কোন একদিন
কবি চন্দনা রায় চক্রবর্তী
জানলার পাশে একটা বুড়ো আমগাছ
আর তার পাশে খোলা পথ, ভীষণ ভীষণ দামী।
পথ বরাবর অপেক্ষা করে আছে ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরীর
বিকেল কিংবা সরস্বতী পুজোর কুঁচো হলুদ।
একজোড়া অবাধ্য পায়ের পাতা ওদিকে হেঁটে গেলেই
দু’চোখে হাত চাপা দেই।
আঙুল জুড়ে ঝিরঝির করে নামে স্পর্শ।
বিকেল হয়ে এলো…
এখন বিনুনি বাঁধার সময়। কানের পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা বেনামী চুলের গোছা হাওয়ায় উড়ে যায়।
গল্পের চরিত্ররা যখন ভেঙে পড়ে, সাত মহলা বাড়ির
সদর দরজায়ও মেঘ জমে। বৃষ্টির জল তখন নোনতা।
বিকেল একটু গড়ালেই অভিমানী পায়ের পাতা দুটো জমে কাঠ আর চৌকাঠের নাভি বরাবর উঠে আসে প্রান্তিক শূন্যতার আলো আধারী।।
বিশেষ অতিথির জন্য
কবি চন্দনা রায় চক্রবর্তী
ভেতর বাড়ি অবধি ঘুরে আসলাম।
তবু তোমার দেখা পেলাম না।
আধখানা চাঁদের বিনিময়ে আজীবন নদী লিখে দেবে,
এমনটাই কিন্তু কথা হয়েছিল!
কথার শিকল ছড়িয়ে তোমায় অনুভব করেছি বহুবার।
কিন্তু অসময়ের সুরঙ্গ থেকে ভেসে আসা সারি সারি মৃতদেহ শুধু দুরত্বই বর্ণনা করেছে।
আজকাল সন্ধ্যা নামলে তারার পিঠে তারা বুনি।
অলিক নেশার কড়ি দিয়ে ভবিষ্যৎ কেনার খেলা খেলি।
তবে অনেক তো ছল হয়েছে, এবার সরলতার শব্দে এসো।
তোমার জন্য প্রতিটি শব্দ সরল করে শবদেহ করে ফেললাম। তবু তোমার দেখা নেই।।
ছায়া
কবি চন্দনা রায় চক্রবর্তী
ছায়ার একটা নিজস্ব অনুরণন আছে।
আর আছে, আজন্ম কুয়াশার একাদশ সিঁড়ি।
সমান্তরাল ইচ্ছের চাবিকাঠি দিয়ে,
সিঁড়ির এক একটা ধাপ খুলতে গেলে,
ঘরের বোতাম ছিঁড়ে, বিষন্ন হাওয়ার
একটা ঢেউ, পাকদণ্ডী বেয়ে নেমে এলো।
ঝিনুকের বুকে মেঘের নোঙর করার যে পংক্তি
সেখানে দাঁড়ালে,
নিজের শেকড়কে মুলতুবি পর্যন্ত চেনা যায়।
একপশলা বৃষ্টির সঙ্গে আশনাই সম্পর্ক গুলো গাছেদের মতোই মেহনতি।
শূন্যতার সোহাগী জ্বরে পুড়ে পুড়ে,
রোজ বিকেলে টিলার ওপর ঠায় দাঁড়াই
একান্তই ছায়ার অপেক্ষায়।।
কথা
কবি চন্দনা রায় চক্রবর্তী
আজকাল আর তেমন করে কথা আসে না।
আঙুলে আঙুল জড়িয়ে , বুকে মুখ গুঁজে
আমি যে ওদের বড্ড ছুঁতে চাই।
তবু ওরা মেঘপাখি……
হলুদ প্যাস্টেলে বিকেলের দ্বিরাগমন খানিকটা
কি ঝাপসা? চড়াইয়ের গায়ে ঝুটা দিন মনমরা। আঁকাবাঁকা ঢেউয়ের প্রহর কবিতা নিরাময়ে অনর্থ।
তবু, কারা যেন অক্ষরের মতো ছায়া শরীরে
দ্রুত, অতি দ্রুত শব্দের লোভ দেখায়। আমি
বন্ধ চোখের পাতায় হাতড়াই। শব্দ……?
…….কোথায় শব্দ?
কথার ঝাঁপতাল মিহি থেকে অবয়ব। শূন্যতার
নাড়া বাঁধা ঠুংরি প্রাণ পায়……..
…..বড়ো সাধ করে অনামী এক নদী জন্ম নেয়।
ঢেউয়ের অভিধানে যার নাম নেই।
……ঘুমের পাহারায় সবার অলক্ষ্যে আমি
ওর নাম দিই ‘কথা’।
নকল মুখ
কবি চন্দনা রায় চক্রবর্তী
তোমার নামে নাকি আজকাল ছায়া পড়ে না!
অথচ তুমি নিজে এক প্রকান্ড ছায়ায়
নিজের নামে আছড়ে আছো।
ক্রমশঃ ফুলে ফেঁপে উঠছো।
ক্লীব হয়ে যাচ্ছে তোমার আসল মুখ।
তোমার নকল জল্পনায় শহর কাঁপে।
অথচ শহরের নিরালায় তুমি একাকীত্বে কাঁপছো।
মুখোশ আর মুখগুলো পিঠোপিঠি হতে হতে
তোমার শীতল সর্বাঙ্গে সাপের মতো কিলবিল করে।
তখন তোমার ধুম জ্বর।
শহরের বিষ লহরী বাতিস্তম্ভ গুলো
এখন ক্রমশ নদীর দিকে সরে যাচ্ছে।
আরো কিছু পড়ে তোমার বিনিদ্র চুল্লিতে
আগুন জ্বালাবার কোন শব্দ থাকবে না।
বর্ণপরিচয়হীন একটা দীর্ঘশ্বাস শুধু চাবির সন্ধানে
মর্গের দেওয়াল গুলো হাতড়ে বেড়াবে।।
কয়েকটা ঘর
কবি চন্দনা রায় চক্রবর্তী
ও বাড়িতে বেশ কয়েকটা ঘর ছিলো
আবছা হয়ে আসা একটা অস্পষ্ট সংসারও ছিল।
বাড়ি বদলে যায়…
নিশি পাওয়ার মতো, ঘরগুলোর মায়া পিছু ছাড়ে না।
প্রলাপের মতো সুখ, হাট করে রাখা দুঃখ,
তেজপাতা রঙের মিয়ানো অভিমান—
এসব কিছু নিয়ে ঘরগুলো আজকাল
বড্ড বেশীই পিছু নেয়।
রোদের ছায়া পড়ে আসে, আর দীঘল এক একটা ঘর
এক একটা সুখদুঃখের মুখোশ হয়ে
আমার হাড়-পাঁজরে লেপটে যায়।
ওদের ধ্বসে পড়া পিঠ, শেওলা ধরা চিবুক,
কুসুম রঙা সিঁথি বরাবর ‘আমার’ অবয়ব উঠে আসে।
আমার শরীরের আড়মোড়া ভাঙে
ওদের নড়াচড়া , ওদের গল্প করা, তার মাঝেই আমি…
আজকাল সন্ধ্যা হলেই প্রাণপণে ঘরগুলোকে খুঁজি
ওরাও হন্যে হয়ে খোঁজে আমাকে।
এবার শীতে বুকের ব্যথাটা তাই বোধহয় আরও
জাঁকিয়ে বসেছে।।