অবিরাম যুদ্ধের ক্লান্তি! – জাকির তালুকদার

0
277
জাকির-এনকে

অবিরাম যুদ্ধের ক্লান্তি!
জাকির তালুকদার

২০০০ সালের শেষের দিকে আহমদ ছফা মাঝে মাঝে বলতেন– এবার মরে যাব।
হয়তো শেষ চুমুক দিয়ে চায়ের কাপ টেবিলে রাখলেন। তারপরে কোনো পূর্বাভাস না দিয়েই দুম করে বলে ফেললেন– এবার মরেই যাই।
আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলা বাক্যটি। বুঝতে পারতাম না অনুমোদন চাইছেন নাকি নিজের মনেই বলছেন।
আমি বলতাম– আপনার তো এখন মরা চলবে না। উপমহাদেশের রেনেসাঁ-ব্যক্তিত্ব আমীর খুসরোকে নিয়ে আপনার ৪০০ পৃষ্ঠার উপন্যাস লেখা বাকি আছে। বাকি আছে বাংলাসাহিত্যকে পথভ্রষ্ট করা বুদ্ধদেব বসু, সুধীন দত্তদের নিয়ে পর্যালোচনামূলক বইটাও।
তিনি মুখের হাসি অম্লান রেখে বলতেন– অন্য কেউ লিখবে।

এবং ৭-৮ মাসের মধ্যেই তিনি চলে গেলেন।

তখন বুঝতে পারিনি, জীবনের ক্লান্তি তাঁকে পূর্বাভাস দিয়েছিল হয়তো।
প্রচণ্ড অসুস্থ থাকতেন। মনের জোরে লেখার কাজ চালিয়ে যেতেন। নিজের আর্থিক সঞ্চয় ছিল না। কিন্তু অন্যদের সাহায্য করার জন্য টাকার জোগাড়ে ব্যস্ত থাকতে হতো। তরুণ কোনো কোনো কবির চাকুরির জন্য একে-তাকে সুপারিশ করতেন। বাসা থেকে আজিজ মার্কেটে আসা-যাওয়াটাও কষ্টকর মনে হতো। বলেছিলাম– আমেরিকায় গেলেন অথচ চিকিৎসাটা নিলেন না সেখানে।
উত্তরে উষ্মার সাথে বলতেন– আমাদের দেশে কি ভালো ডাক্তার কম আছে? আমেরিকাতে যারা আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন, তারাও ডাক্তার দেখাতে বলছিলেন। আমি বলেছি দেশেই চিকিৎসা নেব।

জীবন ও যুদ্ধের ক্লান্তির কথা বলছিলাম। নিজের জীবন তো তিনি নিজেই বেছে নিয়েছিলেন। উচ্চশিক্ষা উচ্চতর ডিগ্রি নেবার যোগ্যতা যথেষ্টর বেশি ছিল। সে পথ মারাননি। মানুষ নিজের জন্য একটি নিশ্চিত পেশা খুঁজে নেয়, তিনি তা-ও করেননি। এই প্রসঙ্গে বলেছিলেন– বিপ্লব হলে সবাই ভালো থাকবে। তখন আমিও ভালো থাকব। তাই নিজের জন্য আলাদা করে ভাবার প্রয়োজন বোধ করিনি।
বিয়ে বা ঘর-সংসার করেননি। হতে পারে যাদের প্রেমে পড়েছিলেন তারা তাঁকে বিয়ে করতে রাজি হননি। আসলে এই বিষয়টা নিয়ে আমি তাঁকে কখনোই প্রশ্ন করিনি।

শরীরভরা অসুখ নিয়ে মানুষটি বছরের পর বছর কাজ করে গেছেন। দেশের স্বার্থে, মানুষের স্বার্থে সবসময় তাঁকে সক্রিয় থাকতে হয়েছে। অবিরত প্রতিবাদ-প্রতিক্রিয়া জানাতে হয়েছে। অশক্ত শরীর নিয়ে সভা-সমাবেশেও যেতে হয়েছে।

সব ক্লান্তি জয় করা যেত যদি আন্দোলন-সংগ্রামের সাফল্য কিছুটা হলেও ভোগ করতে পারত সাধারণ জনগণ। কিন্তু তা ঘটেনি। নিজেকে সান্ত্বনা দেবার মতো কিছু ছিল না তাঁর কাছে। বাংলাদেশ প্রতিদিন বেশি করে দুর্দশাগ্রস্ত হচ্ছিল। এখনো হচ্ছে। যখন বোঝা যায় জাতির পতন ঠেকানোর ক্ষমতা আমার বা আমাদের হাতে নেই, তখন সারাজীবনের ক্লান্তি একসাথে ভর করে। সেই ক্লান্তিই হয়তো ছফা ভাইকে বলিয়ে নিত– এবার মরে যাব।

আহমদ ছফার মতো সর্বস্ব দিয়ে যুদ্ধ আমি করিনি। সেই আমাকেও ব্যর্থ যুদ্ধের ক্লান্তি মাঝে মাঝে বিবশ করে দেয়। বলি– এখন মরে গেলে দুঃখ নাই।

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধনাটোরে আজ ২৭ জুলাই কে কোথায় আক্রান্ত হলো জেনে নিন
পরবর্তী নিবন্ধআম্মা নেই কোথাও… পলি শাহিনা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে