মেরিন ড্রাইভ: ‘রোড টু ডেথ?’- শ্যামল দত্ত

0
293
Shamol

শ্যামল দত্ত : কক্সবাজার শহর ছাড়িয়ে হিমছড়ি, ইনানী হয়ে মেরিন ড্রাইভ ধরে এগুনোর সময় পর্যটকদের দুচোখ ভরে যায় প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের মুগ্ধতায়। সমুদ্রের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড় আর মাঝখানে মসৃণ পিচের পথ চলে গেছে মাইলের পর মাইল। দেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশের লক্ষ্যে অপরূপ প্রকৃতির এই সৌন্দর্যমণ্ডিত জায়গাটি আরো সৌন্দর্যময় করার লক্ষ্যে সেনাবাহিনীকে দিয়ে ৮৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই মেরিন ড্রাইভ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের কঠোর পরিশ্রমে সমুদ্রের তীর বরাবর এই মনোমুগ্ধকর রাস্তাটি নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে কয়েক বছর আগে। কক্সবাজারের কলাতলী এবং লাবনী পয়েন্টে সমুদ্রের ঘোলা পানি আর মানুষের ভিড় এড়িয়ে যারা একটু নির্জনে সমুদ্রকে উপভোগ করতে চান, তাদের অনেকেই চলে যান হিমছড়ি এবং ইনানী পয়েন্টে। কেউ কেউ যান হোটেল টিউলিপ পয়েন্ট বা মেরিন ড্রাইভ ধরে আরো দূরে। সি বিচের পাশ বরাবর গড়ে তোলা এই রাস্তা- মেরিন ড্রাইভ সোজা চলে গেছে একেবারে টেকনাফ পর্যন্ত। ভবিষ্যৎ পর্যটনের আশায় ঢাকাসহ দেশের অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তি মেরিন ড্রাইভের দুপাশের পাশের সব জমি কিনে রেখেছেন। তবে এখন পর্যন্ত নির্জন এবং মনোমুগ্ধকর এই জায়গাটি বর্তমানে পরিচিত এক ভয়ঙ্কর হত্যাযজ্ঞের জনপদ হিসেবে। সন্ধ্যার অন্ধকার নামলেই এখানে তৈরি হয় এক ভীতিকর পরিবেশ। রাতের অন্ধকারে বহু নিরীহ মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে এই মেরিন ড্রাইভে।

২০১৮ সালে এই মেরিন ড্রাইভে নিহত হওয়া এক জনপ্রতিনিধির কিশোরী কন্যার কান্নার শব্দে এখনো ভারী হয়ে আছে মেরিন ড্রাইভের বাতাস। টেকনাফ পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার একরামুল হককে যখন হত্যা করা হয় তখন তার মোবাইল ফোনটি চালু ছিল। একটু আগে পরিবারের সঙ্গে কথা বলছিলেন র‌্যাবের হাতে আটক হওয়া একরামুল হক। ফোনটা আর বন্ধ করা হয়নি। একরামুল হকের কান্নার শব্দ শুনে তার কিশোরী মেয়ে টেলিফোনের ওপাশ থেকে বলছিলেন ‘আব্বু তুমি কানতেছ কেন?’ এরপর শোনা গেল একটি গুলির শব্দ এবং তারপর সবকিছু নিস্তব্ধ। মেরিন ড্রাইভের সমুদ্রের গর্জন আর ঢেউয়ের শব্দে মিলিয়ে যায় সবকিছু। পরের দিন টেকনাফ সদর ইউনিয়নের বাহারছড়া এলাকায় মেরিন ড্রাইভের পাশেই পাওয়া যায় একরামুল হকের লাশ। কিন্তু একরামুল হকের কিশোরী কন্যার ফোনে রেকর্ড হওয়া ‘আব্বু, তুমি কানতেছ কেন?’ শব্দটি ভারী থেকে আরো ভারী হয়ে মিশে আছে মেরিন ড্রাইভের বাতাসে। এক নিরীহ একরামুল হক কী কারণে খুন হলেন- সেই রহস্যের এখনো কোনো সুরাহা হয়নি। বাংলাদেশের ক্রসফায়ারের ইতিহাসে এটি করুণতম ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

ক্রসফায়ার শব্দটি নিয়ে বাংলাদেশের জনমানসে অদ্ভুত একটি প্রতিক্রিয়া আছে। বহু বিজ্ঞজনকে বলতে শুনেছি, বাংলাদেশের মতো অপরাধপ্রবণ দেশে বিচারব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগে অপরাধীরা সহজেই পার পেয়ে যায়। তাই ক্রসফায়ার ছাড়া কোনো উপায় নেই। ইংরেজিতে এনকাউন্টার হিসেবে পরিচিত এই শব্দটি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ভারত এবং ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে। ‘৭০ দশকের শুরুতেই চারু মজুমদারের নেতৃত্বাধীন উগ্র বামপন্থি আন্দোলনকে দমাতে এনকাউন্টার পদ্ধতির প্রয়োগ করে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছিল তৎকালীন ইন্দিরা গান্ধীর সরকার। কয়েক দশক আগে মহারাষ্ট্রের মুম্বাই শহরে আন্ডারওয়ার্ল্ডের অপরাধ এতই চরমে উঠেছিল যে এই অপরাধীদের ধরে ধরে মেরে ফেলার জন্য পুলিশের মধ্যে এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট নামে একটি ক্লাস তৈরি হয়েছিল। বলিউডে এই এনকাউন্টার নিয়ে কয়েকটি বাজার সফল সিনেমাও হয়েছে। সম্প্রতি বিহারে এক বিখ্যাত সন্ত্রাসী বিকাশ দুবেকে গ্রেপ্তারের পর এনকাউন্টারে হত্যার জন্য এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট হিসেবে এক পুলিশ কর্মকর্তার সুখ্যাতি সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে। চিলি ও বলিভিয়ায় বাম আন্দোলন দমাতে এই এনকাউন্টার করে বহু মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। কিউবায় সফল বিপ্লবের পর চে গুয়েভারার নেতৃত্বে ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে দেশে যে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তাকে দমাতে এনকাউন্টার পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে। মধ্যরাতে বাসা থেকে তুলে নেয়ার পর উধাও হয়ে যায় বামপন্থি আন্দোলনের বহু নেতা ও কর্মী। ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর বলিভিয়াতে মার্কিন গুপ্তচর বাহিনী সিআইএর হাতে আটক হয়ে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত ল্যাটিন আমেরিকায় বামপন্থি আন্দোলনের অনুসারী বহু মানুষ নিহত হয়েছেন এই এনকাউন্টারে। ১৯৭৫ থেকে প্রায় এক দশক জুড়ে নিকারাগুয়ার স্যান্ডানিস্ট গেরিলা কিংবা কলম্বিয়ার ড্রাগ মাফিয়াদের দমনেও এই এনকাউন্টার ব্যাপক আলোচনার সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে উগ্র বামপন্থি রাজনীতির নামে দিনে দুপুরে ডাকাতি, চাঁদাবাজি ও এক গ্রুপ দ্বারা অন্য গ্রুপের খুনোখুনির ঘটনা দমনে এই ক্রসফায়ার যখন শুরু হয়, তখন সাধারণ মানুষের মধ্যে তা স্বস্তি এনেছিল। কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ-খুলনা অঞ্চলে ক্রসফায়ার নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টির এক জরিপে সাধারণ মানুষের মধ্যে এর জনপ্রিয়তা দেখে তারা হতবাক হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিখ্যাত কুখ্যাত সন্ত্রাসীরা গ্রেপ্তার হওয়ার পর ক্রসফায়ারে তাদের মৃত্যুর ঘটনা ঘটলে সাধারণ মানুষকে আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ করতেও দেখা গেছে। যদিও দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো ক্রসফায়ারের নামে এসব হত্যাকাণ্ডে বিরোধিতা করে আসছে। তাদের মতে, একজন অপরাধীরও আইনের আশ্রয় পাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু সাধারণের প্রশ্ন হচ্ছে, এসব অপরাধীর আবার মানবাধিকার কি? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ম্যানেজ করে দেশের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অপরাধীরা পার পেয়ে যায় এবং আবার অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে পড়ে। তাই অনেকের মন্তব্য, ক্রসফায়ারের মধ্য দিয়ে এই অপরাধ জগতের অবসান হওয়া ভালো। কিন্তু বিচার ব্যবস্থার একটা মর্মবাণী হচ্ছে, অনেক অপরাধী ছাড় পেয়ে গেলেও একজন নিরপরাধ ব্যক্তি যাতে কখনো শাস্তি না পায়।

প্রয়াত আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময় এই ক্রসফায়ারের ভয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অনেক উগ্রপন্থি রাজনীতির নামধারী সন্ত্রাসীরা আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। এই অঞ্চল এখন অনেকখানিই শান্ত। সুন্দরবন অঞ্চলে সম্প্রতি এরকম বেশ কয়েকটি আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটেছে। কয়েকজন সাংবাদিকও এখানে মধ্যস্থতাকারীর ভ’মিকা পালন করেছেন। কিন্তু ক্রসফায়ারের বিপদজনক দিক হচ্ছে বহু নিরীহ মানুষ এর শিকার হয়ে যায়। টেকনাফের ওয়ার্ড কমিশনার একরামুল হক তার অন্যতম উদাহরণ। অন্যদিকে অবাধ হত্যার লাইসেন্স পেয়ে যে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তৈরি হয়, টেকনাফের ওসি প্রদীপ কুমার দাশ কিংবা তার সহযোগী সাব-ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলি এর আরেক ধরনের উদাহরণ এবং এই দুই ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের হাতে সর্বশেষ ভিকটিম হচ্ছেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। গত কয়েক বছর ধরে মাদক নিয়ন্ত্রণের নামে এই অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে যে অন্যায় কর্মকাণ্ড চলছিল, তার একটি উদাহরণ হয়ে গেল এই হত্যাকান্ড। এরকম আরেকটি ন্যক্কারজনক উদাহরণ হচ্ছে, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের ঘটে যাওয়া সেই আলোচিত সেভেন মার্ডার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে হত্যাকাণ্ডের এই প্রক্রিয়া যে কত ভয়ঙ্কর হতে পারে, তা ভাবলে এখনো আঁতকে ওঠে অনেক মানুষ।

দেশের সর্ব দক্ষিণের জেলা কক্সবাজার একটি মিশ্র সংস্কৃতির মিলনস্থল। এখানে হিন্দু-মুসলিম জনগোষ্ঠীর বাইরে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ছোট একটি অংশ, বৌদ্ধ ধর্মালম্বী বৌদ্ধ সম্প্রদায় ও রাখাইন জনগোষ্ঠীসহ আরো বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অনুসারীরাও আছে। মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এই অঞ্চলে এখনো এমন কিছু দুর্গম এলাকা আছে যেখানে আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ডও পৌঁছাতে পারে না। এসব অঞ্চলে অবাধে পপি চাষসহ অস্ত্র ও মাদকের জমজমাট ব্যবসা এখনো বহাল আছে। আমরা প্রায়ই দেখি বর্ডার গার্ডকে অভিযান চালিয়ে পপি চাষের বিভিন্ন ক্ষেত ধ্বংস করতে। এর উপরে গত কয়েক দশক ধরে মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবা নামের এক ড্রাগের ব্যবসা বর্তমানে এতটাই বিস্তৃত হয়েছে, তা এখন প্রায় দেশের সর্বত্রই ছড়িয়ে গেছে। ইয়াবার এই ব্যবসা- এই অঞ্চলের রাজনীতি, সমাজ ও আইনশৃঙ্খলার নিয়ামক শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে পঁচাত্তরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর যে রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছে, তার সুযোগে ধর্মান্ধ রাজনৈতিক গোষ্ঠী এই অঞ্চলটিকে প্রথমেই বেছে নিয়েছে তাদের কর্মকাণ্ড বিস্তৃত করার ক্ষেত্র হিসেবে। একদিকে মিয়ানমারের আরাকান থেকে আসা নির্যাতিত-নিপীড়িত রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীকে এই কাজে ব্যবহার করে অস্ত্র ও মাদক ব্যবসায় যুক্ত হয়েছে রাজনীতির আশ্রয়-প্রশ্রয় বেড়ে ওঠা সন্ত্রাসীগোষ্ঠী। দশকের পর দশক ধরে চলা এই ব্যবসার বিস্তৃতি এখন এতটাই বেড়েছে যে রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক সব পক্ষই এখন এর সুবিধাভোগী। এই কারণে শতবর্ষ ধরে দক্ষিণ চট্টগ্রাম এবং আরাকান রাজ্যের হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের যে মিলিত জীবন- তা এখন এক ভঙ্গুর ইতিহাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। রামুর বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের এক নেতা আমাকে বলেছেন, ভাবতেই পারিনি, উত্তম বড়ুয়া নামের একজন সামান্য কম্পিউটার কর্মীর ভুয়া ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে ৩শ বছরের পুরনো বৌদ্ধ সংস্কৃতির নিদর্শনগুলো এভাবে পুড়িয়ে ফেলা হবে। তার মতে, সুযোগ সন্ধানী, রাজনৈতিক সুবিধালোভী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর হাত ছিল এই ঘটনার পেছনে। তিনি আরো বলেন, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষজন কমতে কমতে বৃহত্তর রামু এলাকায় এই সম্প্রদায় এখন একটি ক্ষয়িষ্ণু জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। অথচ কয়েক দশক আগেও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরাই এখানে সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী ছিল। অন্যদিকে বৃহত্তর কক্সবাজারে রাখাইনপাড়াগুলো এখন প্রায় জনশূন্য। এসব জনগোষ্ঠী কোথায় চলে যাচ্ছে- তা নিয়ে সামাজিক গবেষণা হতে পারে। এর মধ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংসতায় উখিয়া-টেকনাফ এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে আরো প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী। নতুন পুরনো মিলিয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা এখন প্রায় ২০ লাখের কাছাকাছি। দক্ষিণ কক্সবাজারে এখন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তুলনায় বাংলাদেশিরাই সংখ্যালঘু হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়ানো এই রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা কবে সমাধান হবে তার কোনো ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়ে কোনো না কোনোভাবে প্রায় প্রতিদিনই আসছে রোহিঙ্গা শরণার্থী। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, উভয়পক্ষের সীমান্তে প্রচণ্ড কড়াকড়ির মধ্যেও ইয়াবা ব্যবসা সচল। এই ব্যাপারে অদ্ভুত এক মিত্রতা আছে উভয় পক্ষের মধ্যে। অনেকের বিশ্বাস, মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষী নাসাকা বাহিনী ও রোহিঙ্গারা- যৌথভাবে এ ব্যবসায় জড়িত এবং এই মাদক ব্যবসার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত আছে স্থানীয় বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। স্থানীয় কমিউনিটি পুলিশের একটি অংশ, এমনকি স্থানীয় সাংবাদিকদের কারো কারো বিরুদ্ধে এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে।

অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ
গত ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শ্যামলাপুর এলাকায় চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহত হওয়ার পর- গত কয়েক বছর ধরে মাদক নিয়ন্ত্রণের নামে এলাকায় কী চলছিল- সেই চেহারাটা কিছুটা উন্মোচিত হয়েছে। স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি, এই অঞ্চলে ক্রসফায়ার এখন একটি স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে গেছে। এই ক্রসফায়ার কর্মকাণ্ডে কেউ কারো চাইতে কম যায় না। ২০১৭ সালে মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হওয়ার পর প্রায় সাড়ে তিনশ’রও বেশি মানুষ ক্রসফায়ারে মৃত্যুবরণ করেছে। এরমধ্যে ১৬১ জন পুলিশের হাতে, র‌্যাবের হাতে ৪৯ জন, এমনকি বিজিবির হাতে ৬০ থেকে ৭০ জন নিহত হয়েছে। অবশ্য র‌্যাব এবং বিজিবির হাতে নিহতদের অনেকেই সীমান্তে ইয়াবা চোরাচালানকারী ও রোহিঙ্গা ডাকাত দলের সদস্য। তবে পুলিশের ক্রসফায়ার কর্মকাণ্ড টেক্কা দিয়েছে সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলী ইউনিয়নের সন্তান টেকনাফ মডেল থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশের নেতৃত্বে পুলিশের একটি গোষ্ঠী ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা আদায়ের একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। স্থানীয় কেবল টিভি নাফ টিভিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে দেখা যায়, ওসি প্রদীপ কুমার দাশ বলছেন, কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মহোদয়ের নির্দেশে টেকনাফকে মাদক মুক্ত করতে হবে। এই মাদকমুক্ত করতে গিয়ে গায়েবি আগুন জ্বলবে, গায়েবি ভাঙচুর হবে। এই গায়েবি আগুন ও গায়েবি ভাঙচুর জিনিসটা কী- তা অবশ্য তিনি পরিষ্কার করেননি। আরেক ভিডিও বার্তায় ওসি প্রদীপ কুমার দাশ বলছেন, মাদক ব্যবসায়ীরা হুঁশিয়ার, ইয়াবা ব্যবসা ছেড়ে দাও, অন্যথায় তোমাদের মেরিন ড্রাইভে নিয়ে যাওয়া হবে। স্থানীয় সাংবাদিকরা বলছেন, এই মেরিন ড্রাইভে নিয়ে যাওয়ার হুমকির মানে ক্রসফায়ারে মৃত্যু। তাদের মতে, ঢাকার ঊর্ধ্বতন পুলিশ প্রশাসন থেকে ও কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাসুদ হোসেনের পক্ষ থেকে তাকে এই কাজে ব্লাংক চেক দেয়া হয়েছে। গত বছরের শেষের দিকে বেশ কয়েকজন ইয়াবা ব্যবসায়ীকে আনুষ্ঠানিকভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তিনি আত্মসমর্পণ করিয়েছেন। প্রকৃত ইয়াবা ব্যবসায়ীদের বাদ দিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থের লেনদেনে চুনোপুঁটিদের ধরা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ঢাকার একটি টেলিভিশন চ্যানেলের চট্টগ্রাম প্রতিনিধির মধ্যস্থতায় বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে ওসি প্রদীপ কুমার দাশের উদ্যোগে শীর্ষস্থানীয় ইয়াবা ব্যবসায়ী সাইফুল করিমকে মিয়ানমার থেকে টেকনাফে ফিরিয়ে এনে আত্মসমর্পণ করানোর কথা বলে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলা হয়েছে বলেও জানা যায়। গত জুলাই মাসে টেকনাফে এক ভাই আটক হওয়ার পর চট্টগ্রামের চন্দনাইশে এসে সাদাপোশাকে আরেক ভাইকে তুলে নিয়ে গিয়ে একসঙ্গে দুজনকে ক্রসফায়ারে হত্যার অভিযোগ রয়েছে টেকনাফের পুলিশের বিরুদ্ধে। টেকনাফের চকবাজার এলাকায় গত ১৭ জুলাই ক্রসফায়ারে মারা যাওয়া এই দুই ভাই হচ্ছে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার কাঞ্চননগর এলাকার আমিনুল ইসলামের ছেলে আমানুল হক ও তার ভাই আজাদুল হক।

স্থানীয়রা বলছেন, প্রায় ৬ বছর ধরে কক্সবাজার এবং তার আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় ওসি প্রদীপ কুমার দাশ দায়িত্ব পালন করে আসছেন। দুবছর আগে টেকনাফের ওসি হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পূর্বে তিনি মহেশখালী থানার ওসি ছিলেন। এর আগে চট্টগ্রামে বিভিন্ন থানায় দায়িত্ব পালনের সময় অসংখ্য অভিযোগ আসে তার বিরুদ্ধে। এক তেল ব্যবসায়ীকে আটক করে চাঁদাবাজি করার অপরাধে তাকে শাস্তি দেয়া হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে দুদকের একটি মামলাও এখন বিচারাধীন। এত কিছুর পরও পুলিশের বিভিন্ন পদে বহাল থেকেছেন এই কর্মকর্তা। প্রদীপ কুমার দাসের পুরো পরিবারটিই পুলিশ পরিবার। তার এক ভাই বর্তমানে চট্টগ্রাম মহানগরীর একটি থানার ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আরেক ভাই ডিআইজি কার্যালয়ে কর্মরত অবস্থায় সম্প্রতি অবসরে গেছেন। অন্য এক ভাই পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত না হয়েও চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজি করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। টেকনাফে প্রদীপ কুমার দাশের ডানহাত হিসেবে পরিচিত সাব ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলির বিরুদ্ধে একটি বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়েছে সম্প্রতি। বিভাগীয় তদন্ত চলাবস্থায় কিভাবে বাহারছড়া ইউনিয়নের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করছিলেন, সেটা আরেক বিস্ময়। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রদীপ-লিয়াকত জুটি- ক্রসফায়ার দেয়া হবে না, এমন শর্তে বহু মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। কক্সবাজার পুলিশ প্রশাসন এসব জেনেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি তাদের বিরুদ্ধে।

এই বেপরোয়া জুটির সর্বশেষ ভিক্টিম হচ্ছেন মেজর অবসরপ্রাপ্ত সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। এই সেনা কর্মকর্তা হত্যার ঘটনা নিয়ে পুলিশ এবং সেনাবাহিনীকে এক মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করানোর অপচেষ্টা ছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের। যে কারণে সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ এবং পুলিশের আইজি বেনজির আহমেদকে কক্সবাজারে গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণ সিদ্ধান্তে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন ও নিহত রাশেদ সিনহার মাকে প্রধানমন্ত্রীর ফোন করে সান্ত্বনা দেয়া ও নিরপেক্ষ তদন্ত করে বিচারের আশ্বাসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে।

অন্যদিকে মেজর রাশেদ সিনহার ‘জাস্ট গো’ নামের ভ্রমণবিষয়ক ইউটিউব চ্যানেলের সহকর্মী নিরীহ দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী গত প্রায় আট দিন ধরে কক্সবাজার জেলে রয়েছে। মেজর রাশেদ সিনহাকে গুলি করে হত্যার সময় তার সঙ্গে থাকা স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের ছাত্র সাইদুল ইসলাম সিফাতকে পুলিশের দিকে অস্ত্র তাক করা ও পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়া কক্সবাজারের একটি রিসোর্ট থেকে মেজর রাশেদের আরেক সহকর্মী স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন ছাত্রী শিপ্রা দেবনাথকে গ্রেপ্তার করা হয় বিদেশি মদ, দেশীয় চোলাই মদ ও গাঁজা রাখার অভিযোগে। শিপ্রা দেবনাথ বুয়েটের আর্কিটেকচার বিভাগ থেকে পাস করার পর চলচ্চিত্রের প্রতি ভালোবাসায় আবার ফিল্ম এন্ড মিডিয়া স্টাডিজ পড়তে ভর্তি হয়েছিলেন স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওই একই রিসোর্ট থেকে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক ছাত্র তাহসিন রিফাত নূরকে গ্রেপ্তার করার পর ছেড়ে দেয়া হলেও সিফাত এবং শিপ্রাকে পহেলা আগস্ট পুলিশ আদালতে হাজির করে এবং আদালত তাদের জামিন না দিয়ে জেলে পাঠিয়ে দেয়। এই হচ্ছে আমাদের পুলিশ এবং বিচারব্যবস্থা। মেজর রাশেদ সিনহার হত্যাকাণ্ডের এই তুমুল আলোচনার মধ্যে এই দুই নিরীহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এখন পর্যন্ত কক্সবাজার জেলেই আছেন। পুলিশের আইজি বেনজীর আহমেদ কক্সবাজার সফরের সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, তদন্ত কমিটির রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত তারা জেলেই থাকবে। এই নিরীহ দুই শিক্ষার্থী কী অপরাধে এখন পর্যন্ত জেলে আছেন তাও কেউ স্পষ্ট করছে না। বাংলাদেশে ভ’ড়িভ’ড়ি মানবাধিকার সংগঠনের মধ্যে কোনো মানবাধিকার সংগঠনও নেই তাদের পাশে।

ইতোমধ্যে মেজর রাশেদ খানের বোনের দায়ের করা মামলায় টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলিসহ ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আদালত কর্তৃক তদন্তের ভার র‌্যাবের হাতে ন্যস্ত হওয়ায় র‌্যাব তাদের ৭ দিনের জন্য রিমান্ডে নিয়েছে। টেকনাফের পুলিশ প্রশাসনেও ব্যাপক রদবদল আনা হয়েছে। এখন দেখার পালা- দেশের প্রচলিত আইনি প্রক্রিয়া এই অপরাধীদের দ্রুত শাস্তি কতখানি নিশ্চিত করে? অন্যথায় যে সেনাবাহিনীর কঠোর ঘাম শ্রমে এই মনোমুগ্ধকর মেরিন ড্রাইভ নির্মিত হয়েছে, সেই মেরিন ড্রাইভের কালো পিচে এক অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তার রক্তের দাগ বিচারহীনতার সংস্কৃতির উদাহরণ হয়ে থাকবে। কারণ এই মেরিন ড্রাইভে ক্রসফায়ারের শিকার এক নিরীহ ওয়ার্ড কমিশনার একরামুল হকের কিশোরী মেয়ের ‘বাবা তুমি কানতেছ কেন?’ বলে কান্নার শব্দটি এখনো বঙ্গোপসাগরের গর্জনের মধ্যেও কান পাতলে শোনা যায়।

টেকনাফের পুলিশ কর্মকর্তাদের এই অপকর্মের কাহিনি শেষ করব টেকনাফের অন্য এক মহান পুলিশ কর্মকর্তার গল্প বলে। অনেকেই জানেন, দেশভাগের আগে ব্রিটিশ শাসনামলে টেকনাফে কর্মরত এক পুলিশ কর্মকর্তা ধীরাজ ভট্টাচার্যের সেই বিখ্যাত উপন্যাস ‘আমি যখন পুলিশ ছিলাম’ বইটির কথা। আত্মজৈবনিক এই উপন্যাসে স্থানীয় এক জমিদারের সঙ্গে রাখাইন নারী মাথিনের প্রেমের সমাপ্তি ঘটেছিল পানির কুয়ার মধ্যে পড়ে এই নারীর আত্মাহুতি দেয়ার মধ্য দিয়ে। টেকনাফ থানার কাছে সেই মাতিনের কুয়াটি এখনো আছে পর্যটন আকর্ষণ ও এক রাখাইন নারীর অতৃপ্ত প্রেমের সাক্ষী হিসেবে। মাথিনের কুয়ার পাশে দাঁড়ালে মনে হয় সবকিছু ঠিক আগের মতোই আছে। পরিবর্তন হয়েছে শুধুমাত্র এইটুকুই- একজন লেখক ও মানবিক মূল্যবোধের পুলিশ কর্মকর্তার বদলে এখন টেকনাফ থানায় কর্মরত ক্রসফায়ার আর চাঁদাবাজির অপবাদে কালিমালিপ্ত একদল পুলিশ।

লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ভোরের কাগজ
[লেখাটি দৈনিক ভোরের কাগজ, ৮ আগস্ট ২০২০ থেকে পুনঃপ্রকাশিত]

Advertisement
পূর্ববর্তী নিবন্ধকরোনামুক্ত নাটোরের সিনিয়র সাংবাদিক বীর মুক্তিযোদ্ধা ‘পিপলু’ কে ফুলেল শুভেচ্ছা
পরবর্তী নিবন্ধনাটোরের গুরুদাসপুরে পুকুর দখল নিয়ে শিক্ষককে কুপিয়ে জখম, লুটপাট

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে