইনা, প্রার্থনাতেও তোমাকে পাওয়া যায়না। শুধু যখন নিজের ইচ্ছা হয়,তখন বৃষ্টির মতো ঝড়ো!’

মহিমের মেসেজের রিপ্লাই দিতে পারলাম না। পরপর দুইবার ডোরবেল বেজে উঠলো।
আমি অথবা রূপালী ম্যাসেঞ্জার থেকে মহিমের সমস্ত মেসেজ ডিলিট করলাম তারপর দরজা খুললাম। খুলে দেখলাম এক দীর্ঘকায় পুরুষের বিরক্তিকর মুখ। সে বাজখাঁই গলায় বললো,
– যা ভেবেছিলাম, হাতে মোবাইল! কার সাথে চ্যাট করছিলে দেখি, দরজা খুলতে এতো দেরি হলো কেনো?

আমার হাত থেকে একরকম কেড়ে নিলো মোবাইলটা। সদ্য তোলা সেলফিগুলি ডিলিট করা হয়নি, সেগুলি দেখে বললো,
– এমন ঢং ঢাং করে ছবি তুলে ফেসবুকে দিতে তোমার লজ্জা করে না?
আমি বললাম,
-ফেসবুকে দেইনি তো।
-তবে? কোন নাগরকে পাঠিয়েছো?
আমি ফুঁসে উঠলাম,
-ভদ্রভাবে কথা বলো।
লোকটি আমার চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকি দিয়ে বললো,
-আমার সাথে গলা উঁচু করে কথা বলবি না।

হঠাৎ তার নিজের ফোন বাজায় লোকটা আমাকে ছেড়ে পাশের রুমে চলে গেলো। আমার মোবাইলটা টেবিলে রেখে গেছে। আমার প্রচণ্ড জিদ চেপে গেলো। আমি সবগুলি ছবি মুহূর্তেই মহিমকে সেন্ড করলাম।
একটু পর মহিম আমায় এক দীর্ঘ কবিতা পাঠালো।

আমাকে নিয়ে ওর লেখা সেই কবিতা পড়ে আমি আরো একবার মহিমের প্রেমে পড়লাম।
ও ঘর থেকে লোকটা ভাতের হুকুম করছে। কিচেনে গিয়ে ভাত বাড়তে বাড়তে ঠিক করলাম মহিমের সাথে দেখা করবো।

রূপালীর এরকম সিদ্ধান্তে আমি মেঘলা হিসাবে খুব বিরক্ত হলাম। পাশের ঘরের লোকটি যে ওর স্বামী, বুঝতে পারছি। রূপালী কি তবে মহিমের সাথে পরকীয়ায় জড়াতে চলেছে? আমি পরকীয়া ঘৃণা করি, হয়তো কর্মীহাত বলে। রূপালী পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ছে ওর শিল্পী হাত বলে?

জ্যোতিষ বিদ্যা বিশ্বাস করতে চাইনা। আমি রূপালীর হাতের তালু চোখের সামনে নিয়ে এলাম। শনির ক্ষেত্রে ক্রস চিহ্ন, তারমানে রূপালীর আত্মহত্যা করার সম্ভাবনা খুব প্রবল। শুক্র ক্ষেত্র প্রবল উচ্চ, রুপালী রোমান্টিক, ক্ষতিকর পর্যায়ের রোমান্টিক!
চলবে…

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধ“মুখোমুখি” – সালেহীন বিপ্লবের কবিতা 
পরবর্তী নিবন্ধ“মরীচিকা”-শাপলা জাকিয়া‘র ভৌতিক গল্প -পর্ব-০৭

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে