পাঁচু কাকার প্রেম -দেবাশীষ সরকার‘এর গল্প

0
364
Debashish Sarker

দেবাশীষ সরকার : রেল স্টেশেনের উত্তর প্রান্তে পাঁচু কাকা আর শর্মীষ্ঠা দুজন দাঁড়ায়ে আছে। কিছু মূহুর্ত পরে নিরবতা ভেঙে নারীটি বলতে শুরু করে- দেখো পঞ্চানন আমি তো সেই দ্বীপাবলী চরিত্রের মায়া ছেড়ে আর বের হতে পারলাম না। নিজের সাথে সংঘাৎ যে হয়না তা নয়! যদি বলো নারীত্বের সাথে যুদ্ধও তবু আজ কিছু বলবো না। তুমি তো উপন্যাসটি হাতে তুলে দিয়েই মুক্তি নিলে, কিন্তু আমাকে একা নামিয়ে দিলে এক ভয়ংকর জয়ী জীবনের সংগ্রামে।

একটা উপন্যাসের কোন চরিত্র একটি জীবনকে এভাবে পাল্টে দিতে পারে নিজেকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না! এইটুকু বলেই থামলেন শর্মীষ্ঠা। কিন্তু পঞ্চানন কি শুনছেন তার কথা? সেই তার দিকে তাকিয়ে উদাস! নাহ তার চোখের দিকে তো নয়! মুখের বালিরেখা কি খুঁজছে সে? নাকি কতটা বয়সের ছাপ পড়েছে মুখে তা দেখছে পঞ্চানন! নিজের চিন্তায় নিজেই হেসে ফেলে শর্মীষ্ঠা।শব্দও হয় হাসিটায় অযথাই।

সে হাসির শব্দে সম্বিৎ ফিরে পায় যেন পাঁচু কাকা। বলে উঠতে যাবে – তোমার হাসিতে এখনো ব্যার দাঁত দুটো বের হয়, গালে টোলও পরে দেখছি এখনো। কিন্তু বলতে জিহবা আড়ষ্ট হয়ে পরে। এবার শর্মীষ্ঠা বলে -তুমি কি বলতে গিয়ে থেমে গেলে তা বুঝতে পারলাম পঞ্চানন! কিন্তু কেন? ওই যে তুমি একটু আগে বলছিলে সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন উপন্যাসের দ্বীপাবলী চরিত্রের মায়ায় জড়িয়ে আছো, জীবন তোমার আজ দ্বীপাবলীময়। সেই ব্যক্তিত্ব আমাকে নিষেধ করলো বলতে।

এমন সময় স্টেশনের বস্তির কিছু ছোট ছোট ছেলে মেয়ের দল বিশ্বকাপ ফুটবলের উন্মাদনায় বিভিন্ন দেশের পতাকা হাতে নিয়ে ছুটোছুটি করতে করতে ওদের পাশ দিয়ে স্টেশনের ভিরে মিলিয়ে যায়। দুজনেই ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। পঞ্চানন বলে- আচ্ছা শর্মিষ্ঠা যে ছেলেটা কিছুক্ষণ আগে মায়ের পেছন পেছন ক্ষুধায় কাতর হয়ে ঘুরলো খাবার পেলোনা তার তো ক্ষুধা মিটলো না, কিন্তু দেখো সবার সাথে নিশান নিয়ে হাসতে হাসতে নাচতে নাচতে যে আন্দের ঝিলিক চোখে মুখে মিলিয়ে গেলো স্টেশনের ভিরে।

এইটাকে তোমার ব্যখ্যায় কি বলবে? প্রয়োজন আর আনন্দকে কি ভাবে ভাগ করবে তুমি? কৌতূহলী মানুষের দৃষ্টি বাড়ছে ওদের দিকে তা লক্ষ করে এবার কোন কথা না বলেই দুজনে স্টেশন থেকে বের হবার পথ ধরলো। স্টেশনের বাহিরে রাখা গাড়িতে দুজন পেঠনের সিটে উঠে বসলো। শহরের রূপ চেনাই যায় না! কতোদিন পর এলাম না পঞ্চানন? হ্যাঁ ছোট্ট উত্তর পাঁচু কাকার। চারেদিকে উন্নয়নের ছোঁয়া। রাস্তাগুলো মোটা হচ্ছে। ওদিকে সরকারী কর্মকর্তার উন্নয়নের কথায় বাঁকা হাসি কাকুর চোখে।

গাড়ির কাঁচখোলা জানালা দিয়ে কিছু সময় পরেই শহরের কোলাহল ছেড়ে উন্মুক্ত মাঠ আর গাছগাছালি দেখা যাচ্ছে। দ্রুত চোখের আড়াল হচ্ছে সব কিছু। শর্মীষ্ঠার কৈশোরের দিন গুলোর কথা মনে পরতে লাগলো। কোন এক আত্মীয়র বিয়েতে গ্রামে বেড়াতে গিয়ে প্রথম পরিচয় পাঞ্চাননের সাথে। তখন পঞ্চানন সদ্য যৌবনে পদার্পন করেছে অথচ কৈশোরের ছোঁয়া থেকে মুক্ত হয়নি।

কি যেন এক বীর সেজে থাকা ভাব চোখে মুখে। তার পর আবার বছর ৫ পর এইচএসসিতে পড়বার সময় সিনিয়র রুমমেটের বন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়ে নতুন করে দেখা পঞ্চাননের সাথে। সেই দেখার সম্পর্কই জীবনের সাথে কি করে জড়িয়ে গেলো কখন বোঝাই হলো না। কি নাম দেওয়া যায় এই সম্পর্কের কে জানে? পঞ্চানন তো সংসারি মানুষ, বৌ ছেলেপুলে নিয়ে হয়তো সুখেই ঘর করছে!

নইলে এতো গোছালো এতো পিটপাট। অর্থ কিংবা সম্মান নিজের মতো করেই ভাবে পঞ্চানন। অন্যে কি ভাবে তা নিয়ে কোনদিন মাথাব্যথা ছিলো না আজো হয়তো নেই। অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাও নিজের মতোকরেই ভাবে। শর্মীষ্ঠার খুব দুঃসময়! নাহ্ দুঃসময় কি বলা যায় ওকে না তা নয়, ছন্দ পতন বলা যায়। সেই সময় পঞ্চাননের সার্পোট বিশেষ করে মানসিক দৃঢ়তা তৈরীতে কাজ করেছিলো, সেই ঋণ – ই কি বয়ে বাড়াচ্ছে শর্মীষ্ঠা?

ভাবতে গেলেই হাজারো প্রশ্নে নিজের কাছে নিজে জর্জরিত হয় সে। সেই একদিন আবেগময় মুহুর্তে নিজের সংযম হারানোর আগেই হয়তোবা নিজের ব্যাগ থেকে সাতকাহন লেখা একটি উপন্যাস হাতে ধরিয়ে দিয়ে পঞ্চানন বলেছিলো, এটা পড়ো এক মনে সময় নিয়ে। সব কাজ ভুলে যাও। পড়া শেষে দেখা হবে আমাদের।
পড়লাম,পড়লাম আবারো পড়লাম, দ্বীপাবলী তখন গেঁথে গেলো জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে।

আর নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে নিজেই দ্বীপাবলী হয়ে উঠলাম। আজকের এই শর্মীষ্ঠা হয়ে উঠার পেছনে কি পঞ্চাননের কোন ভুমিকা আছে! হয়তো আছে, হয়তো নেই! তবু এক অজানা টান হৃদয়ের গভীরে বাজে, নাহ্ এটাকে ভালোবাসা বলা যায় না। কিন্তু যদি সেদিন পঞ্চানন আমাকে বইটি না দিয়ে আমার আবগকে পশ্রয় দিলে ওরতো ক্ষতি হতো না! পাল্টে গেলো তো শুধু আমার জীবন!

এর পর পঞ্চাননের দিকে তো তাকাতেই পারিনি, কেমন ছিলো ও! কেমন থাকতো ও! কি কথা বলতো আমাকে! কতশত কথা হয়তো বলতো আমায়! কতো কবিতার লাইন, দর্শন, জীবন, কতো উপমা, সব কিছু ছাপিয়ে সত্য হয়ে দেখা দেয় দ্বীপাবলীর জীবন। প্রচন্ড সংগ্রাম করে ছিনিয়ে নিতে হবে নিজের স্থান। প্রিয় মানুষগুলোর পঙ্কিলতা তখন গৌন। হয়তোবা ভালোবাসাও!

বিসিএস পরীক্ষায় টিকে যাওয়া, যোগদান, কাজ কাজ আর কাজ যোগ্যতা আর লাড়াই শেষে বেশ কয়েকটি প্রমোশন। জেলার অন্যতম বড় কর্মকর্তাদের একজন আজ সে। কিন্তু কখনো কখনো বড় একা আর নিঃসঙ্গ মনে হয় নিজেকে। আর দশটা মেয়ের মতো তারও তো একটা ছোট্ট সংসারের স্বপ্ন ছিলো! ঘোমটা দিয়ে কোন ঘরের বৌ হতে কি তার স্বপ্ন ছিলো না! ছিলো তো।

কোথায় আজ তা! হাজারো কাজ আর হাজারো মানুষের সমস্যার ভিরে নিজের সমস্যা নিয়ে ভাবনার সময় কোথায়! একটা সময় বাবা -মা বলতো বিয়ের কথা। মা মারা যাবার পর বাবা চেস্টা করেছিলো হয়তো। কিন্তু আজ আর কেউ ওর গম্ভিরতার কাছে বলতে চায়না কিছু। বন্ধু বান্ধবরা কেউ দেখা হলে কেমন সংকোচ বোধ করে, হয়তো অবস্থানগত কারনে নিজেকে মেলতে পারে না।

শেষ পর্যন্ত প্রয়োজনটা এটা ওটা কাজের কথা আর প্রাপ্তিতে অকৃত্রিম হাসি। এই আজ জীবন। গাড়ি এসে থামে রবি ঠাকুরের পতিসোর বাগান বাড়িতে। পঞ্চাননের কথায় চিন্তার রাজ্য ছেড়ে বেড়িয়ে আসে শর্মীষ্ঠা। হ্যাঁ সেবার প্রথম ম্যজিস্ট্রেট হিসাবে যোগদান করতে এসে পঞ্চাননের সাথে এসেছিলো এখানে। তখন পঞ্চানন হাসতে হাসতে ইয়ার্কির ছলে বলেছিলো চলো এবার আমরা পালিয়ে বিয়ে করে ফেলি। ওটাকে মজাই মনে করে উড়িয়ে দিয়েছিলো শর্মীষ্ঠা।

নতুন চাকুরী নতুন উন্মাদনা, ক্ষমতার উত্তাপ, নিজেকে যোগ্য প্রমানের নেশা আর উপড়ে আরো উপড়ে এগিয়ে যাবার নেশা তখন অস্থিমজ্জায়। তর তর করে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়া কখন সময় পেড়িয়ে গেলো কে জানে! পেড়িয়ে কি গেছে সময়! পঞ্চানন আর শর্মীষ্ঠা হাঁটতে হাঁটতে কৃষ্ণচুড়া গাছের ছাঁয়ায় দাঁড়ায়, চোখে পড়ে যায় রবি ঠাকুরের বাড়ির সিংহদুয়ার। এখানেই এসে আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম সেবার না শর্মষ্ঠা!

বলে পাঁচু কাকা। হ্যাঁ ছোট্টো উত্তর। কিন্তু গলাটা একটু যেন কেঁপে উঠলো শর্মীষ্ঠার। তাহলে এখানে দাঁড়িয়েই তো পঞ্চানন বলেছিলো সেই কথাটা, যা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলো সে। আবারো ভাবনার রাজ্যে ফিরে যায় শর্মীষ্ঠা। তার কিছুদিন পরেই পঞ্চাননের বিয়ের কার্ড পেয়েছিলো সে। ফোনেও আসতে বলেছিলো পঞ্চানন। কিন্তু দেশে তখন রাজনৈতিক ডামাডোল সরকারি কর্মকর্তার ছুটি বাতিল, কিন্তু বিশেষ কিছু মনে হয়নি তো শর্মীষ্ঠার।

তবে কি তাকে আজো ভালোবাসে পঞ্চানন! যে বালোবাসার কথা একদিন সে নিজে মুখে বলতে গিয়েছিলো পঞ্চাননকে কিন্তু পঞ্চানন তাকে থামিয়ে দিয়ে সাতকাহন ধরিয়ে দিয়ে বিদায় করেছিলো। নইলে কেন তার ডাক এড়াতে পারে না পঞ্চানন? এখনো কেমন এক নায়কোচিত ভাব নিয়ে উদাস দৃষ্টিতে তার সামনে এসে দাঁড়ায়!
নিজের জীবনকে নিয়ে এবার ভাবতে চায় শর্মীষ্ঠা।

পঞ্চানন বলে দেখো শর্মীর্ষ্ঠা আমাদের পুরুষের জীবনটা সব সময়ই কোন না কোন নারীর দান সেটা কেউ বোঝে কেউ বোঝে না। আমার আজকের যে সংসার জীবন! তা আমার স্ত্রীর দান করা একান্ত জীবন। আমাকে পুরুষ শাসিত সমাজে এক পুরুষ মানুষ হিসাবে দাঁড় করিয়ে ই সে নিজেকে খোঁজে। তার সেক্রিফাইজ মানসিকতাই আমাকে বেশি করে পুরুষ মানুষ করে তোলে, নইলে আমরা পুরুষেরা তা নই।

প্রতিটি ঘরেই একই রূপ কিন্তু আমরা তা বুঝতে পারি না। কোন নারী যদি আত্ম সমর্পন না করে কিংবা কোন পুরুষকে পুরুষ হবার সুযোগ না দেয় তাহলে সেই নারীর ঘর কিংবা সংসারের স্বপ্ন বাস্তব হবে না। ভাবনা আর ব্যক্তিত্বের সংঙ্গা নতুন করে ভাবা প্রয়োজন সবার , সংঘাত নয় মেনে নেওয়ার তাগিদ ই সংসার,

নইলে পুরুষহীন এক যুক্তিময় রাজ্যের রাজা হবে হয়তো তুমি কিন্তু দিন শেষে তুমি একা নিঃসঙ্গ! ভাবতেই পারো তোমার আছে অনেক কিছু আছে কিন্তু ভাবতো। হঠাৎ এ কথাগুলো কেন বলছি তা হয়তো কোনদিন তুমি জানতে চাইবে না সে আমি জানি। শর্মীষ্ঠা কিছু বলে না শুধু লাল কৃষ্ণচুড়ার রাজ্যে কি যেন খোঁজে… পাঁচু কাকা এবার সোনালী ফ্রমের চশমাটা চোখে পরে নেয় তাকায় সেই গাছেরই দিকে…….

Advertisement
উৎসDebashish Sarker
পূর্ববর্তী নিবন্ধনাটোরে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ,মাস্ক ও লিফলেট বিতরণ
পরবর্তী নিবন্ধকার নিরাপত্তায় ডিজিটাল আইন?- আমীন আল রশীদ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে