ভারতে আটকে থাকা হৃদরোগী নাটোরের আইনজীবী সহকারীর প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলাচিঠি
‘নাসিম উদ্দীন নাসিম , নাটোরকন্ঠ: তামিলনাড়– রাজ্যের চেন্নাই, বেঙ্গালুর ও ভেল্লোর শহরে চিকিৎসা নিতে গিয়ে অন্তত ২৫০ বাংলাদেশি আটকা পড়েছেন। ভারতের চলমান লকডাউনে দেশে ফিরতে না পারার কারণে অর্থ, খাদ্য এবং ওষুধের তীব্র সংকটে পড়েছেন তারা। অনেকেই খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাছেন। তাদের মধ্যে একজন নাটোর শহরের লালবাজারের এলাকার রামানুজ নিয়োগী আশীষ ।পেশায় আইনজীবী সহকারী। তিনি সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশী ফিরিয়ে আনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট খোলা চিঠি পাঠিয়েছেন ।
করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে গত ২৪ মার্চ থেকে ভারতে চলছে টানা লকডাউন। তাতে কমপক্ষে ১০৩ জন রোগী এবং তাদের সঙ্গে যাওয়া আÍীয়স্বজনসহ মোট ২৫০ জন বাংলাদেশি আটকা পড়েছেন তামিলনাড়–র চেন্নাই ও ভেল্লোর শহরে।তারা আপ্রাণ চেষ্টা করেও দেশে ফিরতে পারছেন না। দেশে ফেরাতে দিল্লি এবং কলকাতায় অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনও কোনো উদ্যোগ নি”েছ না বলে অভিযোগ তাদের। প্রথমদিকে দূতাবাসের পক্ষ থেকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগের কথা বলা হলেও, এখন দূতাবাসের হটলাইন নম্বরে ফোন করেও সংযোগ পাওয়া যা”েছ না।সংকটকে আরও তীব্র করে তুলেছে অসুস্থ রোগী, ফুরিয়ে আসা অর্থ এবং হোটেল মালিকদের দুর্ব্যবহার। এসব দুর্ভোগের কথা জানিয়েছেন সেখানে আটকা পড়া বাংলাদেশি রামানুজ নিয়োগী আশীষ। বাংলাদেশ প্রতিদিনের এই প্রতিনিধিকে মুঠোফোনে জানান,
তিনি ‘গত ১ মার্চ হার্টের উন্নত চিকিৎসার জন্য স্ত্রী ও সন্তান সহ ভারতে আসেন এবং দুই দিন পশ্চিমবঙ্গে হুগলী জেলাতে আÍীয়র বড়িতে থেকে ৩ মার্চ বেঙ্গালুরু আসি। ৪ মার্চ থেকে চিকিৎসা শুরু বিভিন্ন পরীক্ষা নীরিক্ষার পর হার্টে ৩ টি ব্লক ধরা পরে। নারায়ণা হেলথ সিটির চেয়ারম্যান ডা.দেবীপ্রসাদ শেঠী স বাইপাস সার্জারীর করার পরামর্শ প্রদান করেন।বাইপাস সার্জারী করবার আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় দেশ থেকে স্বজন- পরিজন-এবং আমার ঈঙ্গিত থিয়েটারের প্রচেষ্টায় অর্থ সংগ্রহ করে ভর্তি হই ১৬মার্চ এবং ১৯মার্চ আমার বাইপাস সার্জারী হয় এবং গত ২৪ মার্চ আমাকে হাসপাতাল রিলিজ প্রদান করেন।
ভারতে গত ২৪মার্চ থেকে শুরু হয় লকডাউন। আমার চিকিৎসাৎর সর্বসাকুল্লে খরচ হয় বাংলাদেশী টাকায় গিয়ে দাঁড়য় ৪ লাখ৫০ হাজার ।এরমধ্যে আমার নিজের এক লক্ষ বাঁকিটা স¤পূর্ণ সহযোগিতা। এখন এই টানা লকডাউনে বেঙ্গালুরু হোটেলে স্ত্রী- সন্তান নিয়ে অমানবিক দিনাতিপাত করছি। খাবার মতো অর্থ নেই।তারপর বাঁকি থাকে হোটেল ভাড়া।এগুলো যদি মেটাতে পারি তখন কোন সহৃদয় ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি দয়াকরে সহযোগিতার হাত বারান তবেই দেশে ফেরা সম্ভব নচেৎ জানিনা স্ত্রী পুত্র নিয়ে কি অন্ধকার ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে আমার। এমতাবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর সহানুভূতি ও সহযোগিতায় সরকারি সাহায্যে আমিসহ দেশের আটকা পরা রোগীদের সপরিবারে দেশে ফেরার আকুল আবেদন জানাচ্ছি ।
নাটোরের আরেক রোগী তানজিনা ইসলাম জানান, ১১ মার্চ’ আমি নিজের এবং আমার স্বামীর চিকিৎসার জন্য তাদের নিয়ে চেন্নাই ও ভেল্লোরে যাই। ১৩ মার্চ আমি ভেল্লোরের সিএমসি হাসপাতালে রোগী হিসেবে রেজিস্ট্রেশন করে ১৪ মার্চ থেকে নিজের এবং এরপর ১৬ মার্চ থেকে চিকিৎসা শুরু করি। দুজনের চিকিৎসা ২৬ মার্চ পর্যন্ত চলেছে।”এর মধ্যেই ২১ মার্চ রাতে জানতে পারি ২২ মার্চ রোববার সারা ভারত একদিনের জন্য লকডাউন করা হয়েছে। ২৩ মার্চ রাতে জানতে পারলাম তার পরের দিন অর্থাৎ ২৪ তারিখ থেকে সারা ভারতে টানা ২১ দিনের লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। ওই অবস্থায় কোথাও চলাচল প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। কারণ ভারত সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, লকডাউনের আগে থেকে বিদেশিরা যেসব হোটেলে অবস্থান করছেন, তাদের লকডাউন চলাকালেও সেখানেই থাকতে হবে।’
হোটেলে তিন দিন অবস্থানের পর তানজিনা দিল্লিস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনে যোগাযোগ করেন। ওই সময় দূতাবাসের পক্ষ থেকে তার নাম, ভারতে কোথায় অবস্থান করছেন সেই ঠিকানা, ভারতে ব্যবহৃত ফোন এবং পাসপোর্ট নম্বর হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে পাঠাতে বলা হয়। এই নির্দেশ মেনে
তানজিনা একই হোটেলে অবস্থান করা সকল বাংলাদেশীর বিবরণ টেক্সট করে দেন।পরের দিন ২৮ মার্চ তাজনিন কলকাতায় অবস্থিত বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনের কাছ থেকে একটি ফোন পান। হাইকমিশন আশ্বস্ত করে বলে, আটকে পড়া সকলকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে।
তানজিনা বলেন, ‘এর মধ্যে হোটেলে থাকা বাংলাদেশিরা চেন্নাই ও ভেল্লোরের নানা জায়গায় যারা আটকে পড়েছেন, তাদের তথ্য নিজ উদ্যোগে সংগ্রহ করে ই-মেইলে করি। এর প্রেক্ষিতে ১ কি ২ এপ্রিল আমাদের জানানো হয়, একটি বিশেষ বিমানে করে আমাদের চেন্নাই থেকে প্রথমে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হবে। বিমান ভাড়া পড়বে ২০ লাখ; তার মানে.১৬০ জন যাত্রীর জন্য মাথাপিছু সাড়ে ১২ হাজার টাকা। অনেকের অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য আমরা সকলেই এতে সম্মতি দেই। কিন্তু এর একদিন পরেই জানানো হয়, এই ব্যবস্থাও নিশ্চিত নয়। এরপর দিল্লি হাইকমিশনে ফোন দেওয়া হলে তারা জানায়, বাংলাদেশে লকডাউন শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ তারা নিতে পারবে না।
এদিকে আমাদের (আটকে পড়া বাংলাদেশি রোগী ও স্বজনদের) অবস্থা এখন খুবই শোচনীয়। সকলের জমানো টাকা-পয়সা অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে। লকডাউনের মাঝে দেশ থেকে টাকা আনাও এখন কঠিন। যাদের উপায় আছে, তারা জমিজমা বিক্রি করে হলেও কিছু টাকা আনিয়েছেন। কিন্তু সবাই তো আর তা পারেননি। এখানকার হোটেল মালিকরা এখন ভাড়ার জন্য খুবই দুর্ব্যবহার করেছে, হোটেল ছাড়ার জন্য তাগিদ দি”েছ, টেলিভিশনে ডিশের সংযোগ, বিদ্যুতের লাইন, ওয়াইফাই লাইন বন্ধ করে দি”েছ। এদিকে দূতাবাস যে হটলাইনে ফোন দিতে বলছে, সেখানে ফোন দিলে তা এনগেজড দেখা”েছ। অসংখ্যবার চেষ্টা করেও কেউ আর ফোন দিতে পারছেন না’।
তাজনিন আরও জানান, এখানকার (হোটেলের) পানিতে দুর্গন্ধ; পানি কিনে খেতে হয়। কিন্তু লকডাউনের কারণে পানি কিনতে পাওয়া যা”েছ না। আবার খাবার নিয়েও সমস্যা। মাছ-মাংস, সবজি কিছুই কেনা যা”েছ না। সকালে কিছুক্ষণের জন্য রেশনের দোকাল খোলা থাকে, সেখানে প্রচুরভীড়ে ভারতীয়দের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে শুকনো খাবার যেমন; চাল, ডাল, তেল, আলু ইত্যাদি কিনতে হয়।’অসুস্থ রোগীদের অনেকেই উ”চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ নানা প্রকার দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভুগছেন। প্রতিদিন শুধু আলু, তেল ইত্যাদি খেয়ে ইতোমধ্যেই অনেকের রক্তচাপ বেড়ে গেছে। আমরা একটি মানবিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যা”িছ। অথচ দূতাবাস আমাদের জন্য কিছুই করছে না। আর কিছুদিন এভাবে চললে আমাদের রাস্তায় থাকতে হবে’- আক্ষেপের সুরে এমন মর্মান্তিক অবস্থা তুলে ধরেন ।
তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাসের এই ঝুঁকির মাঝে আমাদের খাদ্যের সন্ধানে এখন প্রতিদিন বাইরে যেতে হয়। অনেকেই না খেয়ে দিন কাটা”েছন হোটেল কক্ষে। এই অবস্থা থেকে আমরা মুক্তি চাই। আমরা নিজ দেশে ফিরে আসতে চাই।