“মহাকালে রেখাপাত” – স্বকৃত নোমান

0
676
নোমান এনকে

মহাকালে রেখাপাত

– স্বকৃত নোমান

সাহিত্য জগতে ‘নিভৃতচারী লেখক’ ও ‘প্রচারবিমুখ লেখক’ শব্দ দুটি খুব ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে উচ্চারিত হতে দেখা যায়। কারো কারো কাছে শব্দ দুটি খুবই পবিত্র। লেখককে আসলেই নিভৃতচারী হতে হয়। লেখক যদি হট্টগোল-ডামাঢোলের মধ্যে থাকেন, লিখবেন কখন? লেখালেখির জন্য তাকে কোলাহলের বাইরে থাকতে হয়। লেখকের কাজ নয় গণযোগাযোগ আর বই বিপণন। লেখক তার আনন্দের জন্যই লেখেন। যতক্ষণ লেখাটি তার কাছে থাকে ততক্ষণ সেটি শিল্প। কিন্তু যখন লেখাটি গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হয়ে বাজারে চলে যায়, তখন সেটি একই সঙ্গে শিল্প এবং পণ্যও। এই শিল্পপণ্যটি বাজারজাত করার কাজ লেখকের নয়, প্রকাশকের। শিল্পপণ্যটির কথা পাঠকদের জানানোর জন্য যা যা করা দরকার সব প্রকাশকই করবেন। প্রকাশক যদি মনে করেন প্রচার-প্রচারণার কাজটি তার একার নয়, লেখকেরও; তবে তিনি সত্যিকারের প্রকাশক নন। প্রকাশকের কাজ ও দায় সম্পর্কে তিনি অবগত নন। তার আসলে প্রকাশক হওয়ার কথা ছিল না, তিনি বাইসান্স প্রকাশক, তিনি সাপ্লাই-নির্ভর প্রকাশক।

আমাদের দেশে অবশ্য দুই ধরনের লেখক আছেন। একদল লেখক আছেন যারা আসলেই নিভৃতচারী ও প্রচারবিমুখ এবং তারা অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা দুর্বলও। কিন্তু তারা সত্যিকারের লেখক, সত্যিকারের শিল্পস্রষ্টা। যেমন ছিলেন শহীদুল জহির, শওকত আলী। এখনো অনেকে আছেন। নাম উল্লেখ করতে গেলে সামাজিক জটিলতা সৃষ্টি হবে বলে করলাম না। লেখাই তাদের সাধনা। নিজের শিল্পপণ্যটি বাজারজাতের করণকৌশল তারা জানেন না। জানলেও তারা মনে করেন কাজটি তাদের নয়, প্রকাশকের। তাদের কাজ লেখা। তারা নির্ভর করেন প্রকাশকদের ওপর। উদাহরণ হিসেবে যেমন ধরুন কবি ও কথাসাহিত্যিক অারমান হোসেনের কথা। তিনি মৌলিক শিল্পস্রষ্টা। শিল্পচর্চায় তিনি এতই নিবিষ্টি থাকেন যে, তার পক্ষে নিজের শিল্পপণ্যটির প্রচার-প্রচারণা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। ফলে তার নামের সঙ্গে লেগে গেছে ‘নিভৃতচারী’ ও ‘প্রচারবিমুখ’ উপাধি। প্রচার-প্রচারণার দৌঁড়ে পিছিয়ে থাকেন বলে তিনি অজনপ্রিয় লেখক। তার বই বৃহত্তর পাঠকগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছায় না। তাঁর একটি বই পাঁচ শ কপির বেশি বিক্রি হয় না।

আরেক দল লেখক আছেন, যারা বেশ অর্থবিত্তশালী এবং একইসঙ্গে লেখালেখির পাশাপাশি প্রচার-প্রচারণায়ও পারদর্শী। বাজারজাতের করণকৌশল তাদের জানা। মেলার এক মাসে জনপ্রিয় দৈনিকগুলোতে দেখা যায় তাদের বইয়ের বড় বড় বিজ্ঞাপন। ফেসবুকে দেখা যায় তাদের বইয়ের স্পন্সর বিজ্ঞাপন। কোনো কোনো লেখক নিজের বইটিকে ‘কালজয়ী’ ‘বাংলা সাহিত্যের সেরা’ ‘এ যাবৎকালের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ’ ইত্যাদি বিশেষ্যণে বিশোষ্যায়িত করে পোস্টার ছেপে সেঁটে দেন নগরীর দেয়ালে দেয়ালে। এদের কেউ কেউ আবার এতই ‘জনপ্রিয়’ যে, বই ছাপা হওয়ার আগে কিংবা বইমেলা শুরু হওয়ার আগেই ‘প্রি-অর্ডারে’ তাদের বইয়ের পঞ্চম-ষষ্ঠ-সপ্তম মুদ্রণ শেষ হয়ে যায়। অনেকের প্রথম মুদ্রণে ছাপা হয় দুই শ, দ্বিতীয় মুদ্রণে দুই শ এবং তৃতীয় মুদ্রণে দুই শ। এভাবে কৌশল করে তারা মুদ্রণসংখ্যা বাড়িয়ে পাঠকসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে থাকেন। তারা মনে করেন তাদের এই কৌশল শুধু তারাই জানেন, আর কেউ জানে না। আমরা এদেরকে বলতে পারি ‘জনপ্রিয় লেখক।’ কিন্তু দুঃখজনকভাবে লেখক হিসেবে তাদের বেশিরভাগই অত্যন্ত দুর্বল। কারো কারো লেখা এতই দুর্বল যে, শিল্পসৃষ্টি তো দূরস্ত, ঠিকমতো বাক্যও গঠন করতে পারেন না। কিন্তু প্রচার-প্রচারণার দৌড়ে তারা জনপ্রিয় লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যান। এই জনপ্রিয় লেখকদের একজন শরাফত উদ্দিন। তার একেকটি বই বিক্রি হয় পাঁচ-সাত হাজার কিংবা দশ হাজার।

এখন নিভৃচারী ও প্রচারবিমুখ আরমান হোসেনের বইটি প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে বৃহত্তর পাঠকসমাজের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রকাশকের কোনো দায় আছে কিনা? আমি মনে করি আছে। এবং আগেই বলেছি কাজটি আসলে প্রকাশকেরই। কিন্তু আরমান হোসেনের বইটি বৃহত্তর পাঠকসমাজের কাছে পৌছে দেওয়ার জন্য যে প্রচার-প্রচারণার প্রয়োজন, তা কি করছেন আমাদের প্রকাশকরা? না, বেশিরভাগ প্রকাশক তা করছেন না। তারা নিভৃতচারী ও প্রচারবিমুখ শব্দদ্বয়ের গাম্ভীর্য ও পবিত্রতা নষ্ট করতে রাজি নন। তারা মনে করেন, আরমান হোসেন তো নিভৃতচারী ও প্রচারবিমুখ লেখক, তার বইয়ের এত প্রচার-প্রচারণার দরকার নেই। পাছে তিনি মাইন্ড করেন! প্রতিষ্ঠানের ‘ওয়েট বৃদ্ধির’ জন্য তার বই ছাপতে হয় বলে ছাপা। আমরা বরং জনপ্রিয় লেখক শরাফত উদ্দিনের, যার বই বেশি চলে, যার বই মর্মান্তিকভাবে দুর্বল, যার বই পাঠক বেশি ‘খায়’, তার বইটিরই প্রচার-প্রচারণা বেশি করি। তাতে দু-পয়সা বেশি লাভ হবে।

কেবল প্রকাশকরাই নন, অনলাইন কেন্দ্রিক বই বিপণন প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তাব্যক্তিদেরও একই মনোভাব। যেমন ধরা যাক রকমারি.কম-এর কথা। বর্তমানে এটি বই বিপণনের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান। কয়েক বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটির কর্মতৎপরতা গভীরভাবে লক্ষ করছি। দেখছি, তারা শরাফত উদ্দিনের মতো জনপ্রিয় লেখকদের বইটির প্রচার-প্রচারণাই সবচেয়ে বেশি দিয়ে থাকে। প্রকাশকদের মতো তারাও মনে করে, আরমান হোসেন তো নিভৃতচারী ও প্রচারবিমুখ লেখক, তার বইটির প্রচারণার দরকার নেই। নিভৃতচারী ও প্রচারবিমুখ শব্দদ্বয়ের গাম্ভীর্য ও পবিত্রতা অক্ষুণ্ন থাকুক। ফলে আরমান হোসেনের বইটির কথা বৃহত্তর পাঠকসমাজ জানতে পারে না। তিনি অজনপ্রিয় থেকে আরো অজনপ্রিয় হতে থাকেন। আমি দেখিনি রকমারি.কম গত তিন বছরে হাসান আজিজুল হক, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, যতীন সরকার, কুমার চক্রবর্তী, জাকির তালুকদার, আহমাদ মোস্তফা কামাল, চঞ্চল আশরাফ, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, অদিতি ফাল্গুনী, শামীম রেজা, আকিমুন রহমান, মজনু শাহ বা এঁদের মতো (বিস্তর আছেন) আরো আরো যেসব লেখক আছেন, যাঁরা সত্যিকারের সাহিত্যিক, সত্যিকারের শিল্পস্রষ্টা, তাঁদের বইয়ের কোনো প্রচার-প্রচারণা দিতে।

আপনারা হয়ত ভাবেন লেখক তো লেখকই, তাদের মধ্যে আবার প্রকৃত-অপ্রকৃত কী, মৌলিক-অমৌলিক কী, বড়-ছোট কী? আপনাদের ভাবনাটি সঠিক নয়। ইলিশের স্বাদ আর পুঁটির স্বাদ এক নয়। খাসি ও ব্রয়লার মুরগির স্বাদ এক নয়। অর্জুনবৃক্ষ আর ছাতিমবৃক্ষ এক নয়। কমলকুমার মজুমদার আর সমরেশ মজুমদার এক নন। জীবনানন্দ দাশ আর বলোহরি দাশ এক নন। লেখকের মধ্যেও বড়-ছোট থাকে। বড় লেখকদের লেখা পড়লে পাঠরুচির উন্নতি ঘটে। পাঠরুচির উন্নতির জন্য বড় লেখকদের লেখা পড়তে হয়। শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং সাহিত্যরুচিতে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশের পাঠকদের পাঠরুচি উন্নয়নে প্রকাশকদের কোনো দায় আছে কিনা? বই বিপণন প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো দায় আছে কিনা? নাকি এই দায় কেবলই নিভৃতচারী ও প্রচারবিমুখ তকমাখাওয়া লেখকদের?

মহাকালে রেখাপাত
১৭.০১.২০২০

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধ“গলিটাতো এদিকেই ছিলো” -কবি শাহিনা রঞ্জু’এর কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধ“আগুনের গান” কবি শামীয়ারা পারভীন দীপ‘এর কবিতা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে