উত্তরা গণভবন: রাজকীয় সোনালী স্মৃতি

0
382
Ganavaban

উত্তরা গণভবন: রাজকীয় সোনালী স্মৃতি

অনু সরকার,
দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি বা উত্তরা গণভবন নাটোরে অবস্থিত। এককালের দিঘাপতিয়ার রাজাদের বাসস্থানই বর্তমানে উত্তরা গণভবন নামে পরিচিত। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিঘাপতিয়া রাজবাড়িকে ‘উত্তরা গণভবন’ নামে নামকরণ করেন। তিনি ওই বছর ৯ ফেব্রুয়ারি এই রাজবাড়ির মূল প্রাসাদে মন্ত্রিসভার বৈঠক আহ্বান করেন। সেই থেকে রাজবাড়িটি ‘উত্তরা গণভবন‘-এর প্রকৃত মর্যাদা লাভ করে।

প্রতিষ্ঠার ইতিহাস : প্রায় তিনশত বছরের ঐতিহ্যবাহী দিঘাপতিয়া রাজবাড়িটি বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম। দিঘাপতিয়া রাজপ্রাসাদের মূল অংশ এবং সংলগ্ন কিছু ভবন নির্মাণ করেছিলেন দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজা দয়ারাম রায়।

রাজবংশের ষষ্ঠ রাজা প্রমদানাথ রায় ১৮৯৭ সালের ১০ জুন নাটোরের ডোমপাড়া মাঠে তিনদিনব্যাপী বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের এক অধিবেশন আয়োজন করেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তি এ অধিবেশনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে যোগ দেন।

অধিবেশনের শেষ দিন ১২ জুন প্রায় ১৮ মিনিটের এক প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পে রাজপ্রাসাদটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। পরে রাজা প্রমদানাথ রায় ১৮৯৭ সাল থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত ১১ বছর সময় ধরে বিদেশি বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী ও চিত্রকর্ম শিল্পী আর দেশি মিস্ত্রিদের সহায়তায় সাড়ে ৪১ একর জমির উপর এই রাজবাড়িটি পুনঃনির্মাণ করেন।

সাড়ে ৪১ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত প্রাসাদটি পরিখা ও উঁচু প্রাচীরঘেরা। প্রাসাদের পূর্বপাশে পিরামিড আকৃতির চারতলা প্রবেশদ্বার রয়েছে যা উপরের দিকে সরু। প্রবেশদ্বারের উপরের অংশে একটি ঘড়ি বসানো রয়েছে।

মধ্যযুগীয় বাংলাদেশের অন্যান্য সামন্ত প্রাসাদের মতোই নাটোরের রাজবাড়িতে রয়েছে দীর্ঘ প্রবেশ পথ। এ পথের দু’ধারে বোতল পামের সুবিন্যাস লক্ষণীয়।

দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দয়ারাম রায়। তিনি নাটোরের রাজা-মহারাজ রামজীবনের একান্ত অনুগত একজন দেওয়ান ছিলেন। নাটোর রাজ্যের উত্থানে দয়ারাম রায় অসামান্য ভূমিকা রাখেন। এ কারণে মহারাজ রামজীবন খুশি হয়ে ১৭০৬ সালের দিকে দয়ারামকে উপহার হিসেবে বাসস্থানের জন্য দিঘাপতিয়ায় কিছু জমি দান করেন। পরে জমিদার ও রাজা হওয়ার পর ১৭৩৪ সালে দয়ারাম রায় দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন।

এই রাজবাড়ির প্রবেশ পথের বিশাল ফটকটি আসলে একটি বিরাটাকৃতির পাথরের ঘড়ি। ঘড়িটি রাজা দয়ারাম সেই সময় ইংল্যান্ড থেকে আনিয়েছিলেন। ঘড়িটির পাশে রয়েছে একটি বড় ঘণ্টা। এক সময় এই ঘণ্টাধ্বনি বহুদূর থেকে শোনা যেত।

প্রাসাদের ভেতর বহু প্রাচীন ও দুর্লভ প্রজাতির গাছের সমাবেশ ও সমারোহ রয়েছে। ঢাকার জাতীয় স্মৃতিসৌধের শোভাবর্ধনকারী রোপণকৃত ফুল ব্রাউনিয়া ও ককেসিয়া এখান থেকেই নেয়া হয়।

এছাড়া অন্যান্য বৃক্ষের মধ্যে এখানে আছে রাজ-অশোক, সৌরভী, পারিজাত, হাপাবমালি, কর্পূর, হরীতকী, যষ্টিমধু, মাধবী, তারাঝরা, মাইকাস, নীলমণিলতা, হৈমন্তীসহ বিভিন্ন দুর্লভ প্রজাতির ফলজ ও ঔষধি বৃক্ষ। প্রাসাদের মধ্যে পরিখা বা লেকের পাড়ে এসব বৃক্ষের মহাসমারোহ।

প্রাসাদের প্রবেশ পথের চারদিকে প্রাসাদঘেরা পরিখা যা পুরো রাজপ্রাসাদকে ঘিরে রেখেছে। ভেতরে বিশাল মাঠ ও গোলাপ বাগান, একপাশে গণপূর্ত অফিস। দ্বিতল হলুদ ভবনটি কুমার প্যালেস নামে পরিচিত। এই প্রাসাদে শেষ রাজকুমার (বড় রাজকুমার) প্রভাত কুমার রায় বসবাস করতেন। প্রাসাদের নিচতলাটি টর্চারসেল হিসেবে ব্যবহৃত হত।

এই চত্বরে একটি একতলা তহশিল অফিস আছে। সে সময়কার চারটি কামান রয়েছে। কামানগুলোর স্থাপনকাল ছিল ১৭৯৯ সাল।

বিশাল রাজদরবারসংলগ্ন বাগানে জমিদার দয়ারামের একটি ভাস্কর্য তার স্মৃতির প্রতীক। প্রাসাদের মধ্যে একটি মিলনায়তন ভবনসহ রয়েছে আরো দুইটি ভবন।

গাড়ি পার্ক করার গ্যারেজ আলাদা। যাবতীয় স্থাপনা মাঝখানে। প্রাসাদের ভেতর রয়েছে বিভিন্ন ব্যবহার্য জিনিসপত্র। ভবনের মধ্যে জাদুঘর, বহু দর্শনীয় স্মৃতিস্তম্ভ, ভাস্কর্য ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য দৃষ্টিকাড়ে।

ইতালীয় গার্ডেন উত্তরা গণভবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশ। গার্ডেনটির আসবাবপত্র রাজা দয়ারাম ইটালি থেকে আনিয়েছিলেন। ছিপ হাতে কালো রঙের মার্বেল পাথরের মূর্তিটি দৃষ্টিনন্দন। গার্ডেনের বেঞ্চগুলো কোলকাতা থেকে আনানো হয়েছিল। পাহাড়িকন্যা নামক পাথরের মূর্তিটির এক হাত ভাঙা। হাতের কবজিটি স্বর্ণ দিয়ে বাঁধাই করা ছিল। এখানে রানির টি-হাউসটি অতুলনীয়।

উত্তরা গণভবন চত্বরে গোলপুকুর, পদ্মপুকুর, শ্যামসাগর, কাছারিপুকুর, কালীপুকুর, কেষ্টজির পুকুর নামে ছয়টি পুকুর রয়েছে। এছাড়া গণভবনের ভেতরের চারপাশে সুপ্রশস্ত পরিখা রয়েছে। প্রতিটি পুকুর পরিখায় সানবাঁধানো একাধিক ঘাট আছে। দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় পুকুরগুলো ভরাট হয়ে গেছে। ঘাট ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। প্রাচীন এই অবকাঠামোকে ঘিরে অজস্র আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, মেহগনি, পাম ও চন্দনাসহ দুর্লভ জাতের গাছ লাগানো ছিল। অযত্ন আর অবহেলায় ইতোমধ্যে অনেক গাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

প্রাসাদের পিছন দিকে রয়েছে ফোয়ারাসহ একটি সুদৃশ্য বাগান। এই বাগান রাণীর বাগান নামে পরিচিত। বাগানের এক কোণে রয়েছে প্রমাণ আকৃতির মার্বেল পাথরের তৈরি একটি নারীমূর্তি।

নামকরণ : ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর দিঘাপতিয়ার শেষ রাজা প্রতিভানাথ রায় ভারতে চলে যান। এ সময় থেকে দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি পরিত্যাক্ত অবস্থায় থাকে।  ১৯৫০ সালে জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন পাশ হওয়ার পর দিঘাপতিয়ার রাজ প্রাসাদটির রক্ষণবেক্ষণে বেশ সমস্যা দেখা দেয়। ১৯৬৫ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার রাজবাড়িটি অধিগ্রহণ করে। রক্ষণবেক্ষণের সমস্যা সমাধানে দিঘাপতিয়ার মহারাজাদের এই বাসস্থানকে ১৯৬৭ সালের ২৪ জুলাই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আব্দুল মোনায়েম খান দিঘাপতিয়ার গভর্নরের বাসভবন হিসেবে উদ্বোধন করেন। পরে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এক আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে এর নাম পরিবর্তন করে উত্তরা গণভবন ঘোষণা করেন।

উত্তরা গণভবন সংগ্রহশালা : সংগ্রহশালাটি ২০১৮ সালের ৯ মার্চ স্থাপিত হয়। উত্তরা গণভবনের পুরাতন ট্রেজারিভবনে স্থাপিত সংগ্রহশালায় বিভিন্ন রাজার আমলের অন্তত শতাধিক জিনিসপত্র স্থান পেয়েছে। এই সংগ্রহশালাকে রাজার আমলের শতাধিক দুষ্প্রাপ্য সামগ্রীর সমাহারে সাজানো হয়েছে। অতীতের সাথে বর্তমানের মেলবন্ধন তৈরি করেছে এই সংগ্রহশালা।

সংগ্রহশালার করিডোরে রাজা প্রমদানাথ রায় ও সস্ত্রীক রাজা দয়ারাম রায়ের ছবি আর রাজবাড়ির সংক্ষিপ্ত বিবরণ রয়েছে। করিডোরে মার্বেল পাথরের একটি রাজকীয় বাথটাব প্রদর্শন করা হয়েছে। ডানপাশের কক্ষে রাজার পালঙ্ক, ঘূর্ণায়মান চেয়ার, টেবিল, আরামচেয়ার আর ড্রেসিংটেবিল স্থাপন করে তৈরি করা হয়েছে রাজার শয়নকক্ষ।

বামপাশের দ্বিতীয় কক্ষে শোভা বাড়াচ্ছে রাজসিংহাসন, রাজার মুকুট আর রাজার গাউন। আরও আছে মার্বেল পাথরের থালা, বাটি, কাচের জার, পিতলের গোলাপ জলদানি, চিনামাটির ডিনার সেট।

এই কক্ষে লেখক গবেষকরা অনায়াসে লেখার উপাদান পেয়ে যাবেন রাজপরিবারের লাইব্রেরির বই আর শেষরাজা প্রতিভানাথ রায়ের ইন্সুরেন্সবিষয়ক কাগজপত্রের মধ্যে।

একটি কক্ষ রাজকুমারী ইন্দুপ্রভা চৌধুরাণীর। সুলেখক ইন্দ্রপ্রভাকে রাখা হয়েছে তারই পিতলের ছবির ফ্রেমে। আছে তার ব্যক্তিগত ডায়েরি, আত্মজীবনী, পাণ্ডুলিপি ও তার কাছে লেখা স্বামী মহেন্দ্রনাথ চৌধুরীর রাশি রাশি চিঠি।

দর্শনার্থীদের জন্যে ইন্দুপ্রভার লেখা বঙ্গোপসাগর কবিতাটি ফ্রেমে বাঁধাই করে দেয়ালে টানানো হয়েছে। ৬৭ লাইনের এই কবিতায় মুগ্ধ কবি বর্ণনা করেছেন বঙ্গোপসাগরের অপরুপ সৌন্দর্য।

করিডোর ছাড়াও সংগ্রহশালার দশটি কক্ষের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে দৃষ্টিনন্দন সব আসবাবপত্র। বিশেষ করে রকমারি সব টেবিল। এরমধ্যে ডিম্বাকৃতির টেবিল, গোলাকার টেবিল, দোতলা টেবিল, প্রসাধনীটেবিল, অষ্টভুজ টেবিল, চর্তুভূজ টেবিল, কর্নার টেবিল, গার্ডেন ফ্যান কাম টি-টেবিল ইত্যাদি।

দর্শনার্থী ও দর্শনের সময় : বর্তমানে এই রাজপ্রাসাদ দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে রাখা হয়েছে। এখানে প্রতিদিন গড়ে ১৫০-২০০ জনের বেশি দর্শনার্থী পরিদর্শনে আসেন। এদের মধ্যে বিদেশীরাও আছেন। দর্শনীর পরিমাণ ৪০ টাকা, ছাত্রদের জন্য ২০ টাকা। বিদেশীদের জন্য ১০০ টাকা। তবে সার্কভুক্ত দেশের দর্শনার্থীরা ৪০টাকাই টিকেট।

উত্তরা গণভবন নাটোরের জেলা প্রশাসক ও  বাংলাদেশ সরকারের গণপূর্ত বিভাগ পরিচালনা করে আসছে।

এই প্রাসাদে ঘুরতে আসার গ্রীষ্মকালীন সময়সূচি হলো বেলা ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। দুপুর ১টা থেকে ত্রিশ মিনিট মধ্যাহ্ন বিরতি। আর শীত কালীন সময়সূচি হলো সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা। দুপুর ১টা থেকে ৩০ মিনিট মধ্যাহ্ন বিরতি।

সূত্র- উইমেন নিউজ 24

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধবৃত্তে -কবি শাহিনা খাতুন‘এর কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধষোলটি শ্বেত-শলা -কবি এম আসলাম লিটন‘এর কবিতা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে