বাংলা উপন্যাস ও ঔপন্যাসিক -ড. এস এ মুতাকাব্বির মাসুদ

0
351
Mutakabbir Masud

বাংলা উপন্যাস ও ঔপন্যাসিক

ড. এস এ মুতাকাব্বির মাসুদ

[বাংলা সাহিত্যে সমকালীন উপন্যাসের পেছনে আরো অনেক খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক ছিলেন; যাঁরা বঙ্কিম অনুবর্তী ও বঙ্কিম প্রভাবে প্রভাবিতও ছিলেন।তাঁদের অনেককেই আজ এ প্রজন্ম চেনে না!আমরাও তাঁদেরকে আর পর্যবেক্ষণে নেই না।কিন্তু সমকালের এই মেধাবী লেখকরা-ই বাংলা উপন্যাস সাহিত্যকে চূড়ান্ত সাফল্যের অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়ে গেছেন। আমাদের বাংলাসাহিত্যে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। সেলক্ষেই বাংলাসাহিত্যের এই ক্ষণজন্মা নক্ষত্রদের পরিচয়ের চুম্বকাংশ আজকের উপস্থাপনায় তুলে ধরার প্রয়াস রয়েছে।]

১. বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র(১৮৩৮-১৮৯৪) “আলালী” প্রভাববলয় থেকে বেরিয়ে স্বীয় প্রতিভায় নিজের স্থান করে নিয়েছেন। এটাকে “বঙ্কিমযুগ”বলা যেতে পারে।তিনি পাঁচ বছরে তিনটি উপন্যাস সফলতার সাথে প্রকাশ করে বাঙালি পাঠক সাধারণকে যুগপৎ বিস্মিতএবং মুগ্ধ করেছিলেন। উপন্যাসগুলো যথাক্রমে ‘ দুর্গেশনন্দিনী ‘(১৮৬৫),’ ‘ ‘কপালকুণ্ডলা ‘(১৮৬৬),এবং ‘ মৃণালিনী ‘(১৮৬৯)। তাঁর এ সৃজনশীল প্রতিভা বাংলাসাহিত্যে তাঁকে অসামান্য খ্যাতি প্রদান করে।

উল্লেখ্য চারবছর পর নিটোল সামাজিক উপন্যাস ‘ বিষবৃক্ষ ‘(১৮৭৩) তাঁরই হাত দিয়ে বেরিয়ে এসে বাংলাসাহিত্যে স্বকীয় গদ্যরীতির আত্মপ্রকাশ ঘটায় এবং এরই মাধ্যমে তিনি সাহিত্যে প্রতিভাদীপ্ত ঔপন্যাসিকের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন। তাঁকে আর পেছন ফেরে তাকাতে হয়নি।

তাঁর সাহিত্যসাধনার ক্রমাগত আত্মপ্রকাশ বিরামহীন ভাবে উপন্যাস সাহিত্যকে ঋদ্ধ করতে থাকে। বলা চলে ‘ দুর্গেশনন্দিনী ‘(১৮৬৫),থেকে ‘ সীতারাম ‘ (১৮৮৭) পর্যন্ত বঙ্কিমচন্দ্রের এ নিরলস প্রয়াস বাংলাসাহিত্যের উপন্যাসশিল্পের উচ্চাঙ্গের আধুনিক রূপটি প্রদান করে। এ ধারার সাহিত্যচর্চার অন্তর্বর্তী সময়ে বঙ্কিম সমসাময়িক লেখকরা বঙ্কিমী ভাব ও আদর্শ দ্বারা প্রাসঙ্গিক কারণে অনেকটা প্রভাবিত হয়েছিলেন।

২. বস্তুত ‘ দুর্গেশনন্দিনী ‘ আত্মপ্রকাশের পর এবং ‘বিষবৃক্ষ ‘প্রকাশের পূর্ব পর্যন্ত এ অন্তর্বর্তী সময়ের
মধ্যে বঙ্কিম অনুবর্তী ধারার লেখকদের বেশ ক’টি শিক্ষা প্রচারমূলক আখ্যায়িকা এবং রোমান্টিক ঐতিহাসিক এ্যডভেঞ্চার ও প্রণয়কাহিনীজাত উপন্যাস প্রকাশ পেয়েছিল। এ সকল ঔপন্যাসিকগণ বঙ্কিম অনুবর্তী সমকালীন বাঙালি ঔপন্যাসিক হিসেবে সমধিক পরিচিত ছিলেন। এ ধারার লেখকদের মধ্যে নবীনচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের

‘রত্নোত্তমা ‘(১৮৬৭),অজ্ঞাতনামার ‘মনোত্তমা'(১৮৬৯),মীর মশাররফ হোসেনের (১৮৪৭-১৯১২) ‘রত্নাবতী'(১৮৬৯),জয়গোপাল গোস্বামী(?)র ‘শৈবলিনী ‘(১৮৬৯),কালীবর ভট্টাচার্যের(?)’অকালকুসুম ‘(১৮৬৯), ক্ষেত্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের (?) ‘চণ্ডালিনী ‘(১৮৭৫), রাজকৃষ্ণ আঢ্যের (?) ‘কামরূপ কামলতা'(১৮৭১), গৌরীনাথ নিয়োগীর(?) ‘আশামরিচকা’ (১৮৭৩),

শিবচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘কাঞ্চনমালা'(১৮৭৩),অজ্ঞাতনামার’ বিজয় সিংহ'(১৮৭৪),রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের (?)’রাজবালা'(১৮৭২), হরিশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের(?)’ নটনন্দিনী'(১৮৭২),গোবিন্দচিত্ত ঘোষের’ চিত্তবিনোদিনী ‘(১৮৭৪), ক্ষেত্রপাল চক্রবর্তীর (?-১৯০৩)’চন্দ্রনাথ ‘(১৮৭৩-,দ্বি,সং ১৮৮৩)ইত্যাদি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

৩. বঙ্কিম অনুবর্তী ধারার লেখকদের মধ্যে আরো অনেকেই উল্লেখযোগ্য। যেমন, চন্দ্রশেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ের(?-?) ‘ভারত ভ্রমণ’ কাব্য (১৮৬৪)।লেখকের অভিজ্ঞতালব্ধ পল্লীচিত্র বেশ স্বাভাবিক ও সহৃদয় ভাবে বর্ণিত। দামোদর মুখোপাধ্যায়ের (১৮৩৫-১৯০৭) ‘ মৃন্ময়ী ‘(১৮৭৪),’ বিমলা ‘(১৮৭৭),তাঁর অপরাপর উপন্যাস ‘ দুই ভগিনী ‘(১৮৮৩),’ মা ও মেয়ে’, ‘কর্মক্ষেত্র ‘, ‘ শান্তি’, ‘ সোনার কমল ‘(১৯০৩), ‘ যোগেশ্বরী’, ‘অন্নপর্ণা’, ‘ললিত মোহন’, ‘সপত্নী ‘,’অমরাবতী ‘, ‘প্রতাপসিংহ ‘, ‘ বিষবিবাহ ”নবীনা’, ‘শম্ভুরাম’, ইত্যাদি।

ইংরেজি উপন্যাসের অনুবাদে দামোদরের দক্ষতা প্রশংসাযোগ্য। তাঁর ‘কমলকুমারী’ (দ্বি,সং১২৯১) এবং ‘শুক্লবসনা সুন্দরী ‘গ্রন্থ দু’টি যথাক্রমে স্কটের’ দি ব্রাইড অব ল্যামারমুর ‘ এবং কলিন্সের ‘এ ওমেন ইন হোয়াইট’ অবলম্বনে রচিত। দামোদরের রচনাভঙ্গি সরল-উজ্জ্বল এবং বিষয়োপযোগী। হরানচন্দ্র বাহারের ‘রণচণ্ডী’ (১৮৭৬) কাছাড়ের ইতিবৃত্তমূলক রচনা।

অপর উপন্যাস ‘সরলা ‘(১৮৭৬) সংসার চিত্রময় বড়গল্প।কেদারনাথ চক্রবর্তীর ‘ চন্দ্রকেতু ‘(১২৮৫), কালীময় ঘটকের (১৮৩৩-১৯০০)’ ছিন্নমস্তা ‘ (১৮৭৮) স্ত্রী শিক্ষামূলক উপন্যাস। ‘শর্বাণী ‘(১৮৯০) রোমান্টিক উপন্যাস এবং সুখপাঠ্য।

৪. গোপালচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘মায়াবিনী ‘ (১৮৭৭) যা গজনীর মামুদের ভারতবর্ষ আক্রমণ সংক্রান্ত ঘটনা অবলম্বনে রচিত বিয়োগান্ত রোমান্স এবং এতে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রভাব সুস্পষ্ট। ‘বীরবরণ'(১২৯০) বৌদ্ধ শাসনামলের কল্পিত কাহিনী। বৌদ্ধ সম্রাটদের
পরাজিত করে শৈব আদিশুর রাজা হয়েছিলেন; এ কাহিনীই বৃহৎ উপন্যাসটিতে বর্ণনায় ব্যাপ্তি পেয়েছে।মদনমোহন মিত্রের’ সময় সায়িনী ‘(১৮৭৩) ইতিহাস কল্পিত রোমান্স। উপেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘প্রতাপসংহার ‘(১৮৭৯, দ্বি,সং ১৮৮৩) প্রতাপাদিত্যের কাহিনী অবলম্বনে লেখা।

যোগেন্দ্রচন্দ্র দে ও নিত্যদাস রায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘নগনন্দিনী ‘(১৮৮৫)দুর্বোধ্য সাধুভষায় রচিত।কুঞ্জবিহারী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘একাকিনী ‘(১৮৮০) তথাকথিত ‘ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘, ‘একজন পরিব্রাজক প্রণীত’ ইতিহাস কল্পিত রোমান্স ‘ শৈলবালা ‘(১২৮৮),হরিমোহন মুখোপাধ্যায়ের(১৮৬০-?) বিয়োগান্ত উপন্যাস ‘যোগিনী ‘ (১৮৭৯),’কমলা দেবী ‘ (১৮৮৫),এবং তাঁর তৃতীয় উপন্যাস ‘ জীবনতারা ‘ (১৮৮৯)।

ক্ষেত্র গোপাল রায়ের ‘ইন্দ্রকুমারী'(১৮৯১) বর্গির হাঙ্গামার পটভূমিকায়য় রচিত; এতে রমেশচন্দ্রের(১৮৪৮-১৯০৯) সুস্পষ্ট অনুসরণ লক্ষ করা যায়।সবশেষে এ ধারায় দেবী প্রসন্নরায় চৌধুরীও (১৮৫৪-১৯২০) লিখেছেন অনেক উপন্যাস এবং বের করেছে “নব্যভারত” (১২৯০) নামে পত্রিকা।

তাঁর উপন্যাসগুলো হচ্ছে “শরৎচন্দ্র”(১৮৭৭-৭৮), “বিরাজমোহন” (১৮৭৮), “সন্ন্যাসী “(দ্বি,সং১২৮৮), “ভিখারী”(১৮৮১), “যোগজীবন”(১২৮৯), “অপরাজিতা “(১৮৯০), “পুণ্যপ্রভা”(১৮৯৬), “মুরালা” ইত্যাদি। বস্তুত বঙ্কিম সমকালীন বাঙালি লেখকরা সাহিত্য চর্চায় বঙ্কিমী ধারারই অনুবর্তী। এঁরা সফল(?) না হলেও বাংলাসাহিত্যে উপন্যাসের ধারাকে একটি সফল পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন নিঃসন্দেহে।

১১ নভেম্বর ২০২০

Advertisement
উৎসMutakabbir Masud
পূর্ববর্তী নিবন্ধবিন্দিয়া -কবি মুতাকাব্বির মাসুদ‌‌‘এর কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধনাটোরের গুরুদাসপুরে জাতীয় পার্টির উপজেলা ও পৌর শাখার সম্মেলন প্রস্তুত কমিটি গঠন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে