এই সে মোহনপুর আমার জন্মভূমি
স্বপন চক্রবত্তী
কেমন লাগে ফিরে আসতে! কেমন সে অনুভব! যে চেনা শহর একদিন বুকের একান্তে ছোট্ট এক দ্বীপ গড়েছিল, যে ভূমিতে একদিন হাঁটি হাঁটি পা’ চলা হয়েছিল শুরু, যার জলের সুবাস একদিন ছলছল উতল যমুনা আভাসে মন ও শরীরকে জাগিয়েছিল, কেমন দেখতে, সেই শহর, সেই ভূমিরূপ, সেই জলের পরশ আজ অনেক বছর পরে!
ফিরে আসা কেন, কেন ভাবা ফিরে আসার ভাবনা। কখনও কি ছেড়ে গিয়েছিল কেউ এই শহর, এই মাটি, এই জল! যে শরীর গড়া এই পেলব মাটিতে, যে জলে প্লাবন আজো আসে এই শরীরে, তার কোথাও কি আদৌ হয়েছিল যাওয়া, তার কি আদৌ চলে যাওয়া বলে কিছু হয়! তবে কেন মিছে ফিরে আসার ভাবনা! কেন তবে বিরহবীণার সুর মনের পরতে পরতে!
চলে যাওয়া ও ফিরে আসা, এ তো চিরায়ত জীবনেরই চক্র। এর থেকে মুক্তি কোন জীবের নেই। ‘ন হন্যতে’ যে জীবন, তার আর অন্য কোন গতি তো নেই। অন্য কোন নিয়তি নেই, নেই অন্য কোন পরিত্রাণ ! তেমনই চক্রের ফাঁদে তো সকল জীবেরই নিত্য যাওয়া আসা।
যখন মাটি ছুঁলো বিমানের চাকা, শরীরে সে এক তুমুল শিহরণ । যেন হলো নবজন্ম, এই মাটিতে অবতরণ নতুন করেই যেন, এই কি ফিরে আসার অভিঘাত! চোখ তুলে চেয়ে চেয়ে দেখি চিরচেনা সেই ভূমি, তার নতুন অবয়ব।
মায়ের নির্দেশে হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়েই এই আসা। মাও এলেন আমাদের সাথে। হঠাৎ সিদ্ধান্তের কারণে, তদুপরি চেনাজগতে একটা সারপ্রাইজ দেবার অবাক বাসনায় কাউকে জানানো হলো না তেমন করে। ভাবলাম, গিয়েই জানাব সবাইকে। কিন্তু মানুষের ভাবনার সাথে বাস্তব কখনও কখনও সাথ দেয় না!
ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছেই মনে হলো, দেশের অনেক পরিবর্তন হয়েছে । বিমান বন্দরটি বিগত আঠারো বছর আগের চেয়ে অনেকটা আধুনিকায়ন হয়েছে। একটা বিশ্বমানের ছোঁয়া দেবার চেষ্টা হয়েছে। যদিও তা’ সম্পূর্ণ হয়ে ওঠেনি। হয়ত হবে কোনদিন। এই যে ভালোর দিকে যাত্রা – এই বা কম কি!
ইমিগ্রেশনে এসে আবারও অবাক হলাম, অনেকটা শৃঙ্খলার ছাপ দেখলাম, অফিসারদের ব্যাবহার মার্জিত ও সুন্দর, গতবারের অভিজ্ঞতা বড়ই তিক্ত ছিল! এবারে কোন হুজ্জোত ছাড়াই নির্বিঘ্নে সবাইকে নিয়ে ইমিগ্রেশনের বেড়া ডিঙিয়ে পার হয়ে এলাম। ছোটভাই নিতে আসার কথা। খুঁজে দেখি, সে এসে তখনও পৌঁছায়নি। ভোর পাঁচটা, এইসময়টা আরামে ঘুমানোর সময়, কারই বা উঠতে ইচ্ছে করে! আমারও ইচ্ছে করে না। কিন্তু আমাকে প্রতিদিনই ভোর চারটেয় বিছানার মায়া ছাড়তে হয় জীবিকার কল্যাণে!
ছোটভাইয়ের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম। ফোনগুলো একটাও কাজ করছে না। নতুন সিস্টেম কি হবে তাও বুঝতে পারছি না। বিমানবন্দরেরই একজন সিকিউরিটি গার্ড বললেন, ‘ঐ যে কোণায় একটা ফ্রি কল করবার ফোন আছে, ওখান থেকে সব জায়গায় ফোন করতে পারবেন’।
বাহ্ , আমার মত পথ হারানো মানুষের জন্যে ভালোই ব্যবস্থা, খুবই জরুরী একটি ব্যবস্থা। ফোনের কাছে গিয়ে দেখি, একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক ফোনে কথা বলছেন ভারী নরম স্বরে ! কানে এলো, তাঁর কথোপকথন, তিনি তাঁর মায়ের সাথে কথা বলছেন। তাঁর কথা শেষ হলে আমি ফোন করলাম।
ভাই এলো হন্তদন্ত হয়ে । তার সাথে চলে এলাম ডোমেষ্টিক এয়ারপোর্টে। এবার অপেক্ষা আমাদের বিমানের সময় হবার। বিমানের সময় সকাল ১০:৩০ টা। লক্ষ্য করলাম প্রচুর বিদেশী এই ওয়েটিং রুমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। আমাদের যাতে কোন রকম অসুবিধা না হয় আপ্রাণ চেষ্টা আমার ভাইটার। মেয়েদের জন্যে নানারকম খাবার, জুস, ড্রিঙ্ক কিনে আনছে, ক্ষণে ক্ষণে জিজ্ঞেস করছে কিছু লাগবে কিনা।
বিমানের সময় হলো, একটা ভ্যানে বিমানের কাছে এলাম। দেখলাম বেশ কিছু এয়ারলাইনের বিমান দাঁড়ানো। আমরা যাব রিজেন্টস এয়ারলাইনের বিমানে চট্টগ্রামে। তুখোর সুন্দরী সব বিমানবালা যাত্রীদের অভ্যর্থনা করলেন বিমানে, সিট দেখিয়ে দিলেন। তাঁদের পরিষেবার মান কোন অংশে বিদেশী এয়ারলাইনের চেয়ে কম নয়। অপূর্ব ইংরেজী উচ্চারণ। মধুর বাংলায় অভ্যর্থনা। দেখেশুনে মনটা বেশ ভাল হয়ে গেল। মনের উপরে একটা পরিতৃপ্তির আবেশ এলো- যাক, দেশটায় অনেক পরিবর্তন হচ্ছে, এবং, তা’ ভালোর দিকেই।
বিমান উড়লো – মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ফ্লাইট। এরমধ্যেই স্ন্যাকস দেয়া হলো ॥ আমার দরকার ছিল জল। জল পেয়ে এক ঢোকে সবটা খেয়ে নিলাম। তৃষ্ণা তবু যেন গেল না। খুবই ছোট্ট সে জলের বোতল। আমের জুস ও দিয়েছে সাথে, কিন্তু সেই আমের জুসে আমার আস্থা নেই। এর আগে দেশেরই নানান নিউজ চ্যানেলে দেখেছি, এমনকি ‘প্রাণ’ এর মত কোম্পানীর আমের জুস বানানোর ভয়াবহ প্রক্রিয়া। জুস তো নয়, বিষ। আর তেমন সব বিষের প্রতিক্রিয়াতেই এখন দেশের ঘরে ঘরেই নানা রোগের প্রকোপ। দলে দলে লোক ভারতে যাচ্ছেন চিকিৎসার জন্যে। আমাদের দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার মান এখনও আপামর মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেনি।
ভাবতেই ভাবতেই বিমানচালকের ঘোষণা এলো, আমরা চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে নামতে যাচ্ছি । সারা শরীরে একটা শিহরণ বয়ে গেল। আমার বড় মেয়েটা কিছুটা আঁচ করে বলল, তুমি ঠিক আছো বাবা? ইশারায় ওকে বললাম, ঠিক আছি।
আসলে কি আমি ঠিক আছি? আমার হাতেই আমার বাবার দেহভস্ম! বাবাকে আর সশরীরে স্বদেশে ফিরিয়ে আনতে পারলাম না, এই অপরাধবোধ আমাকে দংশন করছে প্রতিনিয়ত। বাবার একানব্বই বছরের শরীরটা এতটাই খারাপ হয়েছিল যে, ডাক্তারের অনুমতি ছিল না বিমানে ফ্লাই করবার। শেষদিকে বাবা খুব পাগলামি করেছিলেন দেশে ফিরে আসার। কিন্তু উপায় ছিল না।
তবু, বাবারই দেহ ভস্ম নিয়ে এসেছি সাথে, স্বদেশের মাটিতে, নিজের জন্মভূমিতে। যেই মাটিতে এই শরীর গড়া, সেই মাটিতেই! এই সেই মোহনপুর, আমার জন্মভূমি, আমাদের মাতৃভূমি! বীরভোগ্যা চট্টগ্রাম !
Advertisement