গল্প প্রিয়র প্রেম- রত্না চক্রবর্তী’র ছোটগল্প

0
503
Ratna

ছোটগল্প
গল্প-প্রিয়র প্রেম
রত্না চক্রবর্তী

সুপ্রিয় আর প্রেমা বিয়েটা ছিল লাভ ম্যারেজ কিন্তু পরবর্তীকালে মনে হয়েছে লাভ বিশেষ হয়নি সবই লোকসান হয়েছে। মনের দিক থেকেও, আর সংসারের দিক থেকেও। তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছিল সাতবছরের মধ্যেই। একঘেয়ে গতানুগতিক জীবনে বিরক্ত অসন্তুষ্ট। সেটা এত বেশি প্রকট হয়ে উঠছে যে বোঝাই যেত না ছয়বছর আগেও একজন অপরজনকে ছাড়া থাকতে পারত না।
সুপ্রিয় রাজারহাটে অফিস। সকালবেলা আটটা পনেরোর বাস ধরে যেতে হয়, উঠতে হয় অনেক সকালে এত সকালে ওঠা তার অভ্যাস ছিল না। কিন্তু বউয়ের স্কুলের কাছাকাছি বাড়িতে নিয়ে মহা বিপদ হয়েছে অফিসের দূরত্ব বেড়ে গেছে। উল্টোদিক থেকে রাজারহাটের কাছাকাছি জায়গায় বাড়ি নিতে গেলে যে ভাড়া পড়বে তা দেবার ক্ষমতা নেই অবশ্যই। বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে দশটা। প্রাইভেট জব বলে তাদের মর্জিমাফিক ফেরত আসা। যাওয়াটা অবশ্য গাড়ির জ্যাম এড়িয়ে যেভাবে পৌঁছে দেবে সেই ভাবেই পৌঁছাবে। ফেরার সময় তার উপর রেগুলার হোয়াটসঅ্যাপে লিস্ট পাঠায় প্রেমা… এটা এনো, ওটা এনো, এখানে এটা সস্তা পাওয়া যায় সেখান থেকে নিও…. মাথাগরম হয়ে যায়। প্রেমা একটা প্রাইভেট স্কুল টিচার, মাসের মধ্যে কত দিন ছুটি তার ঠিক নেই। শনিবার ছুটি.. রবিবার ছুটি.. গরমের ছুটি.. পূজোর ছুটি, শীতের ছুটি.. রাজার চাকরি! ও তো বসে বসে মাইনে! নিজে করে নিতে পারে না। এ নিয়ে রোজ কিচকিচ।

প্রেমার ভীষণ বিরক্ত লাগে। প্রতিটি কাজ তার ঘাড়ে চাপে। আটটা থেকে রাত সাড়ে দশটায় বাড়ি ফেরে বলে কোনো কাজই সুপ্রিয় করবেনা। কোথায় রেশন কার্ড করাতে হবে, কোথায় পোস্ট অফিসে টাকা তুলে বাবাকে পাঠাতে হবে, রেশন কাজের লোককে দিয়ে আনাতে হবে, গ্যাস বুক করতে হবে, ইলেকট্রিকেত বিল টাইমে দিতে হবে, শালকরে সুপ্রিয়র জামা কাপড় ইস্ত্রি করতে দিতে হবে আবার আনতেও হবে। অসুখে যদিও বা একদিন হাফডে করে নিজে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে উদ্ধার করে কিন্তু ডাক্তারের রিপোর্ট পর্যন্ত তাকে গিয়ে দিয়ে আসতে হয়। তার স্কুল আছে খাতা তৈরী করা আছে । সবসময় ‘ বসে থাক বসে থাক ‘যে শোনায় সকালে যে খাবারটা খায়, টিফিনটা নিয়ে যায়…. সেটা কে করে দিয়ে যায়? অফিস আছে বলে শুধু হাত দুলিয়ে, টাই ঝুলিয়ে, ডিও ছড়িয়ে গটগট করে জুতো পালিশ করে বেরিয়ে যাও। আমাকে তো রান্না টিফিন সমস্ত করে দিয়ে যেতে হয়। কাজের লোক আছে ঠিকই, সে বাসন মাজে, ঘর মোছে কাপড় কাচে, তাও সব কাপড় তাকে দিয়ে কাচানো যায় না। কিছু ভালো কাপড় আছে নিজে যত্ন করে না কাচলে খারাপ হয়ে যাবে। এছাড়া সামাজিকতা রাখা, বাড়িতে লোকের আসা যাওয়া… কত যে ঝামেলা বলে বোঝানো যাবে না,বাজারদোকান টাও তো করতে হয় । অফিস থেকে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে একটু গরম জলের ব্যবস্থা রাখা কারণ ফিরে সুপ্রিয়র গা ধোওয়া অভ্যাস। প্রেমাকে তো বাড়ি ফিরলে কেউ মুখের কাছে গরম চা ধরবে না, সেও তো স্কুল করে আসে। বাচ্ছাদের পিছনে চেঁচাতে চেঁচাতে গলা ব্যথা হয়ে যায়। অত রাতে আবার চা করে দিতে হয়। খেতে বসে সোয়া এগারোটায়। শুতে শুতে রাত বারোটা তো হয়ই। এরমধ্যে যদি এত কথা শোনায় সহ্য করা সম্ভব? তার বোনেরা বরের সঙ্গে কত জায়গায় বেড়াতে যায়, আর সে? ছ্যাদ্দের অফিস ছুটি নেই… রাগে গজগজ করে প্রেমা. জীবনটা জ্বালিয়ে দিল তাও আবার যদি একটু ভালো মুখে কথা বলত তো সইত। প্রেমার জন্মদিন সুপ্রিয়র মনেই থাকে না, উপহার তো দূরের কথা। অফিসের চাপের অজুহাত কাঁহাতক সয়? পরে অবশ্য টাকা দিয়ে দেয় কিছু কিনে নিতে, সে উপহারের কোন মানে নেই। প্রেমা তো সুপ্রিয়র জন্মদিন ভোলে না। যেমন করেই হোক একটু পায়েস, কেক আর মাছের মাথাটা রেঁধেই দেয়। বিরক্ত ধরে গেল এ জীবনে। রোজ সিরিয়াল দেখা নিয়ে খোঁটা। আরে বসে বসে কবে আর সিরিয়াল দেখে প্রেমা? নয় ভাতের থালা নিয়ে বসে দেখে, নয় আটা মাখতে মাখতে দেখে, নয় সবজি কাটতে কাটতে দেখে তাও রাতের বেলা। সকালের সব্জি রাতেই কুটে রাখে। সকালবেলা সময় হয়না । তাতেও কথা… “কাজ আর কি করো বসে বসে সিরিয়াল দেখ আর বাড়িতে আরাম করে শুয়ে বসে থাকো… ” মাথা গরম হয়ে যায়। ভালো কথা মুখ দিয়ে আর বেরোয় না। তাই সুপ্রিয় এখন আর প্রিয় নেই অপ্রিয় আর প্রেমার প্রেম কবে যেন উড়ে গেছে তা সুপ্রিয় বলতে পারেনা।

যে কথা পৃথিবীর কেউ কখনো ভাবেনি সেই ঘটনাটাই ঘটলো। যে সুপ্রিয়র অফিসে একদিনের ছুটি ও মিলত না সেই সুপ্রিয়র অফিস আজ এক মাসের অনেক বেশি হয়ে গেল বন্ধ। লকডাউন!! প্রথমদিকে মন্দ লাগেনি যদিও একটা চাপা ভয় ছিল। কিন্তু ক্লান্ত শরীরটা যেন বিশ্রাম চাইছিল। ওদের জীবনযাত্রা বদলে গেছে। একটু বেলা করে ঘুম থেকে উঠে। খাবার দাবার চাল আটা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিছুটা কিনে রাখা আছে। এছাড়া সুপ্রিয় এখন দুদিন ছাড়া একবার মুখ বেঁধে বাজার যায় যাতে টাটকা শাকসবজি আনা যায়। এখন একটু সময় বেড়েছে সকালের দিকটা সুপ্রিয় গান চালায় ঠিক আগে যেমন চালাতে। ধীরেসুস্থে স্নান করে রোজকার পাউরুটির বদলে ময়দা মেখে কিছু একটা করে প্রেমা। তরকারি বা ভাজা দিয়ে দুজনে বসে খায়। একটু সময় পাওয়া যাচ্ছে ফলে এই ছুটিতে খাওয়া-দাওয়া ভালোই চলছে। অল্পে চালাতে হবে জিনিসপত্র পাওয়া যাবেনা তাই একই আনাজকে প্রেমা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নানা পদ করে রাঁধছে। এত ভালো তৃপ্তি করে বাড়িতে খাবার সুখ অনেক দিন চলে গেছে সুপ্রিয়র। তাই এখন খুব আরাম করে খায়। ভালো হয়েছে কথাটা বলতে নেই… বৌএর তেল বেড়ে যাবে তাই বলে “পরশুর যে তরকারিটা করেছিলে ওটা আর একদিন করো। কি কি আনতে হবে বলে দিও আমি গিয়ে নিয়ে আসবো।” প্রেমা এইটুকুতেই আহ্লাদিত হয়। প্রেমা বলে “আচ্ছা আমিই নিয়ে আসব, এখন তো ছুটি আছে। ” হাঁ হাঁ করে ওঠে সুপ্রিয়” না না তোমার একটু টান এর ধাত আছে , এখন যদি বাড়ে সর্বনাশ! আমি নিয়ে আসব তোমায় আনতে যেতে হবে না। তুমি মোটে বাড়ির বাইরে বার হবে না।”
কথাটার মধ্যে শুধু কি ভয় ছিল? না তার থেকেও বেশি কিছু ছিল! সেই প্রথম প্রেমের মতো আবেগ নয় কিন্তু কিসের একটা টান যেটা সেই আবেগের চেয়েও ঘন। বাড়িতে কাজের লোক আসবে না তাই একটু কাজ বেশী পড়েছে। সুপ্রিয়র জামাকাপড়গুলো কেচে দিতে যায় প্রেমা কিন্তু সুপ্রিয় আপত্তি করে এত জামাকাপড় পাটভাঙ্গার তো কোন দরকার নেই। আমি তো আর বাইরে যাচ্ছি না পাজামা, বারমুডা গেঞ্জি যা আছে ও আমি চানের সময় ধুয়ে নেব। ঘর মোছা কাজটা আমি পারবো না কাজেই তুমি এদিকটা দেখো। হেসে ফেলে অনেক কাল বাদে প্রেমা, ঝকঝকে হাসি মুখ ” কি দারুণ দেখাবে ভাবছি তাই, তুমি তোমার ভুঁড়োপেট নিয়ে বারমুডা পরে হামাগুড়ি দিয়ে ঘর মুচছো! কেমন দেখাবে বল? “ওরা দুজনেই হাসতে থাকে। প্রেমা চা একটু ঠান্ডা করে খায়, সুপ্রিয় গরম গরম চা খায় বলে চা খাওয়া আগে শেষে হয়। সুপ্রিয় উঠে গিয়ে চায়ের কাপ ডিস বাসন ধুয়ে রাখে। তখন প্রেমা পুরনো সিরিয়াল আবার নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখছে মোবাইলে । এ ছাড়া নানা রকম গল্প করে প্রেমা। দুশ্চিন্তা এবার একটু হচ্ছে, এমাসে মাইনে হবেনা, মেরে দেবে না স্কুল কিন্তু দুমাস বাদে দেবে। এইসব স্কুল ছাত্র-ছাত্রীর মাইনেতেই চলে, তারা কেউই দিতে পারবে না বলে মাইনে হবে না।
সুপ্রিয় আশ্বাস দেয় “আমারও মাইনে হবে না পুরোটা, কোম্পানি বলেছে প্রত্যেককে হাফ সেলারি দিয়ে দেবে, তারপর বাকিটা র ব্যবস্থা করবে। আমাদেরও তো বিজনেস হচ্ছে না। টাকা দেবে কোথা থেকে? তবে তুমি চিন্তা করোনা আমি গন্ডগোলের আসবে তার হাওয়া বুঝে রেকারিং দুটো জমা দিই নি। সেটাই ঘরে রাখা আছে। তোমাকে আর জানায়নি। এসব নিয়ে ভেবো না। আমরা তো যথেষ্ট সাবধানে চলছি, কমে চালাতে চেষ্টা করছি, গাড়িভাড়াটা লাগবে না…. এখন সুস্থ থাকাটাই সবচেয়ে বড় কথা। এরই মধ্যে একদিন দুপুরে প্রেমার মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়। ওর মাইগ্রেন আছে। মাঝে মাঝেই এমন হয়। ঘরে ওষুধ কেনা থাকে। সেদিন সুপ্রিয় খুব মজা করে বলে তোমার ইউটিউব দেখে আমিও রান্না করতে পারি। আজ তোমায় চাউ করে খাওয়াবো, খেয়ে দেখো দোকানের থেকেও ভালো হবে। আর বাঁধা দিতে পারে না প্রেমা। সুপ্রিয়র মুখ সত্যিই আনন্দে উদ্ভাসিত। সারা রান্নাঘর নোংরা করে, প্রয়োজনের বেশি তেল খরচ করে কিন্তু ফাটাফাটি বানায় চাউটা। দুজনে খুব আনন্দ করে খায়। রান্নাঘরের এ অবস্থা দেখেও রাগ হয় না প্রেমার। এর মধ্যে একটা এমন মমতা ছিল যে অনেক কাল বাদে চোখে জল এসে যায় প্রেমার।
আজকে প্রেমার জন্মদিন । এবছর কারোরই জন্মদিনের কথা মাথায় নেই। সকালবেলা সুপ্রিয় বাজার গিয়েছিল ফেরার সময় একটা ডান্ডাওয়ালা ঘরমোছার মপ কিনে এনেছে। প্রেমার ওভারি অপারেশন করে বাদ দেওয়া হয়েছে বছর কয়েক আগে। নিচু হয়ে ঘর মোছা ওর পক্ষে খুবই কষ্টকর। হাসতে হাসতে সুপ্রিয় বলে এটা তোমার জন্মদিনের প্রেজেন্টেশন কেমন হলো দেখো। এছাড়া বাজার খুঁজে পেতে চিংড়ি মাছ আর ভেটকি মাছ নিয়ে এসেছে। দুটোই খুব প্রিয় প্রেমার। প্রেমা কেমন যেন বিহবল হয়ে তাকায়। এ পাওনা যেন গয়নাগাটি শাড়ি চেয়েও অনেক বেশি দামি। ব্যস্ততা আর প্রয়োজন তাদের জীবনটাকে নিংড়ে নিয়ে নিয়েছিল। এই কদিনের বিরতিতে লকডাউন তাদের হারানো প্রেম ফিরিয়ে দিয়েছে। সুপ্রিয়র প্রেমা, আর প্রেমা সু প্রিয়।।

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধমানুষ আবার একটু ভাবো- শ্যামল বৈদ্য’র কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধঅনলাইন শপিং হোম ডেলিভারি পেতে ফোন করুন এখনই

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে